টালিগঞ্জে সদ্য পা দিতে চাওয়া চিত্র পরিচালকদের এখন লক্ষ্য দুটো। এক, একজন ভাল প্রযোজক। দুই, অভিনেতা হিসেবে ওঁকে পাওয়া। কাকে? না, যে অভিনেতা ২০১৭-র জানুয়ারিতে ৮৩-তে পড়েছেন!
আরও একজন এই ‘মির্যাকল’-এর দলে। দু’-এক বছর পার করলেই ৮০ ছুঁয়ে ফেলবেন। অথচ এই ক’মাস আগে ‘বিসর্জন’ ছবিতে তাঁকে পাওয়া গেল না বলে, পরিচালক মনের দুঃখে তাঁর জন্য তুলে রাখা একটি চরিত্র পালটেই ফেললেন!
প্রথমজন যদি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হন, দ্বিতীয় জনের নাম পরান বন্দ্যোপাধ্যায়। দু’জনেই আজও বাংলা ছবির ‘পোস্টার বয়’। আজও তাঁদের সামনে রেখে ছবির গল্প লেখা হয়। সে ছবি বক্সঅফিসও কাঁপায়। এ যেন ‘এসইউভি’র জমানায় অস্টিন বা ল্যান্ডমাস্টার গাড়ির রমরমিয়ে চলা! কিন্তু কী করে এমনটা সম্ভব?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে চার নম্বর ছবি করা পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাংলা সিনেমায় একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড হলেন উনি। জানেন, ‘বেলাশেষে’ দেখে মহেশ ভ়়ট্টর মতো মানুষ বলেছিলেন, এই অন্তর্মুখী অভিনয়, যেটা সৌমিত্র করেছেন, এটা করার মতো এখন অভিনেতা পাওয়াই মুশকিল!’’
আরও পড়ুন: মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে স্বজনপোষণ চলবে না
আর পরান বন্দ্যোপাধ্যায়? ‘‘পরানদা অনেকটা পাইস হোটেলের মতো। যতই চাইনিজ, মেক্সিকান, লেবানিজ খাবারের আউটলেট থাকুক, ভাল পাইস হোটেল তার নিজের ট্র্যাকে ঠিক দৌড় জিতে নেবে,’’ বললেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।
এর সঙ্গে এও বোধহয় সত্যি, বাংলা ছবিতে ধীরে-ধীরে নায়কতন্ত্রের দিন ফুরোচ্ছে। কেউ বলেন, এই সময় যদি তুলসী চক্রবর্তী কি রবি ঘোষরা থাকতেন, শুধু ওঁদের নিয়েই রমরম করে ছবি হত। পরান আজ তাই বাংলা ছবির প্রাণ!
সৌমিত্রর আর একটি ‘এক্স ফ্যাক্টর’ওঁর কেরিয়ার গ্রাফ। সত্যজিৎ রায়কে বাদ দিলেও তপন সিংহ, মৃণাল সেনদের সঙ্গে ওঁর এক-একটি সিনেমা তো বাঙালি জীবনের এক-একটি অধ্যায়, ‘ঝিন্দের বন্দি’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ থেকে ‘আকাশকুসুম’, ‘সাত পাকে বাঁধা’... এর পর ওঁর সঙ্গে বাঙালির ‘অলটাইম লেজেন্ড’ উত্তমকুমারের দ্বৈরথ। ওঁর কবিতা। ওঁর পাঠ। ওঁর থিয়েটার। শিশির ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরীর সংসর্গ। সব মিলিয়ে দর্শকের কাছে এমন একটা ‘অ্যরা’ তৈরি করে দেয়, মনে হয় এই বয়সে ওঁর ধারে কাছে কোনও সেলিব্রিটি নেই। তাই দর্শক আজও সৌমিত্রমুখী। পরানের জায়গাটা আর এক রকম। এমন কতকগুলো শেড এনে ফেলেন তিনি, ট্রাম্পকার্ড হয়ে যায় সেগুলোই। কে ভুলবে ওঁর ‘পুলক ঘোষাল’? জটায়ুকে ‘লালু লালু’ বলে ডাক! এখানেও শোনার মতো কাহিনি আছে। শুধু পরানকে নেবেন বলে সত্যজিতের গল্পে পুলকের যা বয়স, সেখানেই কোপ বসিয়ে প্রচণ্ড সমালোচিত হয়েও শেষমেশ বাজি জেতার কথা বলছিলেন পরিচালক সন্দীপ রায়।
