পরিচালক- অনীক দত্ত
অভিনয়ে- সব্যসাচী চক্রবর্তী, বরুণ চন্দ, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, কৌশিক সেন
অভূতপূর্ব ভূত আর ভূতপূর্ব মানুষের ছবি ‘ভবিষ্যতের ভূত’।
রাজনীতি, বিনোদন, মিডিয়া, সমাজ— চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার গল্প দিয়ে ভবিষ্যতের ভূত দেখালেন অনীক। প্রথম থেকেই এই ভূতেদের দেখার চেয়ে তাদের সংলাপ দর্শকদের মন ধরে রাখে। নাহ্, এ ছবি পপকর্ন খেতে খেতে ফেসবুক স্টেটাস ঝালাতে ঝালাতে দেখলে একেবারেই চলবে না। বারে বারে চমকে দেওয়া জোরালো সংলাপ ‘বাজার’গরম করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
কী হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে? আজ কী হচ্ছে সেখানে? সমাজে? সংস্কৃতির আঙিনায়? মাচা থেকে মঞ্চ, কিছুই বাদ পড়েনি এই ছবি থেকে। দর্শক মনে সংলাপের ঝড় তুলে মানুষের চোখ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক অনীক দত্ত।
পরিচালক বুঝিয়ে দিয়েছেন, কিছু মানুষ তাদের কাজ, চিন্তাভাবনা বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য জীবিত অবস্থাতেই কোণঠাসা হয়ে যায়। এক জন টাইপিস্ট এই কম্পিউটারের যুগে কী করবে? ক্যাবারে ডান্সারদের কী হবে? ওল্ড স্কুল মার্কসিস্টদের ধুতির কোচায় টান পড়েছে! মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি বলতে এককালে যা বোঝাত, তা-ও আজ অবলুপ্ত। এরা সবাই জীবিত ভূত!
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: গালি বয় বিশ্বাস ফেরায় জীবনে, ভালবাসায়
আপাদমস্তক এন্টারটেনমেন্টের মোড়কের এই ছবি। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলকে আক্রমণ করার জন্য যে অনীক এই ছবি তৈরি করেছেন তা একেবারেই নয়। সমাজে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা খুব গভীরভাবে না দেখে আমরা ‘স্বাভাবিক’তকমা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাই। এই পাশ কাটিয়ে যাওয়া, নিজের আখের গোছানো মানুষ তাঁর ছবির আক্রমণের বিষয়। এই বিষয়ের আওতায় রাজনৈতিক স্ক্যাম, গুন্ডারাজ থেকে সাংবাদিকতায় টাকা নিয়ে খবর তৈরির বিষয়ও বাদ যায়নি। ধর্ষণ থেকে কালো টাকার বর্ষণ। ক্যাবারে থেকে আইটেম নম্বর বি।ফ্লেক্স থেকে সেক্সের রাজনীতি— সব এই ছবির বোধিতে। সবের ইতিহাস ছুঁয়ে গেছে এই ছবি।
এই ছবিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন অনীক দত্ত, যে মানুষ শাসক, ক্ষমতা বা সমসাময়িক সিস্টেমের দিকে আঙুল তুলেছে সেই মানুষ অবশেষে ভূতে বিলীন হয়েছে। এই বিলীন হয়ে যাওয়া ভূতের দল বাসা বেঁধেছে এক পরিত্যক্ত সিনেমা হলে। ভূত হলে কী হবে? তাদের রক্ত আজও গরম! বামপন্থী নেতা ভূত যেমন শ্রেণি সংগ্রাম, মার্কস-এর নাম শুনলেই লাফিয়ে ওঠেন, অন্য দিকে ক্যাবারে ডান্সার রূপালি ভূত সেজে হারানো যৌবন ফিরে পেয়ে সুন্দর পুরুষ দেখলে ঢলে পড়ে। আছে যাদবপুরীয়‘হোক কলরব’-এর যুব নেতা। তার মাধ্যমেই পরিচালক ভূতেদের সাহায্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোটের পরিকল্পনা করেন ছবিতে।
