Movie Review

নতুন গোয়েন্দা, রহস্যও জটিল! কেমন জমল নতুন ছবি ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’

ছবিতে পরিচালক ও কলাকুশলীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে এমনই একটা গোয়েন্দা গল্প বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু উপযুক্ত চিত্রনাট্য ও প্রয়োজনীয় যুক্তি কি রয়েছে এ ছবিতে?

Advertisement

অতীন্দ্র দানিয়াড়ী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৪ ১৪:০১
Share:

‘অরণ্যর প্রাচীন প্রবাদ’-এর পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত।

ছবি শুরু হয় একটি নদী থেকে। গানের আবহে নদীর উপর দিয়ে একটি নৌকা এগিয়ে চলে... এগিয়ে যেতে চায় গল্প। এমন কোনও দৃশ্য দিয়ে ছবি শুরু হলে, দর্শকের মধ্যে নদী, নদীর ধারে বসবাস করা মানুষের জীবন-জীবিকা বা তাদের লড়াই সংগ্রাম নিয়ে গল্প শোনার আগ্রহ তৈরি হয়। দর্শক তাঁর নির্দিষ্ট আসনে বসে মনে মনে এ ভাবেই নিজেকে তৈরি করতে থাকেন। কিন্তু, দুলাল দে পরিচালিত ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ ছবিটির গল্প তৈরি হয় পানাঘাট অঞ্চলের একটি সরকারি হাসপাতালকে ঘিরে। সৎ, আদর্শবান অমিত রায় (সুহোত্র মুখোপাধ্যায়) এই হাসপাতালে চিকিৎসক হয়ে আসে। এলাকার গরিব মানুষের সেবা করা এবং সঠিক ভাবে তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়াই অমিতের একমাত্র লক্ষ্য। কাজ করতে করতেই এই হাসপাতালের নার্স দেবযানীর (মিথিলা) সঙ্গে অমিতের একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। বাড়ির অমতেই তারা বিয়ে করে। হাসপাতালের প্রতি অমিতের ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ এবং সততা তার সহকর্মী চিকিৎসক এবং এলাকার নার্সিং হোমের মালিকদের সমস্যায় ফেলে দেয়। স্বাস্থ্য নিয়ে অসাধু চক্রের সাজানো কারবারে ধাক্কা লাগে। সাধারণ মানুষকে বাধ্য হয়ে ঘটিক-বাটি বিক্রি করে আর নার্সিং হোমে যেতে হয় না, সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা করিয়ে তারা সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যেই অমিত এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ‘ভগবান’ হয়ে ওঠে। এমন এক সময়েই হঠাৎ একদিন অমিত খুন হয়ে যায়। নদীর ধারে একটা বস্তার মধ্যে তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া যায়। এক বছর ধরে পুলিশ খুনের কিনারা করতে পারে না। সিআইডি অফিসার সুদর্শন হালদার (শিলাজিৎ মজুমদার) এই খুনের কিনারা করতে পানাঘাট আসে, সঙ্গে আসে ডাক্তারির ছাত্র, ক্রিকেট-ভক্ত শ্যালক অরণ্য (জীতু কমল)। অমিতকে কে খুন করল? কেনই বা খুন করল? ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ ছবিটি এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার গল্প।

Advertisement

গোয়েন্দা ঘরানার ছবিতে সাধারণত দুই ধরনের অপরাধী লক্ষ করা যায়। এক ধরনের গল্পে, প্রথম থেকেই বোঝা যায়, কে অপরাধী ! যাকে প্রমাণসহ ধরতে পারার ‘জার্নি’টাই একটি টানটান গল্প হয়ে ওঠে। অন্য ধরনের গল্পে, চারপাশের চেনা-অচেনা আবছায়ার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপরাধীকে খুঁজে বার করতে হয়। যুক্তি ও বুদ্ধির মাধ্যমে সেই অপরাধীকে জনসমক্ষে নিয়ে আসে একজন পেশাদার বা শখের গোয়েন্দা। ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ ছবিটি দ্বিতীয় ঘরানার, যেখানে গোয়েন্দা হিসেবে বাংলা ছবিতে প্রথম পা রাখল অরণ্য (জীতু কমল)।

ছবিতে মিথিলা ও জীতু কমল ছবি: সংগৃহীত

এই দ্বিতীয় ঘরানার ছবির ক্ষেত্রে চিত্রনাট্য এবং সংলাপের ঠাসবুনোট দর্শককে নড়তে দেয় না। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো একটু-একটু করে গল্প এগোতে থাকে শেষ দৃশ্যের দিকে, যেখানে পৌঁছে দর্শক জানতে পারে, প্রকৃত অপরাধী কে? সেটাই এই ঘরানার ছবির সবচেয়ে বড় চমক। ছবিতে পরিচালক ও কলাকুশলীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে এমনই একটা গোয়েন্দা গল্প বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু উপযুক্ত চিত্রনাট্য ও প্রয়োজনীয় যুক্তির প্রতি মনে হয় আরও একটু যত্ন নেওয়া যেত। এই ধরনের ছবিতে সংলাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু, ছবির কিছু দৃশ্যে অতিরিক্ত আবার কিছু দৃশ্যে অপ্রয়োজনীয় সংলাপ নাটকের ধারটাকেই যেন কমিয়ে দেয়। চিত্রনাট্যের সহজ সরল গতির সঙ্গে তীক্ষ্ণ এবং প্রয়োজনীয় সংলাপ ছবির নাটকীয় সংঘাতগুলিকে বোধ হয় আরও জোরালো করতে পারত।

