সেই প্রথম মান্নাবাবুকে দর্শন।
১৯৮১ সাল। সেই বছরই আমি টেলিভিশনে প্রথম খেয়াল গেয়েছিলাম ‘দেশ’ রাগে। আর তার কিছু দিন পরেই আমার একটা এলপি-র রেকর্ডিং হল। বারোটা গান ছিল। তার মধ্যে ন’টা গানেই তবলা সঙ্গত করেছিলেন রাধাকান্ত নন্দী। উনি তখন নিয়মিত মান্না দের গানে সঙ্গত করেন। আমার গান শুনে খুশি হয়ে বললেন, “তোমারে আমি মান্না দের কাছে লইয়া যামু।”
ঠিক হল এক রবিবার হেদো পার্কের কাছে আমার সঙ্গে রাধাকান্তবাবুর দেখা হবে। আমি যথারীতি ঠিক সময়ে গিয়ে হাজির। কিন্তু রাধাকান্তবাবুু আর আসেন না। শেষ পর্যন্ত আমি নিজেই মান্নাবাবুর বাড়ি চলে গেলাম। বাড়িতে দেখলাম অগণিত অর্গানাইজার বসে। আমি গুটিসুটি মেরে এক কোনায় গিয়ে বসলাম। উনি কৌতূহল ভরে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি আর তখন হেদো প্রসঙ্গ না তুলে বললাম, আমি গানবাজনা করি, আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি তাই। আমার নাম অজয় চক্রবর্তী। উনি সঙ্গে সঙ্গে আমায় চিনতে পারলেন। বললেন, “আপনি সেই অজয় যে ক’দিন আগে টিভিতে দেশ রাগ গেয়েছে?” মান্নাবাবু কিছুতেই আমাকে প্রণাম করতে দিলেন না। বললেন, “বাংলা থেকে আপনার মতো এমন খেয়াল গাইয়ে আর হয়নি। আপনি যদি ভারতবর্ষের প্রথম সারির খেয়াল গাইয়ে না হন আই উইল কিল ইউ। জানেন আমিও খেয়াল গাইব ভাবতাম। কিন্তু গলাটা হেঁড়ে ছিল বলে খেয়ালের দিকে পা বাড়াইনি।”
মান্নাবাবুর কথা বলার ভঙ্গিই ছিল এই রকম। একবার কী মনে করে বনশ্রী সেনগুপ্তকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে গান শেখার জন্য। আমি তো হতভম্ব। বড়দিদির বয়সী মহিলা। যথেষ্ট ভাল গান করেন। তাঁকে আমি কী গান শেখাব?
এই রকম কত কথাই না ২৪ অক্টোবর ওঁর মৃত্যুদিন কাছে আসায় আজ মনে পড়ছে।
যখনই আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন কোথায় প্রোগ্রাম করছি, এই রাগটা কেমন করে গাইতে হয়, ওই রাগটার চলন কী রকম, মেয়ে কেমন গাইছে এই সব কথা জিজ্ঞাসা করতেন। বাংলার শিল্পী ক্লাসিকাল গাইছে এইটা ওঁকে খুব নাড়া দিত। সেই থেকেই মান্নাবাবুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উনি যেমন আমার গানকে জানার চেষ্টা করতেন, আমিও চেষ্টা করতাম ওঁর গানকে জানার। কলেজ জীবনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মান্নাবাবুর গান গেয়েছি।
মান্নাবাবু খেয়াল না শিখলেও তাঁর সমস্ত গানেই প্রায় রাগসঙ্গীতের প্রভাব আমরা লক্ষ করি। রাগসঙ্গীতের পরিমণ্ডল মান্নাবাবু ওঁর কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। পঞ্চাশ, ষাটের দশকে গান সাধারণত রাগের আবহেই সৃষ্টি হত। মান্নাবাবু সেই উত্তরাধিকার খুব সুন্দর ভাবে বহন করেছিলেন। তখন তানপুরা হাতে রাগশিক্ষা বাধ্যতামূলক ছিল যে। ‘পুছো না ক্যায়সে ম্যায়নে র্যায়ন বিতায়ি’, কিংবা ‘ছম ছম বাজে রে পায়েলিয়া’র মতো গানসবই বহন করেছে রাগের অনুষঙ্গ। তা সত্ত্বেও মার্গসঙ্গীতে শিক্ষিত গায়ক সম্পর্কে মান্নাবাবুর একটা আলাদা শ্রদ্ধা ছিল।
