ঋদ্ধির সঙ্গে মানবী।
এই ছবিতে আপনার জায়গা কতখানি?
জায়গা নয়। এই ছবির বিষয় নিয়ে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কুড়ি বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে।কৌশিক আমার বন্ধু। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দু’জনেই বাংলা নিয়ে পড়েছি। ট্রান্সজেন্ডার জগতের আলোটা প্রথম তুলে ধরল এই ছবি।
এর আগেও তো কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় সমকাম নিয়ে ছবি করেছেন। আর ‘নগরকীর্তন’-কেও বলা হচ্ছে সমকামের ছবি।
কৌশিক ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’করেছিল। সমকামের ছবি। কিন্তু সমকাম আর রূপান্তরকামী এক নয়। ‘নগরকীর্তন’সমকামের ছবি নয়। এটা ভুল বলা হচ্ছে। এটা রূপান্তরকামীর গল্প। ঋত্বিক চক্রবর্তী একজন পুরুষ আর ঋদ্ধি সেনও পুরুষ। কিন্তু মনে নারী। ভালবাসার জন্য শরীর বদল করতে চায় সে। ঋদ্ধি একজন ট্রান্সের চরিত্রে অভিনয় করছে, যে মেল টু ফিমেল কানেক্টর। আমার কথা দিয়ে বলি, তাহলে বোঝাতে সুবিধে হবে।আমি যদি আজ কোনও পুরুষের সঙ্গে সহবাস করি সেটা কখনওই সমকাম হবে না। আমি মনে, শরীরে নারী। নারী মন নিয়ে জন্ম নিয়ে শরীর বদল করে সম্পূর্ণ নারী হয়েছি।
তার মানে একজন নারীর সমস্ত অনুভূতি আপনার শরীরে সঞ্চারিত হয়?
অবশ্যই। আমার অর্গ্যাজম হয়। অপারেশনের পর ভ্যাজাইনা, ব্রেস্ট তৈরি হয়েছে আমার।শুধু আমি কেন, অপারেশনের পর রূপান্তরকামীদের শরীর এ ভাবেই গড়ে ওঠে। দেখুনকাম তো অন্তর থেকেই আসে। শরীরটা সেখানে অন্তরায় থাকলে শরীরটা বদলে বদলে নিতে হয়। অনেক মানুষ আজও ভাবেন শরীরের এই রূপান্তর যেন নিছক একটা এক্সপেরিমেন্টের জন্য বা মজার জন্য,ফ্যাশনের জন্য করা। কী যে ক্ষতিকারক এই মানসিকতা! এটা একজন মানুষের বেসিক নিড। সেই মানুষ, যে মনে নারী। ‘নগরকীর্তন’এই সত্যটাকে সামনে আনছে। হোমো সেক্সুয়াল যারা তাদের শরীর বদলের দরকার হয় না। কিন্তু আমরা যারা নারীর মন নিয়ে জন্মেছি তাদের বেঁচে থাকার জন্য শল্য চিকিৎসার প্রয়োজন। রূপান্তরকামীদের আত্মহত্যার ইতিহাসও কম না!
আরও পড়ুন, অল্প বয়সে সাফল্যে পিআর কতটা কাজে লাগল? ঋদ্ধি বললেন...
এরকম সামাজিক অবস্থানে ‘নগরকীর্তন’-এর গুরুত্ব কতটা?
ঋতুপর্ণ ঘোষের দুটো কাজ ছিল। কৌশিকের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’,যেখানে তিনি অভিনয় করেছিলেন। আর ‘চিত্রাঙ্গদা’, যেখানে অভিনয় আর পরিচালনা দুটোই করেছিলেন। দুটো ছবিতেই সমকামের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন, ট্রান্সজেন্ডার শব্দটা ব্যবহার হয়নি। ঋতুপর্ণ নিজেও পুরো শরীর বদল করেননি। ‘নগরকীর্তন’রূপান্তরকামীদের সামনে আনছে। এই যে চিন্তা, আমি যে শরীরে পুরুষের কিছু রাখব না, এই বড় চিন্তাকে দর্শকদের সামনে নিয়ে আসছে এই ছবি। যখন আমি এই ছবিতে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলাম তখন আমার মনে হল আমার শরীর নিয়ে যুদ্ধ করার জায়গাটা কৌশিক ছবির অংশ করতে চাইছেন। দেখুন, লোকে যে সময় টাকা জমায় বাড়ি তৈরি করবে বলে, ঘর বানাবে বলে, আমি তখন টাকা জমাচ্ছি শরীর বদল করব বলে! কোথায় যাবে বলুন তো হিজড়ে সম্প্রদায়? বাড়ি থেকে তো তাড়িয়ে দেয় ওদের। লোকে ভাবে ছেলে বলে বড় করলাম, মেয়ে হয়ে যাচ্ছে! ঝেড়ে ফেলতে হবে। কী যে যন্ত্রণার! আমি অনেক অত্যাচার সহ্য করে থেকে গেছি। বাবা-মা ভালবাসতেন আমায়। মা তো আমার জন্য সমাজের কথা শুনতে শুনতেই সেরিব্রালে চলে গেলেন। এই ছবি একজন রূপান্তরকামীর জীবন চেনাবে। একটা পথ দেখাবে নিশ্চয়ই।
কৌশিক এবং ঋত্বিকের সঙ্গে মানবী।
অভিনয় করেছিলেন ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’-তে। এ বার ‘নগরকীর্তন’...
