Bratya Basu

চালু অর্থ ছাড়িয়ে উড়ান দিল ব্রাত্য-র ‘ডিকশনারি’

ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম।আর সেই বিশাল মাধ্যমের ব্যপ্তিকে ক্রমানুসারে সাজিয়ে তার লিপিবদ্ধ রূপ হল অভিধান।

Advertisement

ইন্দ্রদত্তা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:০৭
Share:

অভিধানে কি সব শব্দের পর্যাপ্ত অর্থ মেলে?

‘একে অন্যকে ক্ষমা করার আগে, আমাদের একে অন্যকে বুঝতে হবে’ (Before we can forgive one another, we have to understand one another)- অ্যানার্কিস্ট লেখিকা এমা গোল্ডম্যানের এই উক্তি দিয়ে শুরু ব্রাত্য বসুর নতুন ছবি ‘ডিকশনারি’— সম্পর্কের অজানা অভিধান। বুদ্ধদেব গুহর ‘বাবা হওয়া’ এবং ‘স্বামী হওয়া’— এই দুই গল্পকে ভিত্তি করে পরিচালক যে ভাবে ছবি বুনেছেন, তাতে ঘুরে ফিরে উঠে এসেছে এই উক্তির গুরুত্ব। কখনও সম্পর্কের সামাজিক ও প্রথাগত সংজ্ঞাকে নতুন ভাবে নির্মাণের প্রচেষ্টার সঙ্গে, কখনও পরিবারের পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়ে।

Advertisement


ভাষা মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম।আর সেই বিশাল মাধ্যমের ব্যপ্তিকে ক্রমানুসারে সাজিয়ে তার লিপিবদ্ধ রূপ হল অভিধান। কিন্তু অভিধানে কি সব শব্দের পর্যাপ্ত অর্থ মেলে? মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে থাকে নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন— তার অনির্দিষ্ট বহিঃপ্রকাশ কতটাই বা ব্যক্ত করা যায় কিছু নির্দিষ্ট শব্দ আরোপ করে? অভিধানে বর্ণিত অর্থ আর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ অর্থের মধ্যে আসলে থেকে যায় বিস্তর ফারাক, আর এই দুই অর্থের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানেই এই ছবির অবস্থান।

ছবিতে সমান্তরালে চলে দুই পরিবারের কাহিনি। একদিকে থাকে ঢালাই ব্যবসাদার মকর ক্রান্তি চট্টোপাধ্যায় (মোশারফ করিম), তার স্ত্রী শ্রীমতি (পৌলমী বসু) ও পুত্র রাকেশ (সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়) সমেত রাজারহাটের ঝাঁ চকচকে অট্টালিকায় এক পুরোদস্তুর শহুরে জীবন। অন্যদিকে বন বিভাগের চাকরিসূত্রে পুরুলিয়ার বরাভূমের অশোক (আবির চট্টোপাধ্যায়) আর তার স্ত্রী স্মিতা (নুসরত জাহান) এবং মেয়ে চানুর প্রকৃতির কোলে নিভৃত জীবন। এই দুই পরিবারের মধ্যে এক অদ্ভুত সংযোগ হল সুমন (অর্ণ মুখোপাধ্যায়)- পারিবারিক সূত্রে শ্রীমতির ভাই, আবার পড়াশোনার সূত্রে অশোকের কলেজের জুনিয়র। বরাভূমের এক কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক সুমনের সাথে স্মিতার পরকীয়া সম্পর্ক নাড়িয়ে দেয় অশোক-স্মিতার পারিবারিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ছক, ছবিতে যোগ করে বহুমাত্রিক সম্ভাবনা।

Advertisement

ব্যবসাদার মকর ক্রান্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকায় মোশারফ করিম।

