বাবা-ছেলের রসায়ন জমল কি?

এক-একটা ছবি থাকে, গল্পটা ঝট করে বলে ফেলা যায় না, বরং নির্মাণের মুনশিয়ানাই দর্শককে পেড়ে ফেলে। অতনু ঘোষের এই ছবিও সেই গোত্রে পড়তে পারত। কিন্তু সহজ ছকের শ্যাওলায় পা দিয়ে পিছলে গেল।

Advertisement

সোমেশ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:০১
Share:

নদীর নাম নিয়ে বাংলা ছবি কম হয়নি। গঙ্গা, পদ্মা, তিতাস, সুবর্ণরেখা, তিস্তা— হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

এ বার ময়ূরাক্ষী। নদীর নামে ছবি। অবিশ্যি ছবিতে নদী নেই।

এক-একটা ছবি থাকে, গল্পটা ঝট করে বলে ফেলা যায় না, বরং নির্মাণের মুনশিয়ানাই দর্শককে পেড়ে ফেলে। অতনু ঘোষের এই ছবিও সেই গোত্রে পড়তে পারত। কিন্তু সহজ ছকের শ্যাওলায় পা দিয়ে পিছলে গেল।

Advertisement

অশীতিপর বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে শিকাগো থেকে দেশে ফিরেছে মাঝবয়সি আর্যনীল। ইতিহাসের অধ্যাপক সুশোভনের স্মৃতি ফিকে। দূর অতীত, দর্শনের তরঙ্গভঙ্গ, সংগীতের চলন মনে রাখতে পারে। কিন্তু রোজকার ছাপোষা কথা গুলিয়ে যাচ্ছে। স্ত্রী গত হয়েছে। দেখভালের দায়িত্বে পুরনো চাকর আর এজেন্সি থেকে নেওয়া হাউসকিপার তরুণী। তারাই সামলাচ্ছিল ব্যাঙ্ক থেকে ডাক্তার, সব। এখন আর সামলানো যাচ্ছে না। তাই ছেলের আসা।

এই অবধি সব ঠিকঠাক। স্মৃতি অগোছালো হলেও ছেলেকে দেখে দিব্যি চিনতে পারে সুশোভন। ভাবে, এক কালে রঞ্জি খেলা ছেলে এই বুঝি ম্যাচ হেরে ফিরল। তবে তাতে বাপ-ছেলের রসায়ন নষ্ট হয় না। বরং স্মৃতি-বিস্মৃতির আলো-আঁধারে স্থানকাল ঘেঁটে গিয়ে অন্য একটা স্পেস আপনিই তৈরি হতে থাকে। তৈরি হয় মনে রাখার মতো বেশ কিছু মুহূর্তও। কাফেতে কথামগ্ন তরুণ-তরুণীকে দেখে সুশোভন যখন বলে, ফিল্মের মতো জীবনেও মাঝেমধ্যে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বেজে ওঠা উচিত— বলেই গলায় তুলে আনে সিম্ফনি উথলানো সুর, দৃশ্যটা ভোলার নয়। সিম্ফনির শেষে যখন সে চেয়ারের পাশে নামিয়ে রাখে অদৃশ্য ভায়োলিন, দর্শক মাত।

গোল বাধে অন্যত্র। তার প্রথমটা ইদানীংকার ঘরবন্দি বাংলা ছবির চেনা রোগ— ইতিউতি চটকদার নাম বা জ্ঞান গুঁজে দেওয়া। নিয়ত দুঃসংবাদবাহী খবরের কাগজের প্রতি সুশোভনের বিতৃষ্ণা পরিষ্কার। কিন্তু কেন যে সে ইটের কুচি তুলে ঘরের দেওয়ালে ‘পাওয়ার অব লাভ’ আর ‘লাভ অব পাওয়ার’ লিখে উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোনের বস্তাপচা উক্তি আওড়ায়, তা বোঝা দুষ্কর। তার এমন অভ্যেসের ইঙ্গিত আগে-পরে আর কোথাও নেই। পলিটিক্সও আর ফেরে না সে ভাবে। ফলে চমক হয়েই রয়ে যায় এই প্রয়োগ, বুনোটে মেশে না।

আরও পড়ুন: ‘স্মার্ট’ মোড়কে নয়া জঙ্গল-সফর

ঘোঁট পাকে মূল বিগ্রহ ঘিরে বাঁধা চালচিত্তিরেও। বাবা-ছেলে-হাউসকিপার সংলাপের বেশির ভাগে যে নিক্তিমাপ, সেটাই আলগা আর উচ্চকিত আর্যনীলের স্কুলবন্ধু সাহানার (ইন্দ্রাণী হালদার) পর্বে। তবে তার চেয়েও মোক্ষম ঘোঁট ময়ূরাক্ষী। প্রায় রক্তকরবীর রঞ্জনের মতোই যে নাম বারবার আসে, সুশোভন যাকে শেষ বার দেখার জন্য আকুল, যাকে খুঁজতে ছেলে ছোটে মফস্সলি কলেজ থেকে কলকাতার অলিগলি, তার আসা না-আসা, প্রেম-মৃত্যু-প্রত্যাখ্যান গল্পকে এক মোচড়ে অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশিত। সেই ‘এনকাউন্টার’ আলগোছে এড়িয়ে গেলে, দহন জিইয়ে রেখে কসমেটিক কাব্যিকতার আশ্রয় নিলে উপরের তলটা ছোঁয়া যায় না। বিষাদের কানাগলিতে ঘুরে মরে গল্প, কোথাও পৌঁছয় না।

ময়ূরাক্ষী

পরিচালনা: অতনু ঘোষ

অভিনয়: সৌমিত্র, প্রসেনজিৎ,
সুদীপ্তা, ইন্দ্রাণী, গার্গী

৬/১০

সুশোভনের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কী করতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। আর্যনীলের মতো সচ্ছল মাঝবয়সির একরঙা চরিত্রে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও এখন বেশ রপ্ত। বরং তেরচা করে সাইডব্যাগ নেওয়াটা এ যাত্রা তিনি বাদ রাখলে পারতেন। হাউসকিপার সুদীপ্তা চক্রবর্তী কিন্তু অনুভব আর অস্বস্তি বুনেছেন প্রায় কুরুশ কাঁটায়। সামান্য সময়ে মুগ্ধ করেছেন গার্গী রায়চৌধুরীও। বাঁধুনি ফস্কেছে ঠিকই, কিন্তু শুধু বিষয় বাছাইয়ের জন্যই বাড়তি প্রশংসার দাবিদার অতনুও।

ময়ূরাক্ষীর খোঁজে সৌমিক হালদারের ক্যামেরা যে গথিক বাড়ির কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়, সেটা শ্রীরামপুর কলেজ। তার পাশেই সত্যিকারের নদী আছে, রঙিন পালতোলা নৌকা চলে। কিন্তু তার নাম ময়ূরাক্ষী নয়, ভাগীরথী। বুড়ো লাইব্রেরিয়ান বলেন— কাচের মতো জল, শান্ত নদী, ময়ূরাক্ষী।

শুধুই শান্ত? দু’কুল ভাসল কই?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement