উইল-ক্রিসের ঘটনায় সায়নের লেখা
সকালটা শুরুই হল এক অভূতপূর্ব ঘটনায়। ‘সীমা পেরনো’ কৌতুক করার অপরাধে ভরা প্রেক্ষাগৃহে সপাটে চড় খেলেন কৌতুকশিল্পী-সঞ্চালক। আমিও তো কৌতুকশিল্পেরই মানুষ। বহু সময়ে এ ভাবে বহু রসিকতা করেছি। হয়তো আবারও করব। ভয় হল, এ বার আমিও চড়-ট়ড় খেয়ে যাব না তো!
‘হিউমার’ বা ‘কৌতুক’ শিল্পকলারই এক অঙ্গ। তার মূল উদ্দেশ্য, মানুষকে হাসানো, আঘাত করা নয়। কিন্তু তার পরিবর্তে কৌতুকশিল্পীকেই যদি আঘাত করা হয়? ধরে নেওয়া যাক, মঞ্চে উঠে আমি কাউকে উদ্দেশ্য করে মুখে বললাম, ‘ঢিসুম’ (ঘুষি মারার আওয়াজ)। এ বার তার প্রতিক্রিয়ায় সেই লোকটি এসে আমাকে সত্যি সত্যিই ‘ঢিসুম’ আওয়াজ করে মেরে দিল। কোনটা বেশি ক্ষতিকর? আমার কাছে কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটি বেশি সমস্যাজনক। এক জন কৌতুকশিল্পী বিষয়বস্তু বেছে নেওয়ার সময়ে সব ক্ষেত্রে এটা বোঝা সম্ভব হয় না যে, কে কোনটায় আঘাত পাবেন, কে পাবেন না। তাঁর উদ্দেশ্য ইতিবাচকই থাকে।
অস্কারের মঞ্চে সঞ্চালক-কৌতুকশিল্পী ক্রিস রককে সপাটে চড় অভিনেতা উইল স্মিথের। কেন? অ্যালোপেশিয়ায় আক্রান্ত তাঁর স্ত্রী জাডা পিঙ্কেটের মাথার কম চুল নিয়ে ক্রিস ঠাট্টা করে বলেছেন, “আমি জি আই জেন-এর সিক্যুয়েলের অপেক্ষায় রয়েছি।” ১৯৯৭ সালের ছবি ‘জি আই জেন’-এ নায়িকার চরিত্রে অভিনেত্রীর মাথায় চুল কম থাকা নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনে ক্রিসের এই মস্করা। যার জেরে মেজাজ হারিয়ে ক্রিসের উপরে চড়াও হন স্মিথ। কিন্তু সত্যিই কি এই পরিস্থিতি তৈরি হওয়া জরুরি ছিল?
চার্লি চ্যাপলিনের একটি কথা মনে পড়ে গেল, ‘লাইফ ইজ আ ট্র্যাজেডি, হোয়েন সিন ইন ক্লোজ আপ, বাট আ কমেডি ইন আ লং শট’। অর্থাৎ মানুষের জীবন খুবই কষ্টের, যন্ত্রণাদায়ক মনে হবে যদি তুমি খুব কাছ থেকে দেখো। দূর থেকে সেই পরিস্থিতিতেই তুমি হাসবে। এক জন ম্যানহোলে পড়ে গেল। দূর থেকে সেটা দেখে আমার হাসি পেল। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমি ঘটনার খুব কাছে চলে যাব, তখনই মাথায় ভিড় করবে নানা প্রশ্ন, ‘লোকটি সুস্থ আছে তো? মাথায় আঘাত লাগেনি তো? হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে কি?’
স্মিথের স্ত্রী জাডা পিঙ্কেট একটি রোগে আক্রান্ত। প্রশ্ন ওঠে, সেই রোগ নিয়ে ঠাট্টা করে কি ভুল করেছেন ক্রিস? এখানে মনে করিয়ে দিতে চাই, কৌতুকের ব্যকরণে দু’ধরনের কৌতুক রয়েছে, ইংরেজি পরিভাষায় যা হল ‘পাঞ্চিং আপ’ এবং ‘পাঞ্চিং ডাউন’। প্রথমটি নিজের থেকে শক্তিশালী মানুষকে ঠাট্টা। নিজের চেয়ে দুর্বল কোনও মানুষের পরিস্থিতি নিয়ে মস্করা করাকে বলে ‘পাঞ্চিং ডাউন’। এ ক্ষেত্রে ক্রিস তাঁর থেকে তুলনায় দুর্বল (শারীরিক ভাবে রোগে আক্রান্ত জাদা, তাই দু্র্বল বলা হচ্ছে) মানুষকে তাঁর কৌতুকের বিষয়বস্তু করে তুলেছেন। সেখানেই সমস্যা হয়েছে।
যদিও আমি মনে করি, কৌতুক শিল্পে বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে উচিত-অনুচিতের কোনও বেড়া থাকতে পারে না। মানুষকে হাসানোর জন্যই এই শিল্প। যাঁরা নিজেদের নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করতে পারে, তাঁদের আমি বাহবা দিই। বড় উদাহরণ মদন মিত্র। তাঁকে নিয়ে কম মস্করা তো হয়নি। অথচ তিনি সেই মস্করাকেই নিজের অস্ত্র বানিয়েছেন। এখন তাঁর অনুরাগী সংখ্যা দেখলে চমকে যেতে হয়। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে সময়ে খাবার আসেনি বলে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীকে উল্লেখ করে খোলা চিঠি লিখেছিলেন। সে জন্য তাঁকে নিয়ে কোটি কোটি মিম তৈরি হয়েছে। তিনি কী করলেন? নিজেকে নিয়েই মস্করা করা শুরু করলেন। তার সূত্রে একটি বিজ্ঞাপনেও অভিনয় করলেন। আলিয়া ভট্টও বাদ যান না এই তালিকা থেকে।
আমি যদি আজ কোনও রাজনৈতিক দলকে নিয়ে মস্করা করি, সেই দলের সমর্থকেরা যদি আমাকে এসে পিটিয়ে যায়, তা হলে তো মুশকিল। কৌতুকে ব্যবহৃত শব্দের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর সেটা। তাই কৌতুক আমার কাছে সমস্যাজনক নয়। কিন্তু তা বলে কোনও নায়িকা খোলামেলা পোশাক পরেছেন বলে যদি আমি তাঁকে চার অক্ষর দিয়ে গালিগালাজ করি, বা তাঁর শরীরের অঙ্গ নিয়ে মন্তব্য করি, সেটা কৌতুকশিল্পের মধ্যে পড়ে না। সেটা কেবলই মন্তব্যকারীর অভব্যতা বোঝায়।
মানছি, কারও অসুস্থতা নিয়ে মস্করা করলে তাঁর বা তাঁর প্রিয়জনের ভাল লাগার কথা নয়। তা বলে উচিত শিক্ষা দিতে প্রকাশ্যে তাঁর উপর চড়াও হওয়াটাও কি ঠিক কাজ?