ছবি জুড়ে বারংবার কলকাতার হাই রাইজিং স্পেসের শহুরে জীবনযাত্রা, ক্লাবের মদের আসর, অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঢুকে পড়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয় বরাভূম গ্রামের নিভৃত সন্ধ্যার নিরিবিলি আখ্যান। ঠিক একই ভাবে স্মিতা-সুমনের তথাকথিত অবৈধ সম্পর্ক ঢুকে পড়ে স্মিতা-অশোকের বৈবাহিক জীবনের অশান্তির চোরাস্রোত। শহর-গ্রাম, পরকীয়া-বিবাহের মতোই স্বপ্ন আর অবচেতনের সঙ্গে এই ছবিতে ঘটে বাস্তবের সংঘাত। অশোক জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে স্বপ্নে দেখে স্মিতা ও সুমনের অন্তরঙ্গতা, আর এই সমান্তরালে চলতে থাকা অন্য এক সম্পর্কের আশঙ্কা আরো প্রকট করে দেয় তার স্বামী হওয়ার, (প্রকৃত) স্বামী হয়ে ওঠার ব্যর্থতা বোধ।

যে সমাজে নারীর মা এবং স্ত্রী হিসেবে ভূমিকাই হয় পারিবারিক মূল্যবোধের শেষ মাপকাঠি, সেখানে এই ছবি তার বিপরীতে হেঁটে উল্টে ভেঙে দেয় স্বামীর ভূমিকাকে। অভিধানে যে husband (স্বামী) শব্দের অর্থ 'a master,' বন্ধু নয়, তা অশোক লক্ষ্য করে এবং স্মিতাকে জানায়। আসলে আমরা যে ভাষায় প্রতিনিয়ত কথা বলছি, 'ভাব' প্রকাশ করছি, সেই ভাষাই আদপে পুরুষতান্ত্রিক, তাই তার নির্ধারিত সংজ্ঞাতেও স্বামীর ভূমিকা বন্ধু হতে পারে না, তা অবধারিতভাবেই হবে মালিক, কর্তা। সুমন স্বীকার করে নেয়- "একজন সত্যিকারের স্বামী হয়ে ওঠা বড্ড কঠিন," এখানেই ফিরে আসে গোল্ডম্যানের সেই উক্তি।

নুসরত এরকম অন্য ধারার ছবিতে তার স্ত্রীর চরিত্রে বেশ প্রশংসনীয়।

অভিনয়ে আবির চট্টোপাধ্যায় অশোকের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন নিখুঁত ভাবে। নুসরত এরকম অন্য ধারার ছবিতে তার স্ত্রীর চরিত্রে বেশ প্রশংসনীয়। সমাজের নিরিখে স্মিতার চরিত্র যথেষ্ট বোল্ড এবং আধুনিক। সেই দৃপ্ততার পাশাপাশি সম্পর্কের জটিলতায় অসহায় স্মিতার ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর অনায়াস অভিনয়ে।পৌলমী বসুর সঙ্গে সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়ের মা-ছেলের নিছক সারল্য ও ভালবাসার সম্পর্ক ভাল লাগে। কিন্তু সাগ্নিকের অভিনয় আরেকটু পরিণত হলে তা আরো উপভোগ করা যেত। সুমনের ভূমিকায় অর্ণ মুখোপাধ্যায় যথাযথ এবং ছোট চরিত্রে ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়ও বেশ ভাল। নজর কেড়েছেন মকর ক্রান্তির ভূমিকায় মোশারফ করিম। কলোনিয়াল (এবং ক্লাবের নিত্যদিনের মদ্যপানের) হ্যাংওভার কাটিয়ে উঠতে না পারা মকরের অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ছেলেকে ইঞ্জনিয়ার বানানোর মধ্যবিত্ত বাসনা ও ইংরেজি ভাষা বেগতিক হয়েও তা রপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা কখনও হাসির উদ্রেক করে, কখনও করুণার- সবটাই মোশারফ ব্যক্ত ক‍রেছেন সমান দক্ষতায়।

অবশেষে সকলেই শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রচলিত পারিবারিক গঠনতন্ত্রে ফিরে গেলেও, "ডিকশনারি" ভীষণ তাৎপর্য্যপূর্ণভাবে ইঙ্গিত করে সম্পর্কের এক বৃহত্তর, প্রসারিত ও উন্মুক্ত ধারণার। এই আধুনিক উপাদানটিই আমাদের নিয়ে চলে পূর্ব-নির্ধারিত সংজ্ঞার বাইরে, ভাষার বন্ধনের ঊর্ধ্বে, অভিধানের বাইরে। "ডিকশনারি" প্রচলিত অর্থকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement