কৌশিক-ঋদ্ধি
আকাশ মেঘলা। শহরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বিদ্যুৎ গর্জন বলে দিচ্ছে, দুর্যোগ প্রবল হতে চলেছে। তারই মধ্যে আনন্দবাজার অনলাইন হাজির অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর কনফারেন্স রুমে। উপলক্ষ, ‘স্বপ্নসন্ধানী’র ৩০ বছর। ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছেন বিভাস চক্রবর্তী। বয়স বা দুর্যোগ, কোনওটাই আজও থিয়েটারের নিয়মানুবর্তিতাকে টলাতে পারেনি! তিনি সব সময় সকলের আগে। খানিক পরে এলেন অপর্ণা সেন। সাদা শাড়ি, হাতকাটা ব্লাউজ, কাঁচাপাকা চুল! স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সুজন নীল মুখোপাধ্যায় তখন গল্পে মশগুল! একগাল দাড়ি এবং বাংলা ছবির সুসময় হাতে নিয়ে সৃজিত মুখুজ্জে আসতেই জমে উঠল আলোচনা!
‘স্বপ্নসন্ধানী’ দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং নাট্যকর্মীদের বিমা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কথামুখ সেরে নিলেন কৌশিক সেন। এ বার মাইক্রোফোন উত্তরসূরির হাতে। তিনি আলোচনাসভার সঞ্চালক, ঋদ্ধি সেন!
এক দিকে আলোচনাসভায় জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত তরুণ অভিনেতা। অন্য দিকে আড়ালে প্রতিনিয়ত তৎপর তাঁর বান্ধবী। অতিথি আপ্যায়ন থেকে প্রজেকশন, সবেতেই তীক্ষ্ণ নজর! ‘স্বপ্নসন্ধানী’র ৩০ বছরের সূচনালগ্নকে মাধুর্যময় করে তুলতে ঋদ্ধি-সুরঙ্গমা জুটির জুড়ি মেলা ভার!
আলোচনার বিষয় বাংলায় শেক্সপিয়রের লেখা নিয়ে কাজ এবং তার সীমাবদ্ধতা! অনেক দিক ছুঁয়ে গেলেন আলোচকেরা। অপর্ণা সেনের কথায় এল ‘রোমিও জুলিয়েটে’র আদলে ‘আরশিনগর’ ছবি-র গল্প! ছবিতে তিনি মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন থিয়েটার ও ছবির পরিসরকে। তাঁর আক্ষেপ, তা দর্শকের আনুকূল্য পায়নি! শ্রীজাতর লেখা ছন্দ-মিলের সংলাপ সমালোচিত হয়। তিনি আজও মনে করেন, ‘আরশি নগর’ যুগের থেকে এগিয়ে থাকা ছবি।
সৃজিত-অপর্ণা
সৃজিত শোনালেন তাঁর ‘সিজিদ্দা’ হয়ে ওঠার গল্প। কলকাতা সংলগ্ন ডক অঞ্চলের কাহিনি বলতে বসে তিনি ছুঁয়ে ফেলেছিলেন শেক্সপিয়র-কে। ‘জুলিয়াস সিজার’ ও ‘অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিয়োপেট্রা’-র আদলে বানিয়েছিলেন ‘জুলফিকার’। দেব থেকে প্রসেনজিৎ। যিশু কিংবা নুসরত! তারকার ছড়াছড়ি! তুমুল বক্স অফিস সাফল্য! কিন্তু সামালোচক ও শহুরে দর্শকের মোটেই পছন্দ হল না! তখন থেকেই তিনি ‘সিজিদ্দা’'! তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি, “সিজিদ্দা নামটা কিন্তু আমার বেশ পছন্দের!”
পৌলোমী বসুর স্মৃতিচারণা পৌঁছে দিল ‘মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটার’-এ। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন লাল-কালো জোব্বা পরা জ্যোতিষ্ক! দু’হাত উঁচিয়ে। জ্বলজ্বল করছে চোখমুখ! ‘কিং লিয়র’। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
পৌলোমী পড়ে শোনাচ্ছিলেন ‘কিং লিয়র-এর স্ক্রিপ্টে লিখে রাখা সৌমিত্রর হাজারো নোটস। কোথাও পরিচালক সুমন কী নির্দেশ দিয়েছেন। কোথাও লেখা আগামিকাল সহ-অভিনেতাকে কী পরামর্শ দেবেন। নোটসগুলো শুনলে বোঝা যায়, তিনি কতটা একাত্ম ছিলেন নাটকের সঙ্গে। ডায়েরির পাতা উল্টে পড়ছিলেন পৌলোমী। বৃষ্টিস্নাত শহরে ছড়িয়ে পড়ছিল স্মৃতির গন্ধ।
সুজন এখন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন ‘চেতনা’র ব্যাটন! একের পর এক মঞ্চসফল নাটক তাঁর হাতে। ‘চেতনা’র ৫০ বছরে তিনিও শেক্সপিয়র নিয়ে হাজির। মুখ্য চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। আপাতত তাঁর মুখে কুলুপ। তবে নাট্যমঞ্চে তিনি যে আবার আলোড়ন ঘটাতে চলেছেন, তা অনুমেয়!
বিভাস চক্রবর্তী মেলে ধরলেন ইতিহাসের পাতা। বাংলা নাটক চিরকালই শেক্সপিয়র অনুগামী। সময়, রাজনীতি ছপিয়ে বারেবারে হাত ধরতে হয়েছ ক্লাসিক নাট্যকারের। ক্রমশ ক্লাসিসিজমকে ছাপিয়ে পৌঁছেছেন প্রান্তিকের দোরগোড়ায়। হয়েছেন সকলের। তাই বোধ হয় বিশাল ভরদ্বাজ ‘ওমকারা’র মতো ছবি বানাতে পারেন। যেখানে ‘ইয়াগো’ হয় 'ল্যাংড়া ত্যাগী'!
সেই ইতিহাসে ভর করে ঋদ্ধি কি পারবেন বাংলা মঞ্চে স্বমহিমায় ‘হ্যামলেট’ ফুটিয়ে তুলতে? এ দিনের আলোচনা কিন্তু অনেকখানি আশা জাগিয়ে দিল!