বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।
বাপ্পি লাহিড়ীর মতো পরম আপন আমার ক’জন আছেন? গুনিনি। কিন্তু বাপ্পিদার মতো আমার আত্মার আত্মীয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। এটা জোর গলায় বলতে পারি। সেই বাপ্পিদার আজ জন্মদিন। আজ তাঁকে ঘিরে আমার স্মৃতি রোমন্থনের দিন।
বাপ্পি লাহিড়ীর সঙ্গে আমাদের বহু বছরের পারিবারিক সম্পর্ক। কত দিনের জানা? সেটা হিসেবের বাইরে। এটা বলতে পারি, এক-দু’বছরের নয়, বহু বছরের এই হৃদ্যতা। বাপ্পিদার সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রপাত আমার বড় মাসি, মেসোমশাইয়ের তরফ থেকে। ওঁদের পরিবারের সঙ্গে শিল্পী পরিবারের যেন আত্মিক আদানপ্রদান, হৃদয়ের টান। শিল্পীর মা-বাবা বাঁশরী-অপরেশ লাহিড়ী যখন ছিলেন তখন থেকে ওঁদের মুম্বইয়ের বাড়িতে আমার যাতায়াত। বাপ্পিদাও কলকাতায় এলে আমাদের বাড়িতে আসবেনই। আমার মেসোমশাই ‘দাদাজি’ বড় মাপের দার্শনিক। ওঁর অনেক বই আছে। বাপ্পিদা সে সব ভীষণ মন দিয়ে পড়েছেন। ‘দাদাজি’র নীতিও অনুসরণ করেন। প্রচণ্ড সম্মান করেন তাঁকে। এখান থেকেই গাঢ় হয় আমাদের বন্ধন।
একা বাপ্পিদা নন, ওঁর স্ত্রী চিত্রাণীদিও আমাদের পরম আত্মীয়। সেই জন্য মুম্বই কখনও আমার কাছে অন্য শহর নয়। ওখানে পা রাখা মানেই চিত্রাণীদির ছায়ায় দিন কাটানো। আর চিত্রাণীদি মানেই ভাল-মন্দ রান্না। বাপ্পিদার সঙ্গে বউদি যত বার কলকাতায় এসেছেন, মাসির বাড়ির পাশাপাশি আমাদের বাড়িতেও এসেছেন। আমার সিঙ্গাপুরের বাড়িও ওঁদের ঘুরে দেখা।
পারিবারিক সূত্র পেরিয়ে আলাপের বাঁধন আরও দৃঢ় হল যখন আমি ইন্ডাস্ট্রিতে এলাম। আমি তখন অভিনয় দুনিয়ায় এক্কেবারে নতুন। প্রায় কিছুই জানি না, বুঝি না। বাপ্পিদা আর তাঁর পরিবার তখন ‘ঢাল’ হয়ে আগলেছেন আমায়। ‘‘আমরা তো আছিই’’, ওঁদের শুধু এই ক’টি কথায় ভরসা করে অনেকটা রাস্তা পেরিয়েছি। ক্রমশ আমি যখন পর্দায় পরিচিতি পেলাম তখন আমার ছবির গানে বাপ্পিদার সুর! আমার কাছে এগুলোই মস্ত পাওয়া। বাপ্পিদার সুরে আমার একের পর এক গান হিট। বাংলাদেশের ছবি ‘স্বামী কেন আসামী’-র সমস্ত গান আজও সবার মুখমুখে ফেরে। ওটাই আমার পড়শি দেশের সঙ্গে প্রথম কাজ। খুব শিগগিরিই আসতে চলেছে আমার সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ছবি ‘লবঙ্গলতা’। ছবিতে আমার সঙ্গে দেখা যাবে আলমগীর ভাই, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তকে। ওতেও বাপ্পিদা সুর দিয়েছেন।
শুধু বাপ্পিদা কেন, ওঁর ছেলে বাপ্পাও আমার ছবির সুরকার। ‘পটাদার কীর্তি’ ছবির গান জনপ্রিয় বাপ্পার গুণে। একই পথে হাঁটছে কিংবদন্তি সুরকার-শিল্পীর নাতি রেগো।
ওই পরিবারে পা রাখলেই মনে হয়, কিন্নর-কিন্নরীদের সভায় পৌঁছে গিয়েছি। ছেলে, বউমা, মেয়ে-জামাই, নাতি সবাই গান গাইছেন, সুর দিচ্ছেন। বাড়ির ভিতর, চারপাশে সাত সুরের নিত্য আনাগোনা। এমন এক সুরেলা মানুষ শেষে আমার জন্য গান বাঁধলেন! ছোট থেকে বাপ্পিদা আমার জন্য কিছু না কিছু করেই এসেছেন। সে সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল এ বছরের উপহার। আমায় দিয়ে গান গাইয়েছেন তিনি। আমি যে গাইতে পারব সেই বিশ্বাস বুনে দিয়েছেন ‘ডিস্কো ড্যান্সার’ ছবির সুরকার নিজে। তারই ফসল ‘ফুলমতী লজ্জাবতী’ গান। যা পুজোয় আমি গেয়েছি।
আমি তখন মু্ম্বইয়ে শ্যুটিং করছি। বাপ্পিদা এক দিন ফোন করে বললেন, ‘‘তুই বাড়িতে চলে আয়।’’ দাদা না ডাকলেও যেতাম। ডাকায় যাওয়ার আগ্রহ আরও বাড়ল। পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে হইহই করে উঠলেন তিনি, ‘‘তোকে একটা গান গাইতে হবে।’’ শুনে একটু থতমত খেয়ে গেলাম। ছবিতে গান গেয়েছি। কিন্তু আমারও নিজস্ব একটা গান হবে? এ যে কল্পনারও অতীত! দাদা বললেন, তিনি র্যাপ অংশটুকু গাইবেন। বাকি অংশ যে ভাবে দেখাবেন সে ভাবে গাইতে হবে। রেকর্ডিংয়ের দিন তিনেকের মধ্যেই তৈরি ভিডিয়ো সহ গোটা গান। এ বছরের পুজোয় বাপ্পিদার দৌলতে সবাই খোঁজ পেলেন গায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের।
শুনেছি, জন্মদিন মানেই নাকি নবজন্ম? ঠিক জানি না। তবে ২০২১-এর পুজোয় ‘নায়িকা’ ঋতুপর্ণা ‘গায়িকা’ হয়ে আবার জন্ম নিল। সবটাই বাপ্পিদা তোমার জন্য