পর্ণমোচী ছবির একটি দৃশ্য।
পর্ণমোচীর মতো ছবি রিভিউ করা একটু শক্ত! সব কিছু খোলতাই করে বলা যায় না। না, পর্ণমোচী হয়তো খাতায়-কলমে থ্রিলার ছবি নয়, তবু এই ছবির শেষটুকু বলা বারণ। একটা থ্রিলার ছবির রিভিউ লেখার সব ঠাটবাট, নিয়মকানুন এই ছবিতে অ্যাপ্লাই না করলে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার মজাটাই মাটি হয়ে যেতে পারে। থ্রিলার ছবির মতোই পর্ণমোচীও ‘শেষসর্বস্ব’ ছবি কিনা!
‘এসেছিলে তবু আস নাই’-এর মতো থ্রিলারধর্মী এই ‘শেষটুকু সব’ গোছের ছবি বানানো কিন্তু মুখের কথা নয়! তার চেয়ে একটা থ্রিলার ‘নামিয়ে’ দেওয়া অনেক সহজ। খুনখারাপি বা চুরি-ছিনতাই কে করল বা কী ভাবে করল সারা ক্ষণ ধরে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে কচকচালেই একটা টান টান থ্রিলার বানিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু ওই একই ফর্মুলা যদি পর্ণমোচীর মতো ছবিতেও কেউ অ্যাপ্লাই করে বসে তখনই কেলো! আর এখানেই এক জন রিভিউয়ার আর পরিচালকের মধ্যে বিভাজনরেখাটা জোরদার হচ্ছে। কী রকম জোরদার? পর্ণমোচীর মতো ছবি রিভিউ করার সময় থ্রিলার ছবির রিভিউ লেখার ফর্মুলা হুবহু অ্যাপ্লাই করলে ছবিটাকে যেমন বাঁচানো যায়, তেমন এই ধরনের ছবি বানানোর সময় কেউ যদি থ্রিলার ছবির ফর্মলা হুবহু আপ্ল্যাই করে তা হলে ছবিটাকে খুনও করা হয়! কৌশিক কর মানে পর্ণমোচীর পরিচালক এই ভুলটাই করেছেন।
আগেই বলেছি, পর্ণমোচীর শেষে চরম ধাক্কা। ওই ‘ধাক্কা’টা নিয়েই একটা গোটা ছবি বানিয়ে ফেলা যায়। একটা সাইকোলজিক্যাল অ্যানালিসিস-এর মধ্যে দিয়ে নতুন কোনও ভাবনায় আমাদের ভাবাতেই পারতেন কৌশিক। কিন্তু, কৌশিক সেই পথে হাঁটেননি। ওই ‘ধাক্কা’টুকুকেই তরুপের তাস করতে চেয়েছেন উনি। স্রেফ একটা ‘শক’ বা চমক হিসাবেই ধাক্কাটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তা ভাল কথা। এতে দোষের কিছু নেই। বেশ করেছেন! অত তত্ত্বের কচকচানিতে যাননি। কিন্তু, কৌশিক ভুল যেটা করলেন, একই জিনিস নিয়ে থ্রিলার ছবির মতোই ইনিয়েবিনিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে গেলেন। থ্রিলারের ক্ষেত্রে ঘ্যানঘ্যান লাগে না। কারণ ‘কে করল’ বা ‘কী ভাবে করল’— সেটা জানার একটা কৌতূহল থাকে। কিন্তু এই ধরনের ছবিতে তো ওই রকম কৌতূহল তৈরি হওয়ার কোনও স্কোপ নেই! তাই ছবি জুড়ে সবাই সেক্স-কাতরতায় কাতরালে বা সব ঘটনাই সেক্স-নিৰ্ভর হলে ওটা একটু ঘ্যানঘ্যানানিই লাগে।
পর্ণমোচীর বিষয় কিন্তু বেশ জোরালো। বয়ঃসন্ধিতে এক জন ছেলের সেক্স নিয়ে নানা রকম যে সব কৌতূহল বা তা নিয়ে অহেতুক পাপবোধ থাকে, তা নিয়ে গল্প ফেঁদেছেন কৌশিক। বয়ঃসন্ধির ছেলেটি হল অনল মানে ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। এই বয়সের ছেলেরা লুকিয়ে লুকিয়ে যা যা করে আরকি— ওই ফোনে পর্ন দেখা, স্কুলে ধরা পড়ে মায়ের কাছে বেধড়ক বকুনি খাওয়া, পাড়ার বখাটে দাদার কাছে গিয়ে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়া— সবই কৌশিক রেখেছেন। কিন্তু এই সব তো দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত! কৌশিক গল্পটা আর একটু রসালো করতে গিয়ে যে সব চরিত্র আনলেন, মানে পুলিশ ইন্সপেক্টর (শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়), স্কুল টিচারদের একটা দল। ও মা! তারাও সারা ছবি জুড়ে হয় সেক্স নিয়ে কথা বলছে (আর যেন তাদের কোনও কথা বলার টপিক নেই!) নয়তো বাড়ি এসে ল্যাপটপ চালিয়ে পর্ন দেখছে! আর কারওর যেন কিচ্ছুটি করার নেই!
