মৃণাল সেনের ‘আকালের সন্ধানে’। সে ছবি তাঁকে দাদু-দিদিমা দেখিয়েছিলেন। হয়তো কৈশোরে বেড়ে ওঠার সময়ই হবে। বয়স অল্প। প্রত্যেকটা দৃশ্য যে প্রতীক বব্বরের মনে আছে তাও নয়। তবে এটা তখনই বুঝেছিলেন যে তাঁর মা স্মিতা পাটিলের সঙ্গে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে।
আর সেই একই যোগাযোগটা তিনিও রেখে দিতে চান। সই করেছেন তাঁর কেরিয়ারের প্রথম বাংলা ছবি। মুম্বইয়ের প্রযোজক সংস্থার প্রযোজনায় প্রথম এই বাংলা ছবির নাম ‘অরণি তখন’। ছবির ইংরেজি ভার্সানের নাম ‘ট্র্রিস্ট উইথ ডেসটিনি’। সেখানে প্রতীকের সহ-অভিনেত্রী পাওলি। প্রি-প্রোডাকশন স্টেজে বারবার উঠে আসছে স্মিতা পাটিলের প্রসঙ্গ। আর তখনই স্মিতা-পুত্রের মাথায় আবার জেগে উঠছে একটা সুপ্ত বাসনা। মা-কে নিয়ে একটা ছবি পরিচালনা করতে চান প্রতীক। কারণ শুধুমাত্র পরিচালক হওয়ার শখ নয়। ছবি তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আরও ভাল করে হয়তো তিনি বুঝতে পারবেন তাঁর মা-কে।
বলিউডে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা ছবি করেছেন প্রতীক। বক্স অফিস সাফল্য না পেলেও প্রত্যেকটা ছবিতে প্রতীকের অভিনয়ের তারিফ হয়েছে। এই ছবিতে প্রতীকের চরিত্রের নাম মনসিজ। কলেজ ক্যাম্পাসের বেপরোয়া হিরো। সেখানেই তাঁর দেখা পাওলির সঙ্গে। যিনি সেই কলেজের শিক্ষিকা। যে শিক্ষিকা গুজরাতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় হারিয়েছে তাঁর হিন্দু বয়ফ্রেন্ডকে (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত)। ধীরে ধীরে পাওলির প্রেমে পড়তে থাকেন প্রতীক। কিন্তু পাওলি? প্রেম নিবেদনের পরে তিনি তো প্রতীককে সাফ জানিয়ে দেন, “শরীরটা তোমার। বাকিটা তো আমি। নিজের সঙ্গে নিজের প্রেম হয় না”।
প্রতীক কি তা হলে সেটাই মেনে নেয়? নাকি পাওলি ফিরে যায় তাঁর প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে?
জুলাই থেকে শ্যুটিং শুরু হবে কলকাতায়। তার আগে কিছুটা হবে গোধরা আর মুম্বইতেও। তবে পরিচালক সৌরভ চক্রবর্তী প্রথম থেকেই প্রতীককে সতর্ক করে দিয়েছেন, যে সেটে তিনি কোনও ‘স্ট্রার ট্যানট্রাম’ চান না, কোনও ইগো চান না। শ্যুটিংয়ের সময় একমাত্র চান অভিনেতা প্রতীককে, যাঁর মধ্যে ইলেকট্রিক স্পার্ক আছে। “বিশ্বাস করুন, আমার মধ্যে কোনও ট্যানট্রাম নেই। আমি ওই ভাবে বড়ই হইনি,” বলছেন প্রতীক। তা হলে এই যে তাঁর নামে অপবাদ দেওয়া হয় তিনি খুব মুডি? “মুডি বললে ভুল হবে না, তবে সেটা ইন আ গুড ওয়ে। একজন আর্টিস্টের মুড থাকাটাই তো স্বাভাবিক। ইগোটা ব্যবহার করি কাজের উন্নতির জন্য,” সাফ জবাব দেন প্রতীক।
এই বখাটে ছেলের চরিত্রে প্রতীককে নেওয়ার কারণ তাঁর চোখের অভিব্যক্তি। পরিচালকের ভাষায় একটা অদ্ভুত নিরাসক্তি রয়েছে প্রতীকের চোখে। হয়তো বা শূন্যতাও। ‘স্টার-কিড’ হয়েও কোথাও তো প্রতীক ওঁর জেনারেশনের স্টার কিডদের থেকে একদম আলাদা। “ডিটাচমেন্ট কথাটা আমার প্রসঙ্গে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। সৌরভদাই প্রথম এটাকে পজিটিভলি ব্যবহার করেছে,” বলেন প্রতীক। এটাও মেনে নেন যে তাঁর জীবনটা অন্যদের থেকে একেবারে ভিন্ন সুরে বাঁধা। মাকে দেখেননি। বড় হয়েছেন দাদু-দিদার কাছে। দাদু- দিদা-আর বাবা রাজ বব্বর মিলে ঠিক করেন প্রতীক বড় হবেন ফিল্মি দুনিয়া থেকে বাইরে। “আমার অতীতটা অন্যান্য তারকাদের সন্তানদের চেয়ে আলাদা। দেয়ার ওয়াজ নো রাজ বব্বর টু সে লঞ্চ হিজ সন। হয়তো বাবা তাঁর বড় ছেলে (আর্য বব্বর)-কে যে ভাবে লঞ্চ করেছিলেন আমার ক্ষেত্রেও তাই চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সবের আগেও আমি অস্থির হয়ে পড়ি। কিছু একটা করতে হবে,” স্বীকার করেন প্রতীক। আরও বলেন অন্যান্য ‘স্টার কিড’দের লঞ্চের যে প্রক্রিয়া থাকে যেটা তারকারা অনুসরণ করেন, সেটা ওঁর ক্ষেত্রে কোনও দিন হয়নি। “কেউ কোনও দিন বলতে পারবে না যেটুকু করেছি তা আমার বাবা মায়ের পদবির জোরে। মায়ের মুখ দেখিনি কোনও দিন। তবে মনে মনে শুধু মাকে বলি, মা তুমি যেখানেই থাকো, আমি যেন তোমাকে গর্বিত করতে পারি,” বলেন প্রতীক।