Advertisement

সিআইডি অফিসার সুদর্শনের চরিত্রটি গল্পের খাতিরে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ছবিতে চরিত্রটিকে খুবই সাধারণ মনে হয়েছে। এক বছর ধরে পুলিশের তদন্তে কোনও কিনারা না হওয়া এক জটিল মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআইডি অফিসারের কাজের পরিধিতে আরও ওজন এবং গতি থাকা উচিত ছিল বলে মনে হয়। তাই অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শিলাজিৎ মজুমদারের মতো বলিষ্ঠ অভিনেতার এই ছবিতে তেমন কিছুই করার ছিল না। গোয়েন্দা হিসাবে জীতু কমল প্রথম ছবিতে যথাযথ, তবে বয়সের কারণে ডাক্তারির ছাত্র হিসাবে তাঁকে একটু বেমানানই লাগছিল। ছবিতে, নদীর ধারে অরণ্য, খাওয়ার টেবিলে অরণ্য ও সুদর্শন, গাড়িতে অরণ্যের পানাঘাটে আসা বা অমিতের খুন হওয়া ইত্যাদি দৃশ্য ভাল লাগলেও, বিধায়কের জন্মদিন, অরণ্যের ক্রিকেট খেলা বা অমিতের রোগী দেখার মতো দৃশ্যগুলিতে সম্পাদনার প্রয়োজন চোখে পড়ে।

গল্পের প্রয়োজনে ছবিতে ফ্ল্যাশব্যাক এসেছে। আবার চিত্রনাট্যের মোচড়ে গল্প সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। চলচ্চিত্রে এই ফ্ল্যাশব্যাক ও ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ডের খেলাটা সঠিক ভাবে পরিচালনা করা খুব কঠিন। পরিচালক দুলাল দে এই বিষয়টাকে আয়ত্তে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও, মাঝেমধ্যেই ফ্ল্যাশব্যাক ও ফরোয়ার্ডের গতির হেরফের, গল্পের দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের মধ্যে থাকা যোগটাকে জটিল করে তোলে, ফলে অনেক সময়েই কাহিনি সহজ সরল ভাবে এগোতে পারে না।

ছবিতে অভিনেতারা চরিত্র অনুযায়ী ভাল কাজ করার চেষ্টা করেছেন। দেবযানীর চরিত্রে মিথিলা এবং অরণ্যের সহকারীর চরিত্রে সায়ন ঘোষের অভিনয় নজর কাড়ে। ছবিতে শুভদীপ গুহর সঙ্গীত এবং প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ের সিনেমাটোগ্রাফির কাজ ভাল লাগে। তবে, মেক আপ আরও একটু যত্ন নিয়ে করা যেতে পারত। ক্লোজ দৃশ্যে চড়া মেক-আপ চোখকে পীড়া দেয়।

গ্রাফিক সনৎ সিংহ

বাংলার দর্শক গোয়েন্দা ছবি চিরকালই পছন্দ করে। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটি, শবরদের মতো পরিচিত গোয়েন্দাদের বাইরে, অন্য রকম গল্প নিয়ে নতুন নতুন গোয়েন্দারাও বাংলা চলচ্চিত্রে পা রাখছে। এই ধরনের পরীক্ষামূলক কাজ বাংলা চলচ্চিত্রকেই সমৃদ্ধ করতে পারে, তৈরি হতে পারে মনে রাখার মতো কিছু ছবি। সে দিক থেকে দেখতে গেলে, দুলাল দে-র ‘অরণ্য’ চরিত্রের মধ্যে বাঙালি নতুন এক গোয়েন্দাকে খুঁজে পেল। তৈরি হল নতুন ধারার গল্প, যেখানে ডাক্তারির ছাত্র এবং ক্রিকেটার অরণ্য একজন গোয়েন্দা। ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে চলচ্চিত্র পরিচালনায় পা রাখা পরিচালক দুলাল দে এমনই এক আকর্ষণীয় চরিত্রকে বড় পর্দায় হাজির করলেন। বিদেশি থ্রিলারের মতো টানটান একটি গোয়েন্দা গল্প বলার সাহসী এবং পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা হিসেবে দুলাল দে-র ‘অরণ্য’র প্রাচীন প্রবাদ’ ছবিটি দর্শকেরা অবশ্যই মনে রাখবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement