Chaalchitra Movie Review

চলচ্চিত্রের চালচিত্রে টানটান থ্রিলার! খুনির খোঁজ কী ভাবে মনস্তাত্ত্বিক হতে পারে তা দেখাল এই ছবি

বিভিন্ন বিদেশি মনস্তাত্ত্বিক ‘থ্রিলারের’ ছাপ পাওয়া গেলেও এটি একটি আপাদমস্তক মৌলিক গল্প হিসেবেই মন ধাঁধিয়ে দিতে সক্ষম।

Advertisement

দেবত্রী ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৫
Share:
Review of new Bengali film Chaalchitra: The Frame Fatale starring Tota Roy Chowdhury

কেমন হল চালচিত্র: দ্য ফ্রেম ফ্যাটাল? ছবি: সংগৃহীত।

যাঁরা নিত্যদিন অপরাধের সঙ্গী, অপরাধের জগতে যাঁদের রোজ আনাগোনা— সেই পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগের মানুষেরা এত দিনে এটুকু জেনে গিয়েছেন, যে ‘সিরিয়াল কিলার’দের গভীর ক্ষত থাকতে পারে, থাকতে পারে অসহনীয় কোনও অতীত বা এমন এক মানসিক জগৎ, যেখানে কোনও অন্যায়কে রুখতে আইন হাতে তুলে নেওয়ার স্পর্ধা পর্যন্ত থাকতে পারে! কিন্তু যেটা কখনওই থাকে না তা হল, হারানোর ভয়। আর সেই ভয়টুকু থাকে না বলেই হয়তো এমন সাংঘাতিক, নৃশংস কিছু করতে তাঁদের বিবেকে বাধে না।

Advertisement

খুনের উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, খুনের ধরন হবে এক রকম। এ রকম পর পর একাধিক খুন হওয়া মানেই অপরাধীর জুটবে ‘সিরিয়াল কিলার’-এর তকমা। সে রকমই এক খুনির আবির্ভাব ঘটে কলকাতা শহরে। আর তাকে ধরতে দিনরাত এক করে ফেলে সিপি কনিষ্ক চট্টোপাধ্যায় (টোটা/পুষ্পরাগ রায় চৌধুরী) ও তাঁর তদন্তকারী দল নাসির রহমান (অনির্বাণ চক্রবর্তী), রিতেশ কুমার (শান্তনু মহেশ্বরী) ও বিশ্বরূপ অধিকারী (নবাগত ইন্দ্রজিৎ বসু)।

রিতেশ আর বিশ্বরূপের কাছে খুনের এই পদ্ধতি নতুন এবং খানিক অবাক করে দেওয়া হলেও কনিষ্ক আর নাসিরের চোখে ফুটে ওঠে প্রায় ১২ বছর আগের এক সিরিয়াল কিলারের গল্প। তাদের মনে পড়ে যায়, কী ভাবে সেই খুনি মেয়েদের মেরে ফেলে, তাদের লালপাড় সাদা শাড়ি পরিয়ে চালচিত্রে টাঙিয়ে রেখে যেত!

Advertisement
Review of new Bengali film Chaalchitra: The Frame Fatale starring Tota Roy Chowdhury

ছবির একটি দৃশ্যে টোটা রায়চৌধুরী এবং রাইমা সেন। ছবি: সংগৃহীত।

এ বারের খুনিও সেই এক ছাঁচে ফেলে খুন করছে মেয়েদেরই। যারা অবিবাহিত, একলা থাকে এই শহরে। খুনের ছাঁচ যদিও বা এক, কিছুটা খুঁটিয়ে দেখলেই কিন্তু বোঝা যাবে তফাত কোথায়। সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট দেওয়া আছে খুনগুলির মধ্যেই। তা হলে এই খুনি কি ‘কপিক্যাট’? ‘চালচিত্রঃ দ্য ফ্রেম ফেটাল’-এর পরিচালক প্রতিম ডি গুপ্ত এই ‘হু ডান ইট’-এর রহস্যের জট ছাড়িয়েছেন বিভিন্ন স্তরে। রহস্যের কিনারা করতে গেলে বা খুনি কে, তা খুঁজে বার করার নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে যে মনস্তত্ত্ব, বুদ্ধি, তৎপরতা আর থিয়োরির মিশেলে তাকেই সযত্নে পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক। আর তাঁকে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন অভিনেতারা।