রবীন্দ্রসদনে গ্রিনরুমের দিকে ঢুকতে ডান দিকে আমার গুরুজি জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের একটা আবক্ষ মূর্তি আছে। সেটা আমিই স্থাপন করেছিলাম। মূর্তি প্রতিষ্ঠা দিবসে এসেছিলেন উস্তাদ আলি আকবর খান, বালমুরলী কৃষ্ণ, ভি বালসারা এবং মান্নাবাবু। উনি বলেছিলেন, ‘‘একটা গান দুশো বার গাইবার পর তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। শেখার ওপর শুধু গান নির্ভর করে না। বারবার গেয়ে তাকে আত্মস্থ করার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে গানকে শ্রবণযোগ্য করে তোলার রহস্য”। মান্নাবাবু একটা কথা প্রায়ই বলতেন ‘রক্তের সঙ্গে সুরটাকে মিশিয়ে দিতে হবে।’ এ প্রসঙ্গে উনি শরীরের কসরতের কথাও বলতেন। শরীর যদি ঠিক না থাকে তবে গান হবে না। সেই কারণেই অল্পবয়সে গোবর গোহোর কুস্তির আখড়ায় কসরত করতেন এ কথাও তিনি আমাকে বলেছেন। এবং সবচেয়ে বড় কথা গায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্টাউট, শক্তপোক্ত মানুষ। শরীরের শক্তি যে সুরে সঞ্চারিত হতে পারে সেটা মান্নাবাবুকে দেখেই বুঝতাম। নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে জীবন কাটাতেন। কোনও দিন শরীরের প্রতি এমন অত্যাচার করেননি যাতে গলার জোর নষ্ট হয়।
গোবোর গোহোর কথা উঠতে একটা গল্প মনে পড়ে গেল যেটা মান্নাবাবুু আমাকে বলেছিলেন। তখনকার দিনে গুলাম আলি নামে একজন কুস্তিগির ছিলেন। আবার ওই একই নামের গায়ক হলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাহেব। একবার একই ট্রেন ধরে দুই গুলাম আলিই চলেছেন লাহৌর। ট্রেন থামতে কী হল গায়ক উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খান সাহেবকে ভুল করে কুস্তিগির ভেবে পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হল কুস্তির আখড়ায়। কেউই তাঁকে চিনতে পারছেন না। সকলেই তাঁকে ভাবছেন কুস্তিগির গুলাম আলি। শেষমেশ প্রতিপক্ষে থাকা কুস্তিগির তাঁকে চিনতে পেরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন।
এবং ভুলবশত যে গায়ক বড়ে গুলাম আলি কুস্তির আখড়ায় গিয়ে পড়েছেন সেটা সবাই বুঝলেন। এবং উস্তাদ বড়ে গুলাম আলিকে পৌঁছে দেওয়া হল তাঁর নিজস্ব গন্তব্যে। এই ভ্রান্তিবিলাসের গল্পটা মান্নাবাবু প্রায়ই করতেন। আসলে শরীরের কসরতের ওপর মান্নাবাবুর একটা আলাদা শ্রদ্ধা ছিল। যদিও মুম্বইতে যাওয়ার পর আর সে ভাবে ফিটনেসের জন্য কোনও ট্রেনিং তিনি নিতে পারেননি।
আমাদের দেশে অনেক শিল্পী মানুষের মন জয় করেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাঁরা সেই জয়েরও ঊর্ধ্বে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। মান্নাবাবুও তেমনি এক বিরল শিল্পী। সঙ্গীতের মধ্যে পাঁচটা উপকরণ থাকে। প্রথমত কণ্ঠ, দ্বিতীয়ত স্বর বা সুর, তৃতীয়ত কাব্য ব্য লিরিক, চতুর্থত সাঙ্গীতিক বিষয়বস্তু, পঞ্চমত লয়-তাল। গানের লিরিক বা কাব্যের মধ্যে প্রাণসঞ্চার করতে পারাটাই খাঁটি গায়ক ওঠার সবচেয়ে বড় লক্ষণ। মান্নাবাবু তাঁর গানের লিরিকের মধ্যে যে ভাবে প্রাণসঞ্চার করতেন তার বাচনভঙ্গি ও সুরারোপের মাধ্যমে সেটা সাঙ্গীতিক সূক্ষ্মতা না থাকলে সম্ভব নয়। যখন উনি গান ‘বড় একা লাগে’ কিংবা ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে’ তখন এই গানের বাণী ছবি হয়ে ওঠে। সঙ্গীতে এই চিত্রগুণ আরোপও মান্নাবাবুর আর এক দক্ষতা।