মানুষ অবশেষে ভূতে বিলীন হয়েছে।
রিয়্যাল আর ভার্চুয়ালের বাইরে অবশেষে ভূতেরা একটা জায়গা খুঁজে পেল...সেটা কী? আর সেখানে থাকতে গিয়ে কী হল, সেই টুইস্টটা নিজের চোখে দেখে আসুন। হাসুন। ভাবুন। এই ভাবনার জন্যও মানুষ নয়, ভূতেদের কাজে লাগালেন পরিচালক।
সিক্যুয়েল না হলেও ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর নস্টালজিয়ায় চঞ্চল হয়ে ওঠে দর্শক চঞ্চলা ‘কদলীবালা’-কে দেখে। সুন্দরী স্বস্তিকার রেট্রো ভঙ্গিমা মন ভোলাবে দর্শকদের।
ইন্ডাস্ট্রির সব জোরালো অভিনেতার ভিড় এই ছবিতে। বস্তুত, এ ছবিতে বহুমুখ! এই বহুমুখী প্রতিভার উপস্থিতি মাঝে মাঝে ‘ভিড়’ হিসেবে দর্শকের সামনে এসে পড়ছিল। চরিত্র কি একটু কমানো যেত? মন দিয়ে না দেখলে একটু গুলিয়ে ফেলার আশঙ্কা থেকে যেতে পারে।
আরও পড়ুন, ‘ফাইনালি ভালোবাসা’: এ ছবি দেখবেন না তো কোন ছবি দেখবেন?
তবে, স্বল্প পরিসরে হলেও পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে খরাজ মুখোপাধ্যায় স্যাট্যায়ারের ফর্মে মানুষের মনে ঘা দিয়ে গেছেন। কৌশিক সেন আর সুমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় ছবিকে আরও সজীব করে তুলেছে। লাস্যে আর হাস্য চান্দ্রেয়ী ঘোষ মনকাড়া। ভূত নয়, মানুষও তাঁর প্রেমে পড়বে আবার।
পরমা, নিকিতা গাঁধীর মতো শিল্পীরা সুরে মাতিয়েছেন ভূতের ছবি।কাঞ্চন মল্লিকও প্রথম বার প্লেব্যাক করেছেন। চমৎকার সেই গান!
ভূতেরা যখন সমস্বরে ‘আমরা সবাই রাজা’র সুরে ‘আমরা সবাই বাতিল’গেয়ে ওঠে তখন মনে হয় মানুষ নয়, ভূতের ভবিষ্যৎও নয়। ভবিষ্যতের ভূতেরাই বাংলার মাটিতে মানবায়ন ঘটাবে।
‘‘বাংলার আপামর অশরীরী আত্মা ও প্রিয় ভূত-পেত্নীগণ, আমাদের বেঁচে থাকাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’’সব্যসাচী চক্রবর্তীর এই বক্তব্য দিয়ে যে ছবির শুরু, সে ছবির শেষেও সংলাপে নেশা লেগে যায়।
মনে হয় আর একবার দেখি সংলাপের জন্য। চরিত্রকে ছাপিয়ে সংলাপ ছবির ক্যানভাস মজবুত করেছে। অনীক দত্তের সঙ্গে চিত্রনাট্যকার উৎসব মুখোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ বাংলার জার্গনকে এ ভাবে ছবিতে নিয়ে আসার জন্য।
মানুষ এই দুনিয়ায় নিজেদের ভয় পায় না। অপরাধের তোয়াক্কা করে না। ‘ভগবান’-কে ভয় পায় না।
এ বার হয়তো মৃত ভূতেদের ভয় পাবে!
(মুভি ট্রেলার থেকে টাটকা মুভি রিভিউ - রুপোলি পর্দার সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদন বিভাগ।)