পরশু হরভজনের বিয়ের এত আলো-রোশনাইয়ের মধ্যে কোথাও যেন এক টুকরো বিষণ্ণতা দেখা গেল। বীরেন্দ্র সহবাগ এসেছিল। ওকে দেখে হঠাৎ মনে পড়ল, ওর চলে যাওয়াটা পেজ ওয়ান থেকে নয়ের পাতায় সরে যেতে দেখে পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে কেমন কষ্ট পাচ্ছিলাম।
কিন্তু আমার মতো যারা ক্রিকেট রোম্যান্টিক, তাদের কাছে সহবাগের চলে যাওয়াটা অন্য কারণে বড় তাৎপর্যপূর্ণ। ওর বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন ভারতীয় ক্রিকেটের এক অসামান্য অধ্যায় শেষ হয়ে গেল। এমন একটা অধ্যায় জীবদ্দশায় আর দেখে যেতে পারব বলে মনে হয় না।
আর ওই সময়টা ‘পাণ্ডবের রাজত্ব’ বলব না তো কী বলব, একটু বলবেন! সবাই তো এক একজন মহারথী।
সচিন, রাহুল, সৌরভ, লক্ষ্মণ আর সহবাগ। সঙ্গে অবশ্যই অনিল কুম্বলে থাকবে।
পাণ্ডব যখন বললাম, তখন কে কোন জন — সেটাও নিশ্চয়ই বলা প্রয়োজন। সেই সময়ের অর্জুন অবশ্যই সাড়ে পাঁচ ফুটের রমাকান্ত আচরেকরের ছাত্র।
সচিন তেন্ডুলকর। অত ভাল কেরিয়ার, অত ফোকাস আর কোনও দিন কোনও ক্রিকেটারের হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না।
আর রাহুল? রাহুল আমার কাছে যুধিষ্ঠির। সাবধানী, রক সলিড। প্রত্যেকটা সিদ্ধান্ত ভেবে এবং মেপে নেওয়া।
জানি সৌরভের দুরন্ত ভিশন না হলে, কোনও দিন আমরা সহবাগকে টেস্ট ওপেনার হিসেবে পেতাম না। কিন্তু সেই টিমে সৌরভ আর লক্ষ্মণ আমার কাছে নকুল আর সহদেব। দু’জনেই শিল্পী। আর ভীম? প্রসেস অব এলিমিনেশনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ভীম একজনই।
নজফগড়ের বীরু।
আজ বীরেন্দ্র সহবাগের অবসরের পর যখন ওই অধ্যায়ের কথা বলছি, তখন এটাও বলি আমার বাবা দিলীপ সরদেশাইয়ের কিন্তু প্রথমবার বীরেন্দ্র সহবাগকে দেখে একদম ভাল লাগেনি। বাবা বলেছিলেন, ‘‘ইয়ে বহত হাল্লাগোল্লা ব্যাটসম্যান হ্যায়।’’
আসলে ষাট-সত্তর দশকে কোনও মুম্বই ঘরানার ব্যাটসম্যানেরই সহবাগকে ভাল লাগার কোনও কারণ নেই। কারণ সহবাগ এমন একজন ব্যাটসম্যান যার পা চলে না, যে প্রথম ওভারে অম্লানবদনে কভারের ওপর দিয়ে কাট মারে, নতুন বলে ‘অ্যাক্রস দ্য লাইন’ ফ্লিক করে।
ক্রিকেট ম্যানুয়ালের সে প্রায় কিছুই মানে না। মানা তো দূরে থাকুক, পারলে সে ক্রিকেট ম্যানুয়ালই
ছিঁড়ে ফেলে।
এমন ব্যাটসম্যান দেখে মুম্বই ঘরানা যে নাক সিঁটকোবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু তাতে সহবাগের কী?
২০০৮: চেন্নাইয়ে বিধ্বংসী সহবাগ
যদি কিছু এসে যেত, তা হলে তো আর সে সহবাগ হত না। যেহেতু ভীষণ ক্রিকেট রোম্যান্টিক, তাই অনেক সময় আমি এই পাণ্ডবদের নিয়ে নানা গল্প ভাবি। কাজের মধ্যেই ভাবি।
মনে মনে একটা পরিস্থিতির কথা অনেকবার ভেবেছি। ধরুন, সময়টা সত্তর সালের এক ভোরবেলা, লোকেশন: শিবাজি পার্ক। একে একে কিট হাতে নেটে ঢুকল পাঁচজন — সৌরভ, সচিন, সহবাগ, রাহুল আর লক্ষ্মণ। অন্য দিকে দাঁড়িয়ে মুম্বই ক্রিকেট দর্শনের তিন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর — বিজয় মার্চেন্ট, মাধব মন্ত্রী আর বাসু পরাঞ্জপে। একটু দূরে শামিয়ানাতে চা খাচ্ছেন বাবা, সুনীল গাওস্কর আর অজিত ওয়াড়েকর।
যারা অটোমেটিক চয়েস, তারা তো অবশ্যই রাহুল, সচিন, লক্ষ্মণ আর সৌরভ। কিন্তু যাকে দেখে শামিয়ানাতে হইহই শুরু হত, সেটা অবশ্যই সহবাগ।
আসলে ও রকম ব্যাটিং তো কেউ আগে দেখেনি। না তখন দেখেছে, না আজকে দেখতে পাবে। আর কী সুন্দরভাবে ‘ব্লেন্ড’ করত ব্যাটিং। সবাই আলাদা আলাদা ঘরানা। সাধে কী আর শোয়েব-পোলকদের ও রকম নাভিশ্বাস উঠে যেত!