ছবির শুরু থেকেই চিত্রনাট্য টানটান হওয়ার ফলে দর্শক ছবিতে মনোযোগ দিতে বাধ্য হবেন। আর ছবির শেষ পর্যন্ত গল্পের গতি ঢিলে না হতে দেওয়ার জন্য পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য। বাংলা ছবিতে গোয়েন্দা বা ‘কপ ইউনিভার্স’ বলতে বেশ কিছু মুখ পর্দায় ক্রমশ একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। সেখানেও বদল আনায় চোখের স্বস্তি এসেছে। পুলিশ বা গোয়েন্দা মানে শুধুই ডেয়ারডেভিল, বুদ্ধিদীপ্ত আর অ্যাকশন সর্বস্ব মানুষ নয়, তার আভাস মিলবে চার তদন্তকারীর মধ্যেই। সেখানেই উঠে আসবে বেশ কিছু সাবপ্লটও— বাবা-মেয়ের গল্প, ক্লান্ত বৈবাহিক জীবন বয়ে নিয়ে চলা স্বামী-স্ত্রীর কথা , প্রেমে পড়া আর প্রেম করার গল্পও। মনে করিয়ে দেবে, বাইরে শক্ত মুখোশ এঁটে রাখলেও তাদের জীবনের দুর্বলতার দিকগুলোও কম জোরালো নয়।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

কেন্দ্র চরিত্র কনিষ্ক চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন টোটা রায়চৌধুরী। টোটা অবশ্য পুলিশের চরিত্রে এই প্রথম অভিনয় করছেন না। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চেহারায় ও অভিনয়ে দক্ষতার ছাপ স্পষ্ট হয়েছে। নাসিরের চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তী এতটাই সাবলীল যে, পর্দায় তিনি এলে বাকিরা খানিক ম্লান হতে বাধ্য। শান্তনুর এটি প্রথম বাংলা ছবি আর ইন্দ্রজিতের বড় পর্দায় হাতেখড়ি। দু'জনেই তাঁদের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। শান্তনুর বেশ কিছু প্রোফাইল সায়ন মুন্সীর কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মিলির চরিত্রে রাইমা সেনের অভিনয়ে তেমন নতুনত্ব না থাকলেও স্বস্তিকা দত্ত আর তনিকা বসু অপেক্ষাকৃত ছোট দু'টি চরিত্রে মন দিয়ে অভিনয় করেছেন। সত্যি বলতে নাসিরের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কন্যা হিসাবে তনিকা বসুর অভিনয় দর্শকমনে গভীর ছাপ ফেলে। স্বল্প উপস্থিতিতে ব্রাত্য বসুও চমকে দেবেন।

ছবির প্রচার ঝলক থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, এই ছবির ‘ইউএসপি’ বেশ খানিকটা জিয়াউল ফারুক অপূর্বের হাতে। বাংলাদেশের এই জনপ্রিয় অভিনেতার এ পার বাংলার অনুরাগীর সংখ্যা বেশ চোখে পড়ার মতো। টলিউডে এটি তাঁর প্রথম ছবি। আর প্রথম ছবিতেই তিনি বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর অভিনয় আর উপস্থিতির জোর কতটা। এই ছবিতে তাঁর উপস্থিতি একটু নাটকীয় অভিনয়সমৃদ্ধ হলেও, বেশি ক্ষণের নয় বলে, তাঁর অনুরাগীরা আশাহত হবেন। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তিনি টলিউডে আরও কাজ করবেন।

গল্পের বেশির ভাগ ভাল হলেও খুনি ধরা পড়ার অংশটা বিশেষ জমেনি। সবটা টানটান রেখেও গল্পের এই জরুরি দিকটায় পরিচালক কেন ঢিলে দিলেন বোঝা গেল না। দেবজ্যোতি মিশ্রের সুরে গানগুলোও খুব একটা দাগ কাটে না। তবে তূর্য ঘোষের চলচ্চিত্র গ্রহণ কলকাতাকে এক জুতসই প্রেক্ষাপট হিসাবে পর্দায় তুলে ধরেছে। সব মিলিয়ে বড়দিনের সপ্তাহান্তে হালকা উৎসবের আমেজ মন্দ লাগবে না। যাঁদের রোমাঞ্চ বা রহস্য ভাল লাগে, তাঁদের জন্য এই ছবি নিঃসন্দেহে বড়দিনের উপহার হয়ে উঠবে।

প্রেক্ষাগৃহে অভিনেতা অপূর্বের অনুরাগী দেখার মতো। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে তো বটেই, এমনকি মেদিনীপুর থেকেও অনুরাগীরা কলকাতায় ছুটে এসেছেন, প্রথম দিনের শো দেখবেন বলে। অনেকেই হতাশ তাঁর চরিত্র ছোট হওয়ায়। ছবির শেষে সে কথা পরিচালককে জানাতেও ভোলেননি তাঁরা। উল্লেখ্য, ছবির প্রিক্যুয়েল আসার সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।


আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement