তাপস দাস । ছবি: সংগৃহীত।
১৯৭৫ সালে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ যখন তৈরি হয়, তারও আগে থেকে এই ব্যান্ডটির সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন সবে গানগুলি তৈরি হচ্ছে। তখন থেকেই চিনি বাপিদাকে। আজ, বাপিদার চলে যাওয়ার খবর পেয়ে সে সব সময়ের কথাই মনে পড়ছে।
সে সময়ে শহরে ব্যান্ডের গানের চর্চা তেমন ভাবে ছিল না। আমি এবং আমার কয়েক জন বন্ধু গৌতমদাদের গান শুনতাম। তখন আমার বয়স ১৪-১৫ বছর হবে। সে থেকেই আমার ভায়োলিনের প্রতি ভালবাসা। দুই বন্ধুর সঙ্গে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’-র গানও গাইতাম। তখন শো করতাম অনেক জায়গায়। সে সূত্রেই সঙ্গে গৌতমদা এবং বাপিদার পরিচয়। গান তৈরি হওয়ার সময় থেকেই আমরা অনেক বেশি ওঁদের কাছাকাছি ছিলাম। কারণ, আমার বন্ধুদের দাদা-কাকারা যুক্ত ছিলেন। সে সময়ে যে হেতু দর্শকের মধ্যে চর্চা কম ছিল, তখন আমরা নিজেরা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ডিস্ক নিয়ে গিয়ে বিক্রি করারও চেষ্টা করেছি। পরবর্তী কালে টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে আমাদের আড্ডা বসত। গৌতমদা, বাপিদাও আসতেন।
বাপিদার চলে যাওয়ার খবর শোনার পর থেকে বার বার ওই সব কথাই মনে পড়ছে। আমি হয়তো কখনও সরাসরি এই ব্যান্ডটার সঙ্গে যুক্ত হইনি, কিন্তু ওঁরা দু’জনেই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার গান শোনার পর গৌতমদার খুব ভাল লেগেছিল। সে সময়ে তাঁরা নাটক করতেন সদর স্ট্রিটে একটি বাড়ির নীচে। সে এক সত্যিই অন্য সময় ছিল। একটা সময় ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সকলে একে একে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। আসলে তখন শুধু গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন ছিল। তাই দোষও দেওয়া যায় না। বাপিদা ছিলেন গৌতমদার তেমন সঙ্গী, যিনি তাঁকে ছেড়ে যাননি। আসলেও বাপিদাও তেমনই ছিলেন। আর্থিক ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া যে যায়, সে সব কিছু বুঝতেন না। চাইলে কিন্তু অনেক ভাবে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারতেন। মিউজিক নিয়ে অসম্ভব ভাল ধারণা ছিল তাঁর। দারুণ লিখতেনও। ইচ্ছে করলে কি তিনি অনেক দর হাঁকাতে পারতেন না! নিশ্চয়ই পারতেন। করেননি।
আমার গান শুনে কিন্তু সব সময়ে ফোন করতেন। ভাল লাগলে যেমন বলতেন, তেমন আবার খারাপ লাগলেও নিজের যেটা মনে হয়েছে, সেটা বলতেন। ‘লক্ষ্মীছাড়া’ নামক একটি সিনেমা তৈরি হওয়ার কথা ছিল। যে ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন গৌতমদা। আর পরিচালক ছিলেন বাপিদা। সলিল চৌধুরীর স্টুডিয়োয় গানের রেকর্ডিং হয়েছিল। আমাকে বলেছিলেন সহযোগী হিসাবে কাজ করতে। আমিও সেই ছবিতে বাপিদার সহযোগী পরিচালক হিসাবে কাজ করেছিলাম।
বাপিদা অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত আমার সঙ্গে ভাল যোগাযোগ ছিল। কিন্তু মাঝে খুব বেশি যোগাযোগে থাকতে পারিনি। সকালবেলা বাপিদার মৃত্যুর খবরটা পাওয়ার পর থেকে কত কত স্মৃতি ফিরে আসছে। আসলে আমার বড় হওয়াটাও তো ওঁদের ঘিরে।
ইদানীং যখন পুরনো মানুষদের চলে যাওয়ার খবর পাই, সবটা কেমন থমথমে হয়ে যায়। বয়স হলে চলে যেতে হয়। কিন্তু সব চলে যাওয়া কি মেনে নেওয়া সম্ভব? একটা কথা সকাল থেকে বড় মোচড় দিচ্ছে। মাঝে বেশ কিছু কাজ চলে আসার কারণে বাপিদার সঙ্গে তেমন ভাবে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে সেই কথাই মনে পড়ছে আর বেদনা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেন যোগাযোগ রাখলাম না!