দিল্লি ও তার সংলগ্ন এলাকায় লুকিয়ে থাকা অপরাধের হাড় হিম করা চিত্রায়ন ছিল অনুষ্কা শর্মা প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘এনএইচটেন’। অভিনেত্রীর প্রযোজনা সংস্থার প্রথম ওয়েব সিরিজ় ‘পাতাল লোক’-এ সেই উত্তর-পূর্ব ভারতীয় বেল্টের ভৌগোলিক পরিধি আরও বড় করা হয়েছে। দিল্লি, পঞ্জাব, চিত্রকূট (বুন্দেলখণ্ড), লখনউ, কলকাতা... সর্বোপরি, বৃহত্তর ভারতে নরকের ঠিকানা (হিন্দি প্রতিশব্দ পাতাললোক) ভূগোলের গণ্ডিতে আর আবদ্ধ নেই। স্বর্গ-নরকের ভাঙাগড়ার খেলায় মঞ্চ সাজিয়ে আসর জমাচ্ছে মানুষের মন, তার কর্ম এবং পচে-গলে যাওয়া সিস্টেম।
যে ধরনের দেশীয় কনটেন্ট ওয়েবের পর্দায় বাজিমাত করছে, ‘পাতাল লোক’-এ তার সব উপাদান মজুত। তবু চিত্রনাট্যের বুনন ও গল্প বলার কায়দার নিরিখে, ‘সেক্রেড গেমস’ সিজ়ন ওয়ানের চেয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে এটি উৎকৃষ্ট, ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর সমতুল্য হলেও নিজ গুণে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রথম এপিসোডের গতিবিধি দেখে একটু ক্লিশে মনে হতে পারে। তবে দ্বিতীয় পর্ব থেকে ইনস্পেক্টর হাতি রাম চৌধুরী ও অন্য চরিত্ররা আপনাকে বুঁদ করে ফেলবে।
এই সিরিজ়ের শুরুতে কোনও খুন হয় না। বরং চার সন্দেহভাজনকে খুনের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশের দুঁদে অফিসারেরা। হিট লিস্টে প্রাইম-টাইম সাংবাদিক সঞ্জীব মেহরা (নীরজ কবি)। যমুনাপার থানার (যাকে সিরিজ়ের শুরুতেই নরকের সঙ্গে তুলনা করা হয়) সাধারণ ইনস্পেক্টর হাতি রাম চৌধুরীকে (জয়দীপ অহলওয়াত) দেওয়া হয় হাই-প্রোফাইল মামলার ভার। কিন্তু তার হাত থেকে মামলা চলে যায় সিবিআইয়ের কোর্টে। অভিযুক্তদের গায়ে এঁটে যায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীদের তকমা। সত্যিটা কী?
পাতাল লোক
(ওয়েব সিরিজ়)
পরিচালনা: অবিনাশ অরুণ, প্রসিত রায়
অভিনয়: জয়দীপ, নীরজ, অভিষেক, ইশক, জগজিৎ
৭/১০
ধর্মের নামে রক্তপাত, উচ্চবর্ণের অত্যাচার, জাত ও জাতিভেদে বৈষম্য, হিংসা, সমকালীন রাজনীতির ঘোলা জল, ইসলামোফোবিয়া...সবটাই আগে দেখেছেন ওয়েবের দর্শক। তবে ‘পাতাল লোক’-এর সার্থকতা, কোনও উপাদানকেই শুধু দেখানোর জন্য দেখানো হয়নি। বরং গল্প ও চরিত্রায়নের সঙ্গে এর যোগ নিবিড়। এই চেনা উপাদানগুলির সঙ্গে সংবাদমাধ্যম ও তার অন্তর্নিহিত রাজনীতিকেও যথাযথ ভাবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ‘সেক্রেড গেমস’, ‘অসুর’ বা ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর মতো গতি ‘পাতাল লোক’-এর নয়। কিন্তু গল্প বলার সুতোয় কখনও টান পড়েনি। শেষটা অনুমেয় হলেও, এই নরকযাত্রার প্রতিটি সিঁড়িতে রয়েছে জার্নির বিভীষিকাময় আনন্দ।
দর্শকের এই আনন্দের কান্ডারি হাতি রামের চরিত্রে জয়দীপ। এক কথায়, অনবদ্য। শরীরী ভাষা ও চোখের চাহনিতে তিনি সিরিজ়ের তাবড় অভিনেতাদের ছাপিয়ে গিয়েছেন। সঞ্জীবের চরিত্রে নীরজ কবি পরিশীলিত, স্মার্ট, ঝকঝকে। সিরিজ়ের আর এক স্তম্ভ হাতোড়া ত্যাগীর চরিত্রে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘টাইপরাইটার’-এর পরে আরও এক বার নেগেটিভ চরিত্রে তিনি স্পট-অন। অন্য অভিযুক্তদের চরিত্রে জগজিৎ সান্ধু (তোপ সিংহ), নীহারিকা লাইরা দত্ত (চিনি), আসিফ খান (করিম) দারুণ। জয়দীপের স্ত্রীর চরিত্রে গুল পনাগ যথাযথ। আনসারির চরিত্রে ইশক সিংহও নজর কেড়েছেন। বাঙালি শিল্পীদের মধ্যে স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় এবং অনিন্দিতা বসুও নিজ চরিত্রে মনে রাখার মতো।
এই সিরিজ়ের ক্রিয়েটর ‘এনএইচটেন’ ও ‘উড়তা পঞ্জাব’ খ্যাত লেখক সুদীপ শর্মা। সাহায্য করেছেন হার্দিক মেহতা, গুঞ্জিত চোপড়া, সাগর হাভেলি। চিত্রনাট্যে অবদান রয়েছে ‘এনএইচটেন’-এর পরিচালক নবদীপ সিংহেরও। তাই ওই ছবির ছায়া সিরিজ়ে বেশ জোরালো। সিরিজ়ের পরিচালক ‘পরি’খ্যাত প্রসিত রায় এবং ‘দৃশ্যম’, ‘মাদারি’ ছবির সিনেম্যাটোগ্রাফার অবিনাশ অরুণ। সিরিজ়ে আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার পরিমিত কিন্তু যথাযথ। কয়েকটি সংলাপও মনে রাখার মতো।
বৃহত্তর রাজনীতির পাশাপাশি গার্হস্থ রাজনীতিও সিরিজ়ে গুরুত্ব পেয়েছে। দিল্লির নাবালকদের মনে হিংসা ও যৌনতা নিয়ে অদম্য কৌতূহল, বাবা-ছেলের পারস্পরিক টানাপড়েন (এই ধরনের সিরিজ়ের একটি চেনা ট্রোপ) সবটাই রয়েছে। এখানে স্বামীর থাপ্পড়ের পাল্টা স্ত্রী-ও মারতে জানে। আর গুরুত্ব পেয়েছে সারমেয়, যা প্লট পরিবর্তনের অনুঘটকও বটে। যুধিষ্ঠিরের স্বর্গযাত্রার সফরসঙ্গী কুকুর ‘পাতাল লোক’-এ এক খুনির সম্বল, এক নারীর না-জন্মানো সন্তানের পরিপূরক আবার এক বিগশটের রক্ষাকর্তাও।
স্বর্গ-নরক আসলে তো নামের রূপভেদ মাত্র!
আরও পড়ুন: আকাশলীনা