রিহার্সালের ফাঁকে ‘ম্যাড’য়ের সদস্যরা। ছবি: কৌশিক সরকার
লেক গার্ডেন্সের এক চিলতে একটা ঘর। সন্ধে হলে সেই ঘরেই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে জড়ো হয় জনা তিরিশেক ছেলে-মেয়ে।
অধিকাংশ কলেজ পড়ুয়া। কেউ কেউ কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি। এই গো-বেচারা ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে পাড়াপড়শিরা প্রথমে ভাবতেন, এটা কোনও কোচিং ক্লাস।
ভুল ভাঙল ক’দিন পরই। তিন তলার জানালা দিয়ে ভেসে আসতে লাগল নানান কথাবার্তা। কখনও পুরুষ কণ্ঠ বলছে, ‘‘আমার নাম রাখার সময় মনে ছিল না?’’ আবার কখনও মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদ, ‘‘এভাবে প্রেম ভাঙতে পারলে তুমি?’’
রহস্যের অবশ্য এতেই শেষ নয়। পাড়ার কাকু-জেঠুরা যখন ‘ওখানে কী হয় বলো তো’-র উত্তর খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন, হঠাৎ সেই ঘর থেকে বেরোতে দেখা গেল এক সুন্দরী মেয়েকে। নাম, মামন। পাশে টোপর মাথায় তার বর—বাবাই। পাড়ার কৌতূহল, ‘‘ছেলেগুলো পাগল হয়ে গেল না কি?’’
হ্যাঁ, ওরা পাগল। তবে বাস্তবে নয়, নাটকের মঞ্চে। আর এটাই ওদের দলের পোশাকি নাম — ম্যাড অ্যাবাউট ড্রামা। এককথায়, ম্যাড। লেক গার্ডেন্সের ওই এক চিলতে ঘরেই গত পাঁচ বছর ধরে, এক ঝাঁক ছেলেগুলো স্বপ্ন দেখছে শহরের থিয়েটারের সিনটা পাল্টানোর। কখনও ওরা মঞ্চে এনেছে রাজনীতি। কখনও প্রেম, আবার কখনও কৌতুক।
জ্ঞানমঞ্চে কয়েক সপ্তাহ আগে ‘বাবাই ওয়েডস মামন’-য়ের প্রথম শো-এর আগে, প্রেক্ষাগৃহের বাইরে লম্বা লাইন। টিকিটের দাম দুশো টাকা। তবু কাউন্টারের সামনে উৎসুক জনতার ভিড়।
“আমরা হয়তো একটু হলেও চেনা দৃশ্যটা বদলাতে পেরেছি। আমাদের শো-তে। কিন্তু কোনও ফ্রি পাসের গল্প নেই। তাতেও কত মানুষ আসেন নাটক দেখতে,” বলছিলেন ম্যাড-এর সদস্য সোহম মজুমদার।
২০১১-য় কলেজে ঢুকেই যে মঞ্চটার প্রেমে পড়েছিলেন সেটাই এখন নেশা আর পেশা। শুধু সোহম নন। সৌম্য মুখোপাধ্যায়, অরিত্র সেনগুপ্ত, শর্মিষ্ঠা পাণ্ডেদেরও একই অবস্থা। শহরের বিভিন্ন নামী কলেজে পড়াশোনা করার পরে, ভাল চাকরির অফার ছেড়ে এরা এখনও কলকাতায়, শুধু নাটকের টানে।
“আমরা ঠিক যেমন ভাবি, সেটাই মঞ্চে তুলে ধরার চেষ্টা করি। তাত্ত্বিক ভাবনাচিন্তাগুলো ছেড়ে সরাসরি অপ্রিয় কথাবার্তাগুলো বলার চেষ্টা করছি আমরা,” বলছিলেন সৌম্য।
শুধু সোহম বা সৌম্য নন। এই সোজাসুজি কথাগুলো সোজা ভাবে বলতে পারাটাই এখন এদের ইউএসপি। নিজেদের ‘ইউথ থিয়েটার’ গ্রুপ বলতে রাজি নন। ম্যাড, ফোর্থ বেল, হিপোক্রিটস বা অ্যাক্টো-র সদস্যদের কাছে মঞ্চটাই নিজেদের দেশ।
“শুধু স্লোগান নয়, রাজনীতির রংও নয়। আমরা চাইছি এই প্রজন্মের কথা বলতে। আর সেটুকু তো পারি,” বলছিলেন ফোর্থ বেল গোষ্ঠীর অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত। আর এই ভাবনাটাই বোধহয়, এক ঝাঁক কলেজ পড়ুয়াকে ইন্সপায়ার করেছে নাটক করতে।
যেমন উজান গঙ্গোপাধ্যায়। যাদবপুরে ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্কুলে পড়াকালীন নিয়মিত নাটক করতেন, এবং সেই সূত্রেই ম্যাড-এর সঙ্গে আলাপ। “এখানে প্রত্যেকের থিয়েটারের প্রতি ডেডিকেশনটা দেখার মতো। সব সময়েই ভাল কাজ করতে চাই আমরা,” বলছিলেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলে উজান। বাবা জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত পরিচালক, মা চূর্ণীও তাই। বাবা-মায়ের মতো উজানও থিয়েটারের প্রেমে পড়েছেন ইউনিভার্সিটিতে এসেই।
আসলে শহরের নাটকের মুখটাই পাল্টে দিয়েছে ম্যাড, ফোর্থ বেল, অ্যাক্টো-রা। শুধু বিষয় বৈচিত্রে বা সেট ডিজাইন নয়, নাটক করে লক্ষ্মীলাভের মুখও দেখেছেন তরুণ তুর্কিরা। অধিকাংশ দল পারফর্ম করে প্রিটোরিয়া স্ট্রিটের জ্ঞানমঞ্চে। টিকিটের দাম দুশো টাকা, তাতেও প্রায় রোজ হাউসফুল।
“আমরা টিকিট সেল যেমন করি, তেমনই কর্পোরেট স্পনসরশিপও আনতে পেরেছি,” বলছিলেন অনিরুদ্ধ। “আমরা এই সময়ের কথা বলছি যখন, আমাদের সেট বা কস্টিউমই সে রকমই হওয়া উচিত। এবং সেটার জন্যই বোধহয় স্পনসররা আমাদের সাহায্য করতে চান।”
সুতরাং যখন ফোর্থ বেল-এর ‘কোরাস’ বা ম্যাড-এর ‘আ হিস্ট্রি অফ বুচার্স’–য়ে ভিন্ন ধারার, ঝাঁ-চকচকে সেট ডিজাইন দেখা যায়, অবাক হওয়ার জো থাকে না।
চমকের এখানেই শেষ নয়। টিকিটের ওপর জ্বলজ্বল করে কোনও বহুজাতিক সংস্থার লোগো। “মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিটাও খুব ইম্পর্ট্যান্ট। সেটা পারছি বলেই এগোনোটা সম্ভব হয়েছে,” বলছিলেন সৌম্য।
সবটাই যে ফাঁকা আওয়াজ নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় যখন দর্শক আসন থেকে হাততালি দেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায় বা কৌশিক সেনরা।
গল্ফ গার্ডেন্সের একচিলতে ঘরটায় কিংবা যাদবপুরের মিলনদার ক্যান্টিনে বসে পরদিন উজান, অনিরুদ্ধ, শ্রেয়ারা ভাবতে বসেন, ‘পরের বার কী করা যায় বল তো?’