আরও পড়ুন
মুভি রিভিউ: কনটেন্টের থেকেও ‘ব্ল্যাকমেল’-এর সম্পদ ক্রাফট
এই ছবি ঋতব্রতর। আর ঋতব্রত সেটা প্রতি পদে পদে প্রমাণ করলেন।
কিন্তু, কৌশিক শেষ চমকটুকু দারুণ ভাবে সাজিয়েছেন। পানসে ঘটনাগুলো দেখতে দেখতে আপনি যখন ক্লান্ত তখন ওই ‘ধাক্কা’ পালে বাতাস লাগার মতো। কৌশিকের কাছে একটাই অভিযোগ, শেষটুকু এত তরতাজা জোরদার ভাবতে পারলেন! অথচ ওই ‘শেষটুকু’তে পৌঁছতে সেই ঘুণধরা, লড়ঝড়ে মইটাই ব্যবহার করলেন!! আচ্ছা কৌশিক, কনীনিকা-শান্তিলালকে এক বারের জন্যও কেন বিছানার বাইরে ওঁদের দেখা করালেন না? ‘পানুদার’ ঘর অমন উদ্ভট কেন? কেন কেবল তিন জন স্কুল টিচারই একই জায়গায় বসে কেবল একই কথা কপচে যায়? আচ্ছা,অনলের বাবা যখন থার্ড ইয়ারে পড়তেন, তখন মোবাইল ফোন কোথায় এই ধরাতে? কৌশিক আপনি মিথ ভাঙলেন! ওই যে আমরা বলি ‘শেষ ভাল যার সব ভাল তার’! এই মিথ আপনি খান খান করলেন!
এই ছবি ঋতব্রতর। আর ঋতব্রত সেটা প্রতি পদে পদে প্রমাণ করলেন। বাকিরা মানে কনীনিকা, শান্তিলাল মুখিপাধ্যায়,অনিন্দ্যপুলক সবাই যেমন ভাল অভিনয় করেন, তেমনই করেছেন। এই ছবির কয়েকটা ডায়ালগ বেশ ইন্টেলিজেন্ট! যেমন ‘তোর ক জিবি?আমার দীর্ঘজীবী’ বা ‘অনল’-এর ইংরেজি স্পেলিং যে ‘অ্যানাল’— এই রকম বেশ কয়েকটি ডায়ালগ রিলিফ দেয়। তবে এই ছবি কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোটিফ-দুষ্ট দোষে ভুগেছে। মাঝে মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর জগঝম্প মনে হয়। গানগুলো মোটেই দাগ কাটে না।
ছবির শেষে বাবা ছেলেকে বলে ‘পর্ণমোচী মানে জানিস? যে গাছ পুরনো পাতা ঝরিয়ে আবার নতুন পাতার জন্ম দিয়ে সেজে ওঠে।” কিন্ত পর্ণমোচী আমাদের নতুন কোনও ভাবনায় ভাবাল কি?