‘স্টার-কিড’ হওয়ার চাপ আছে কিন্তু সেটাকে প্রতীক দেখেন ইতিবাচক ভাবে। এই যেমন স্মিতা পাটিল জানতেন ন’টা ভাষা। তার মধ্যে যেমন ছিল মরাঠি আর বাংলা, ঠিক সেই ভাবেই ছিল স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ। “আমি চাই এ ছবিতে বাংলা শিখে নিজেই ডাব করতে। আমার সামনে কেউ বাংলা বললে আমি খানিকটা বুঝতে পারি। মায়ের জিন তো আমার মধ্যেও আছে। সেটার ওপর ভরসা করেই বলছি বাংলাটা শিখে নিতে পারব। ছবি শুরু হওয়ার আগে আর এক বার দেখব ‘আকালের সন্ধানে’। লোকে চাপ নিয়ে কথা বলে। তবে প্রেশারে আমি ভাল কাজ করি। এই ছবিতে পাওলি আর ইন্দ্রনীল রয়েছে। ওঁদের কাজ দেখছি। ওঁদের সঙ্গে এ ছবিতে কাজ করার অপেক্ষায় আছি।”
প্রতীকের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে পাওলি-ও দারুণ উৎসুক। “প্রতীকের করা ‘জানে তু ইয়া জানে না’, ‘দম মারো দম’, ‘ধোবিঘাট’ দেখেছি। বেশ ভাল অভিনেতা। ইনটেন্স। আর চোখগুলো খুব এক্সপ্রেসিভ। ও এই ছবিতে কাজ করছে শুনেই আমার স্মিতা পাটিলের কথা মনে এল,” বলছেন তিনি।
পাওলি কি জানেন যে প্রতীক তাঁর মাকে নিয়ে একটা ছবি পরিচালনার স্বপ্ন দেখেন? “জানতাম না। তবে যদি সত্যি করে, আমি চাইব মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করতে। একটা স্বপ্নের চরিত্র হবে আমার কাছে। স্মিতা পাটিল আমার খুব প্রিয় অভিনেত্রী। ওঁর অভিনয় আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে,” বলছেন পাওলি। আরও জানাচ্ছেন ভারতীয় সিনেমায় নায়িকা বলতে সাধারণত যা বোঝায়, তা তো স্মিতা ছিলেন না। “শ্যামবর্ণা, আনকনভেনশনাল। বিখ্যাত বাবা-মা’র মেয়েও ছিলেন না। অথচ তিনি ভারতীয় সিনেমার সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। শ্যাম বেনেগলের ‘মন্থন’ থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়ের ‘সদ্গতি’র পাশাপাশি অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে ‘নমকহালাল’ ও রমেশ সিপ্পির ‘শক্তি’ বুঝিয়ে দেয় যে, সব ধরনের সিনেমায় তিনি কতটা সাবলীল ছিলেন। এত অল্প সময়ের কেরিয়ারে বেশ কয়েকটা জাতীয় পুরস্কার আর পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন। বেঁচে থাকলে তিনি আজ নিশ্চিত ভাবে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেতেন,” বলছেন পাওলি।
অভিনেত্রীর জীবনকে নিয়ে ছবি স্মিতাও করেছিলেন। নাম ‘ভূমিকা’। সামনের মাস থেকেই পাওলি অভিনয় করবেন কেয়া চক্রবর্তীর অনুপ্রেরণায় তৈরি এক চরিত্রে। ভারতীয় সিনেমা কি অভিনেত্রীদের জীবনের আসল সঙ্কটটা ধরতে পারছে? অন্যান্য ক্রাইসিস ছাড়াও, সমাজের দ্বিচারিতার শিকার হওয়া অভিনেত্রীদের দমবন্ধ করা অবস্থাটা কি ধরছে ক্যামেরার লেন্স? “যে কোনও ছবি যদি ভাল ভাবে তৈরি হয়, তা হলে তা কালজয়ী হবে। সেই কারণে স্মিতার ‘ভূমিকা’ নিয়ে আজও কথা হয়। তা ছাড়া আরও কত দারুণ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবি করেছেন উনি। কী সব সাবজেক্ট! সেখানে দ্বিচারিতার থিমটা আছে কি না, সেটা আলোচ্য বিষয় হয় না। আমি খুশি যে আজ পর্যন্ত যে ক’টা ছবি আমি করেছি, সেগুলো চুজ করার জন্য সারা দেশ জুড়ে প্রচুর প্রশংসা পেয়েছি,” বলছেন পাওলি।
‘টেক ওয়ান’ দেখেছেন? উত্তরে বলছেন, “আমি তো মুম্বইতে ছিলাম এত দিন। ‘টেক ওয়ান’ রিলিজ করে গিয়েছে বুঝি? আমি তো ওখানে খবর পাইনি! যদি রিলিজ করে থাকে, তা হলে অল দ্য বেস্ট।”
শ্যুটিংয়ের আগে আর এক বার দেখব
‘আকালের সন্ধানে’... ইচ্ছে আছে মায়ের
মতো বাংলা শেখার
প্রতীক