১৯৬০ সাল থেকে আমার গান শেখা শুরু। সেই সময় গ্রামাফোন কোম্পানির থেকে ‘শারদ অর্ঘ্য’ বলে একটি বই বেরোত। তাতে থাকত নানা শিল্পীর দুটি করে পুজোর গান। তার মধ্যে সব থেকে মন কেড়ে নিত মান্নাবাবুর গান। এখনও মনে পড়ে ‘শারদ অর্ঘ্য’র পৃষ্ঠায় ছাপা তাঁর গান ‘চার দেওয়ালের মধ্যে নানা দৃশ্যকে’, ‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’। এই গানগুলো মান্নাবাবুর কণ্ঠে ছবি হয়ে উঠেছে। যাঁদের বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব তাঁদের মনে স্থায়ী ভাবে ছবি এঁকে রেখেছে মান্নাবাবুর পুজোর গান। গীতিকবিতায় চিত্রগুণ আরোপ করে প্রাণসঞ্চার করায় মান্নাবাবুর মতো উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিরল। বলিউডে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো গীতিকারেরা যখন মাান্নাবাবুর জীবনে এলেন তখন আর এক রকম উত্তরণ ঘটেছিল তাঁর। ‘এ কি অপূর্ব প্রেম’, ‘অভিমানে চলে যেও না’ ‘সুন্দরী গো দোহাই তোমার মান কোরো না’ এই সব গান সেই উত্তরণের স্পর্শ যেমন পায় , তেমনি কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দের পরম্পরা হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পায়।
তবে বলিউডে প্রথম পা রাখার পর ওঁকে যথেষ্ট সংগ্রাম করতে হয়েছিল। হিন্দিভাষীদের কাছে হিন্দি শিখেছেন, মৌলবীদের কাছে উর্দু শিখেছেন, তবে না গান। উর্দু ভাল করে না শিখলে কি একজন বাঙালির পক্ষে ‘ইয়ারি হ্যায় ইমান মেরা’ কিংবা ‘অ্যায় মেরে প্যায়ারে ওয়তন’ গাওয়া সম্ভব!
মান্নাবাবুর আমার প্রতি ছিল গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। আমি ওঁর থেকে ত্রিশ বত্রিশ বছরের ছোট। তাও যে এই শ্রদ্ধাবোধ ছিল তার কারণ আমার খেয়াল গান। যা ওঁকে আপ্লুত করত। একদিন আমাকে বললেন, ওঁর বিখ্যাত গান ‘এই তো সেদিন আমারে বোঝালে’ গানখানা গেয়ে শোনাতে। রাগসঙ্গীতের নানা ইমপ্রোভাইজড ফর্মে আধঘণ্টা ধরে গানখানা আমি গেয়ে শোনালাম। রাগসঙ্গীতের মূল মশলাই হল একই কথাকে বার বার নানা ভাবে গাওয়া। গান শুনে মান্নাবাবু হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন, এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে মান্নাবাবুর খুব একটা রসিকতা আর মজা করার সম্পর্ক ছিল না। ওঁর কাছে সঙ্গীতের নানা বিষয়ে আমি জ্ঞান নিতাম। আরও উনিও আমার গানের ছিলেন অনুরক্ত শ্রোতা। একদিন ‘পড়োশন’ ছবির বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার’ গানটার কথা উঠতে বলেছিলেন, ‘কিশোরকুমারের মতো ইনোভেটিভ আর আবেগপ্রবণ মিউজিশিয়ান আর হয় না। ‘পড়োশন’য়ের এই গানটাকে নানা রকম ধ্বনি ব্যবহার করে এমন একটা চেহারা দিয়েছিল যে সাত দিন ধরে রিহার্সাল হল। এবং সেই রিহার্সাল একটা উত্সবের চেহারা নিয়েছিল। এবং শেষ পর্যন্ত সেই গান লাইভ রেকর্ডিং হল। ন্যাচারাল গায়ক হিসেবে কিশোরের জুড়ি নেই।” নিজে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত দরদি হওয়া সত্ত্বেও কিশোরকুমারের গানের কী প্রশংসাই না করতেন মান্নাবাবু।
‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’এমন গান আর কে গাইবেন।
অন্য দিকে নিজে কিন্তু বিভিন্ন রাগের বিশুদ্ধতা বজায় রেখে কখনও ঠুমরি, কখনও খেয়াল আঙ্গিকের গান গেয়েছেন। উনি মনে করতেন ঘরানা বা পরম্পরা মানে পূর্ব প্রজন্মকে হুবহু মেনে চলা নয়। গানের মধ্যে পরিবর্তন, পুনঃসৃজন, সৌন্দর্যবোধের উন্নতির পরীক্ষানিরীক্ষা প্রয়োজন। এবং এই যে সৃজনশীলতা, পরিবর্তনের মাধ্যমে গানের সৌন্দর্যবৃদ্ধির চেষ্টা এ ক্ষেত্রে যে দু’ এক জনের কথা আসে মান্নাবাবু ছিলেন তার পুরোধা।
একবার মনে আছে ওঁর একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল জিডি বিড়লা সভাঘরে। সেখানে হাজির থাকবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রকাশক বললেন মান্নাবাবু চাইছেন আমি বইটি উদ্বোধন করি। ঘটনাক্রমে সেই দিনই আবার রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে আমার গান গাওয়ার আমন্ত্রণ এল। শেষ পর্যন্ত আমি যাইনি রাষ্ট্রপতি ভবনের আহ্বানে। থেকে গিয়েছিলাম মান্নাবাবুর অনুষ্ঠানে যোগ দেব বলে। তা দেখে মান্নাবাবুু বলেছিলেন, ‘‘বাংলায় তা হলে বাঘ-সিংহ আছে এখনও? আপনি রাষ্ট্রপতি ভবনের গান ক্যানসেল করে দিলেন?” আমি বলেছিলাম যে কোনও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছরের আর আপনার জায়গা তো সারাজীবনের। সেই জন্যই থেকে গেলাম।
এই রকম আর এক বার হয়েছিল। মান্নাবাবুর ইচ্ছাতে আমাকে বেঙ্গালুরু গিয়ে তাঁকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসতে হয়েছিল, একটি বিশেষ চ্যানেলের হয়ে। সেই সময় শুনেছি ওঁর বেঙ্গালুরুর জীবনটা ছিল খাঁচাবন্দি পাখির মতো। শুনে খুব খারাপ লেগেছিল। কিন্তু একটা ব্যাপার দেখেছিলাম, হারমোনিয়াম আর তানপুরা পেলে অনেক দুঃখের মধ্যেও তাঁর মেজাজটা বদলে যেত।
আজ উনি নেই। আমার মনে হয় এমন একজন সর্বভারতীয় গায়ককে যদি স্মরণীয় করে রাখতে হয় তা হলে মান্নাবাবুর নামে একটা রিসার্চ সেন্টার খোলা উচিত। যেখানে তাঁর সব গানের সংগ্রহ পাওয়া যাবে। জানা যাবে তাঁর সম্পর্কে নানা তথ্য। মনে পড়ছে সেই গান হয়তো তোমারই জন্য, হয়েছি প্রেমে যে বন্য, জানি তুমি অনন্য...
সেই অনন্য মানুষটিকে যদি আমাদের মধ্যে ধরে রাখতে হয় তা হলে নিজেদের ছড়িয়ে দিতে হবে নানা প্রদেশের গানে, কখনও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে, কখনও পাশ্চাত্যসঙ্গীতে, কখনও বা কীর্তনে, লোকগানে। আর সেই দিকে এগোতে গেলে মান্নাবাবুর নামে একটা রিসার্চ সেন্টার চাই-ই চাই। তবেই না আমরা তাঁকে ধরে রাখতে পারব।