ওয়েব সিরিজ়ে দাপুটে পুলিশ আধিকারিকের চরিত্রে দেখা যাচ্ছে জিৎকে। ছবি: সংগৃহীত।
প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হবে, পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক কোনও চিত্রকাহিনিতে নতুন পুরনো মিলিয়ে কলকাতার এত জন তারকা এবং শক্তিশালী অভিনেতাকে একসঙ্গে আনার উদাহরণ সমসাময়িক কোনও ওটিটি ছবি তো ছাড়, বড় পর্দার সিনেমাতেও কখনও চোখে পড়েনি। ‘খাকি: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’-এর সৃষ্টিকর্তা নীরজ পাণ্ডে যা করে দেখিয়েছেন।
কলকাতার তলপেটের উপর ভিত্তি করে বানানো কোনও থ্রিলারের এতো সুদেহী, পরিপাটি, পূর্ণ গঠনও চোখে পড়েনি হাল আমলে। এই সুঠাম, নির্মেদ কাহিনি বিন্যাসের দায়িত্ব অনেকাংশেই বর্তায় এ কাহিনির গবেষকের উপর। সেটি করেছেন সুরবেক বিশ্বাস। সুরবেক পেশাগত ভাবে প্রধানত কলকাতার অপরাধজগৎ এবং পুলিশ প্রশাসন নিয়ে সাংবাদিকতা করেন। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে এই আশা করাই যায়।
‘খাকি ২: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
সত্যি বলতে নীরজ এই সিরিজ়ের জন্য সেরা মানুষদের নিয়ে কাজ করার সৎ চেষ্টা করেছেন। এই সিরিজ়ের কাহিনিকারদের মধ্যে তিনি নিজে যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন দেবাত্মা ও সম্রাট চক্রবর্তী। তাই হয়তো গল্প এমন টান টান ও নির্মেদ। অভিনয়ের মানও খুবই উঁচুতে। ধরা যাক প্রসেনজিৎ। তাঁকে এমন চরিত্রে আগে কখনও দেখা যায়নি। এক এমন রাজনীতিক, যে কোনও মূল্যবোধের তোয়াক্কা করে না। সম্পূর্ণ অসাধু এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক মানুষ, যে কলকাতার অপরাধজগৎকে নিজের অঙ্গুলিহেলনে চালাতে পছন্দ করে। অথবা শাশ্বত। এমন একজন রাজনৈতিক মস্তান, যে এমন একটি সময়ের সন্তান, যখন মস্তানদেরও কিছু মূল্যবোধ ছিল। অথবা ঋত্ত্বিক। তিনি বর্তমান সময়ের মূল্যবোধহীন রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এক মস্তান। কিংবা আদিল, যে মানুষ হিসাবে নিম্নতম মানের। জিৎ যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন, সেটি এ যাবৎ তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির থেকে তেমন অন্য রকম কিছু নয়। ঋজু, দৃঢ়, অদর্শবাদী, পেশার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এক চরিত্র, যাকে খুব সহজেই নায়ক হিসাবে ভালবাসতে ইচ্ছা করে। কিন্তু যে অভিনয়টি তাঁর কাছ থেকে বার করে নিয়েছেন নীরজ, সেটি খুবই ছকভাঙা। জিৎ বাংলা সিনেমার তারকা। তাঁর অভিনয়ে তারকাসুলভ কিছু ধরন আছে। তার খানিকটা এই সিরিজে থাকলেও, আপাত ভাবে তাঁর উপস্থিতি কোনও এক জাদুতে এখানে বেশ অনেকটাই অন্য রকম।
‘খাকি ২: দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’ ওয়েব সিরিজ়ের একটি দৃশ্যে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাভিত্তিক কোনও কাহিনিতে এতটা রুদ্ধশ্বাস, মারপিট, গাড়ির ধাওয়া কিংবা উত্তেজনাও খুব সহজলভ্য নয়। সে সব থাকাটাও এই সিরিজ়ের উপরি পাওনা। যদিও সিরিজ়টি আদতে হিন্দি ভাষায় নির্মিত, গল্পটি তো দিনের শেষে কলকাতারই। সেই হিসাবে আত্মাটি বাঙালিই। আরও একটি কথা বলাই বাহুল্য। বাঙালি আমজনতা ভাল করেই চেনেন লালবাজারের এবং কলকাতার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা থানাগুলির পেশাদার ঘুনেদের। মূল্যবোধহীন, উচ্চাকাঙ্ক্ষী অথচ মনুষ্য নামধারী কিছু পেশাদারদের। আর এই ভিড়ের মধ্যেও কিছু দ্বীপের মতো মানুষের কথাও জানেন, যাঁরা নিজেদের পেশার সঙ্গে কখনও কোনও সমঝোতা করেন না। লালবাজারের অন্দরের এই চিত্রটি খুব উলঙ্গ ভাবে ফুটে উঠেছে এই সিরিজ়ে। তবে একই নিঃশ্বাসে কাহিনির আরও একটি দিকের কথাও উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। বিস্তারে অনেকগুলি সমাপতন খানিক দৃষ্টিকটু লাগে। উদাহরণস্বরূপ প্রসেনজিতের চরিত্রটি। সে রাজনৈতিক নেতা হতে পারে, কিন্তু মস্তানদের গতিবিধির যে গোপন খবর, যা এমনকি মস্তান দলের অন্যদের কাছেও নেই, সে খবরগুলিও তার কাছে পৌঁছোয় কী ভাবে? যেমন শাশ্বতের চরিত্রটি ঠিক কোথায় গিয়ে আত্মগোপন করেছে, সে তথ্য সে কাউকে বলে যায়নি, এমনকি পরিবারের সভ্যদেরও নয়। তা হলে সে খবর প্রসেনজিতের চরিত্রটি সবার আগে পায় কী ভাবে? সে প্রচুর ক্ষমতাশালী মেনে নিলেও কি তার পক্ষে এত গোপনীয় এক ঠিকানার খোঁজ পাওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, তার খবর পৌঁছোনোর কিছু কিছু সূত্র পরিষ্কার করা হয়েছে সিরিজ়ে। কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সবটা করা হয়নি। দর্শক বুঝবেন, এমনটা কি নীরজের মতো শিল্পী সব সময় আশা করতে পারেন?
গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
আরও একটি কথা, খলনায়ক হিসাবে আদিল জ়াফরের অভিনয় খুব গভীর ভাবে দাগ কাটে। সুগঠিত দেহসৌষ্ঠব, ঠান্ডা চাহনি, মারপিটের দৃশ্যে সিদ্ধহস্ত এই অভিনেতা সম্ভবত ভিন্দেশি। ভারতীয় অভিনয় মানচিত্রে এটিই তাঁর প্রথম কাজ। আশা করাই যায়, আগামী দিনে তাঁকে আরও ঘন ঘন সিনেমায় দেখা যাবে।