ছোট্ট-ছোট্ট ‘দান’ ফেলে কীভাবে খেলাটাকে নিজের করে ফেলতে হয়, তা পরানের ‘সিনেমাওয়ালা’, ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ কি ‘তারিণীখুড়ো’ জবরদস্ত উদাহরণ। দর্শক তো বারে-বারে প্রেমে পড়েন এই ‘দান’গুলোতেই।
সৌমিত্রর আবার আর একটি দিক হল প্রাণান্তকর ইচ্ছে। নইলে নওয়াজউদ্দিন বা ইরফানের অভিনয় দেখে কেন বলেন, ‘‘আহা, ঈর্ষা হয় ওদের দেখে, কী অভিনয়!’’ ‘আমর’ দেখেই বা কেন বলবেন, ‘‘এ ছবি বাংলায় হলে আমি তো করতেই পারতাম!’’ শুধু ইচ্ছে নয়, তার সঙ্গে ‘আপডেট’ থাকা, এই সব তথ্য জুগিয়ে নির্দেশক সুমন ঘোষ বললেন, ‘‘পসিবলি দ্য লাস্ট লেজেন্ড।’’
অতি অল্প ব্রাশ স্ট্রোকে যেমন দড় চিত্রকর ভাবনার দিগন্ত খুলে দিতে পারেন, সৌমিত্র তেমনই। এ সব ক্ষেত্রে কী যে ‘ইনোভেটিভ’ তিনি! সুখস্ম়ৃতির কথা ‘রূপকথা নয়’-এর পরিচালক অতনু ঘোষের গলায়, ‘‘একটি দৃশ্য ছিল, এক বৃদ্ধ মগ্ন হয়ে মৃতা স্ত্রীর ছবি হাতে বসে। এ সময় দরজায় টোকা। বৃদ্ধর তো আনমনা হয়ে কপাট খোলার কথা। উনি সাজেশন দিলেন, ‘যদি বিরক্তি নিয়ে খুলি? আসলে অতীতই তো এখানে বৃদ্ধের প্রাচুর্য, তার শ্বাসপ্রশ্বাস। বর্তমানটা উদ্বৃত্তের মতো।’ ‘হ্যাঁ’ বলাতে করলেন, দর্শকও দুরন্ত নিল।’’
‘সেরিব্রাল’ অভিনয় পরানেরও বড় তাস। বলেন, ‘‘কিশোরবেলায় থিয়েটার আমায় এই তাসের সন্ধান দিয়েছে। আর জীবনের বিরাট একটা দেখা তো আছেই।’’
ছ’মাস বয়সে মা-হারা। পিসির কাছে বড় হওয়া। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর পাশে না থেকে থিয়েটারে যাওয়া। পরানের এই যে জীবন, সেখানে যে গল্পের ভাঁড়ার, তাতে অনায়াসে নাকি ‘পরান রচনাবলি’ হয়ে যায়! তার সঙ্গে চরিত্র বুননের এক আশ্চর্য ‘তরিকা’ ঠিক করে দেয়। দেয় আত্মপ্রত্যয়ও। এ সবের মিলমিশে আটাত্তরের যুবক যখন ‘চরিত্র’ গড়েন, তা যে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা হবে, তা আর বলতে হয়? ছবিতে দর্শক এমন ‘পরান’ই চায়!
সৌমিত্র-পরানের কমন ফ্যাক্টর কী? দুর্ধর্ষ টিমম্যান। যে ভাবে সৌমিত্র উৎসাহ দেন বয়সে ছোট অভিনেতাদের, কাজের স্পিরিটটাই অন্য স্তরে পৌঁছে যায়। আর পরান? ইউনিটে উনি থাকা মানেই বাড়তি গল্পের আকর। বাড়তি অক্সিজেন। দম ফাটানো হাসি।
এঁদেরই তো লিডারশিপ-এ থাকার কথা। তাই ওঁরাই ‘পোস্টারবয়’! বয়স ওঁদের কাছে সংখ্যা মাত্র, মনে ভরা বসন্ত। এই জোড়া বসন্তই আজ বাংলা ছবির বক্স!