কার কী সব ইনিংস বলুন তো! সিডনিতে লক্ষ্মণ, মেলবোর্নে বীরু, ব্রিসবেনে সৌরভ, হেডিংলেতে রাহুল আর প্রায় সব জায়গায় সচিন। এতটাই জাদু ছিল ওদের ব্যাটিংয়ে, যে দিলীপ সরদেশাই প্রথমবার দেখে বীরুকে ‘হাল্লাগোল্লা’ বলেছিলেন, সেই বাবাই মুলতানের ইনিংস দেখে আমাকে
ফোন করে জানিয়েছিলেন এমন ইনিংস আর কোনও দিন কেউ খেলতে পারবে না।
আজ সহবাগ অবসর নেওয়ার পর একটা গানও খুব মনে পড়ছে। ‘চলা যাতা হু, কিসিকে ধুন মে’।
ওই গানটাও যেন ওই প্রজন্মের ওই পাঁচজনের ব্যাটিংয়ের কথা ভেবেই লেখা হয়েছিল। সবাই আলাদা আলাদা ‘ধুন’... সবাই নিজের মেজাজে ব্যাটিং করত।
আজ টেলিভিশনের কাজের সুবাদে সেই সময়কার ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথা হয় রাহুল
দ্রাবিড়ের সঙ্গে। রাহুল সে দিন বলছিল, কী ভাবে সহবাগ ব্যাটিংয়ের
গ্রামারটাই পাল্টে দিয়েছিল ইন্ডিয়ান ড্রেসিং রুমে।
সেই সময় অনেক ক্রিকেটার টিম মিটিংয়ে বলত, প্রথম ঘণ্টাটা বোলারের আর বাকিটা ব্যাটসম্যানের।
সহবাগ নাকি সে সব কথা শুনত না। এ সব শুনলে খালি বলত, ‘‘মারার বল থাকলে আমি মারবই, সেটা দিনের প্রথম ওভার হোক কী শেষ।’’
এখানেই সৌরভের কৃতিত্বটা। অনেক ক্যাপ্টেন কী বস এ রকম ‘ফ্রি ফ্লো অব আইডিয়াজ’কে উৎসাহ দেয় না। তাদের নিজের গতে বাঁধা চিন্তাকেই মনে করে ধ্রুব সত্য।
সেখানেই সৌরভ সবার থেকে আলাদা ক্যাপ্টেন। সে সহবাগের চিন্তাকে উৎসাহ দিত, দ্রাবিড়ের রক্ষণশীলতাকে সম্মান জানাত, সচিনকে সচিনের মতো থাকতে দিত, লক্ষ্মণকে বলত না ফ্লিকটা ডেঞ্জারাস শট। এটাই সৌরভের প্রতিভা।
সেই সময়ের অনেকের সঙ্গে কথা বলে এটাও বুঝেছিলাম, সহবাগ কিন্তু অসম্ভব স্ট্রিট স্মার্ট একজন ক্রিকেটার। সেটা ওর বোলিং দেখলেই বোঝা যায়। কোন ব্যাটসম্যানের কী পছন্দ নয়, কোন ফিল্ডারকে দেখলে ব্যাটসম্যানের মেজাজ খারাপ হতে পারে — সেটা নাকি সহবাগ অনেকের থেকে ভাল বুঝত।
আসলে সৌরভ টিমটাকেই এমন ভাবে বানিয়েছিল, যেখানে সবার মনে হত — এটা আমার টিম। যে কোনও টিম স্পোর্টসের এটাই তো সর্বোচ্চ ভাবনা।
সে সময় সচিন কিন্তু চোটের কারণে অনেকটা সময় খেলতে পারেনি। আমি নিশ্চিত, সে সময় সচিনের ব্যাটিং আমাদের সবাইকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল একজনই — সহবাগ।
ও নিজের হাতে পুরো দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিল ইন্ডিয়ান ব্যাটিংয়ের। এখনও ইউটিউবে সহবাগের ফ্লিক দেখলে, ওটা সচিনের না সহবাগের বোঝা যায় না! এতটাই মিল ছিল সচিনের কিছু কিছু শটের সঙ্গে বীরুর।
আজকে যখন সেই টিমের প্রায় সবাই চলে গেল, খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে এখন ক্রিকেট।
আজ ভারতীয় টিমও খুব ভাল। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয়, ইস এখন যদি সচিন নামত।
মিড অনের দিকটা দেখলে সৌরভের হাত নাড়িয়ে ক্যাপ্টেনসিটা মিস করি। স্লিপে রাহুল আর লক্ষ্মণকে খুঁজি। ডেল স্টেইন বল করলে মনে হয় বলি, ওরে শোন, যদি সহবাগ থাকত তা হলে বুঝতিস ব্যাটিং কাকে বলে!
এই মিস করাটাই বোধহয় কোনও টিমের সবচেয়ে বড় পাওয়া... সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার...
পাণ্ডবদের রাজত্ব...