নাহ্, এখানে অভিনয় করতে হয়নি। ‘নগরকীর্তন’আমার জীবন। ‘নগরকীর্তন’করার সময় বুঝেছিলাম ছবিটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাবে। কৌশিক অত্যন্ত সূক্ষ্ম ভাবে রূপান্তরকামীর ইতিহাসকে নিয়ে এসেছেন।নবদ্বীপ, কৃষ্ণনগর বৈষ্ণব অঞ্চল। ঘটনাচক্রে আমি আজ ওই অঞ্চলের কলেজের প্রিন্সিপাল। প্রায় পাঁচশো বছর আগে ইতিহাস বলছে, প্রভু চৈতন্য বেনারসী পরে মহিলা সেজে কৃষ্ণকে ডাকছেন। ভাবুন! ছবি সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে তুলে ধরছে। তাই ‘কীর্তন’শব্দটা আসছে। আর আমরা নগরের মানুষ। সেই জায়গা থেকে ‘নগরকীর্তন’। ইতিহাসের রাস্তায় নবদ্বীপের মায়াময় মাটিতে রূপান্তরকামীদের অবস্থানকে কৌশিক কি চমৎকার করে ধরেছেন এই ছবিতে! আমি ছবিতে বলছি চৈতন্যের কথা। ইতিহাস থেকে সরে সরে বর্তমানের ক্যানভাসে রূপান্তরকামী, প্রেম মিশছে। আধ্যাত্মিকতা থেকে রিয়্যালিজমে ফিরছে ছবি।
এই রিয়্যালিজমের পরিসরে আপনিই তো ট্রান্সজেন্ডারদের কাছে একটা আশ্রয়?
মানুষ তো বিষয়টা নিয়ে বিভ্রান্ত। কত ট্রান্সজেন্ডার আসে আমার কাছে। থাকতে চায়। পথ খোঁজে। শুধু সেক্স চেঞ্জ নয়। তার পরের ধাপ তো ট্রান্সজেন্ডারকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া। এই পর্যায়ের লড়াইটা আরও ভয়ঙ্কর! গালাগাল থেকে মারামারি, কুৎসার পর উঠে দাঁড়ানো। কৌশিকের ছবি সেটাই দেখাচ্ছে। ছবিতে যে পরিমল বা পুঁটি, সে হিজড়ে পেশার নয় তো! কিন্তু তার শরীর আর মনকে কোথাও মেলাতে হবে।তার প্রেমিক চাইছে তাকে মেইনস্ট্রিমে আনার জন্য। তার লড়াইয়ের কাহিনি দেখে মানুষ, সমাজ যদি উদার হয়। এটাই আশার।ভালবাসার ওপর সামাজিক দায়বদ্ধতাও তো চাপিয়ে দেওয়া হয়।মেয়েদের মা হতেই হবে।এগুলোই সমস্যা তৈরি করে। অথচ পুরাণে দেখুন, চণ্ডীর কনসেপ্ট তো ট্রান্স নারীর কনসেপ্ট। চণ্ডীর কোনও সন্তান নেই। ইতিহাসকে অস্বীকার করে তো বাঁচা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশে ট্রান্সজেন্ডাররা আজও ভিক্ষে করে। এটাই কষ্টের...।আশা করি‘নগরকীর্তন’ রূপান্তরকামী নিয়ে মানুষের চোখের ছানি অনেকটাই কেটে দেবে।
(কোন সিনেমা বক্স অফিস মাত করল, কোন ছবি মুখ থুবড়ে পড়ল - বক্স অফিসের সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদন বিভাগ।)