লতার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ রূপঙ্কর, লোপামুদ্রা, মনোময়
এ এক অদ্ভুত সমাপতন। শনিবার ছিল সুরের দেবীর আবাহন। সারা দেশ বসন্ত পঞ্চমী পালন করেছে মহাসমারোহে। রবিবার সেই দেবীর নিরঞ্জন। সেই রবিবারেই পঞ্চভূতে গড়া শরীর ছেড়ে সুরলোকে পাড়ি দিলেন মাটির পৃথিবীর জীবন্ত সরস্বতী লতা মঙ্গেশকরও। সারা দেশ ব্যথায় বিধুর। শোকস্তব্ধ বাংলা গানের দুনিয়াও। আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে শোক প্রকাশ করেছেন রূপঙ্কর বাগচী, লোপামুদ্রা মিত্র, ইমন চক্রবর্তী, মনোময় ভট্টাচার্য, অনুপম রায়।
ফোনে রূপঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমেই তাঁর বক্তব্য, ‘‘যেন সদ্য মাতৃহারা হলাম। যে কোনও সন্তান সদ্য মাকে হারালে যে ভাবে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে, আমার সেই অবস্থা। ভাষায় বোঝাতে পারছি না।’’ একই সঙ্গে শিল্পীর দাবি, ছোটবেলায় তাঁর পুজো মানেই লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, মুকেশ। সে সময়ে পাড়ায় পাড়ায় বাজত শিল্পীদের হিন্দি-বাংলা পুজোর গান। যে কোনও উৎসবেরই শেষ থাকে। যে কোনও দেবতার আবাহন মানেই বিসর্জন। সে কথা মনে পড়লেই ব্যথিত হত শিল্পীমন। তিনি তখন আশ্রয় খুঁজতেন লতাজির গানে। অনেক দুপুর, অনেক সন্ধে কেটেছে কিংবদন্তি শিল্পীর গান শুনে। যেমন, লতাজি আর নেই জানার পরেই রূপঙ্করের মনে পড়ে যাচ্ছে ‘না কোয়ি উমঙ্গ হ্যায়’, ‘নাও গো মা ফুল নাও’, ‘দূরে আকাশ সামিয়ানা’ বা ‘পিয়া তোসে নয়না লাগে রে’-র মতো কালজয়ী গান।
লতার প্রয়াণে শোকস্তব্ধ অনুপম, ইমন
রূপঙ্করের মতো মাতৃহারা মনোময় ভট্টাচার্যও। কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর বুজে এসেছে আবেগে। শিল্পীর কথায়, ‘‘ছোট থেকে গুনগুন করতাম সলিল চৌধুরীর সুরে ওঁর ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’ গানটি। হিন্দির পাশাপাশি তাঁর বাংলা গানগুলোও আমার বড় প্রিয়। হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রায়ই গেয়েছি, ‘কী লিখি তোমায়, প্রিয়তমা।’’ মনোময়ের দাবি, যাঁরা লতাজির গান শুনে বড় হয়েছেন, পরে গানের দুনিয়ায় পা রেখেছেন তাঁদের কাছে কিংবদন্তি গায়িকা স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠান। যাঁর প্রতিটি কাজ, গায়কি, অভিব্যক্তি, প্রকাশভঙ্গি থেকে সমৃদ্ধ হয়েছেন সকলেই। শিখেছেন অনেক কিছু। গানের সেই একনিষ্ঠা সাধিকা তাই কোনও দিন হারিয়ে যেতে পারেন না।
বাকরুদ্ধ জাতীয় পুরস্কারজয়ী শিল্পী অনুপম রায়। শিল্পী বরাবরই স্বল্পবাক। এ দিন তাঁর আফশোস, ‘‘ওঁর সময়ে জন্মালে ওঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেতাম। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ জন্মে সেই সাধ পূরণ হল না।’’ লতাজিকে তাই তাঁর গানেই বিদায় জানানো ছাড়া উপায় নেই। অনেকটাই গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোর মতো। ওঁর মৃত্যুসংবাদ পাওয়া মাত্র বিচ্ছেদ ব্যথা অনুভব করেছেন সুরকার-গীতিকার-শিল্পী। মনে মনে গেয়ে উঠেছেন, ‘কী লিখি তোমায়, প্রিয়তমা।’
এক দিকে দেবী সরস্বতীর বিসর্জন। অন্য দিকে, প্রয়াত লতা মঙ্গেশকর। লোপামুদ্রা মিত্রের কাছে যেন জীবন্ত দেবীর বিসর্জন ঘটল। একই সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে বেশ কয়েক বছর আগের স্মৃতি। সায়েন্স সিটি সভাগৃহের মঞ্চ কিন্নরকণ্ঠীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। লোপামুদ্রার কথায়, ‘‘বরাবরের আফশোস, কোনও দিন সামনে থেকে কিশোর কুমারকে দেখতে পাইনি। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সেই আক্ষেপ যেন কিছুটা মিটিয়েছিল। লতাজির সঙ্গে তাঁর সব বোনেরা সে দিনের মঞ্চে ছিলেন। যদিও সে দিন কথা হয়নি। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিয়ে জীবন সার্থক হয়েছিল।’’ লোপামুদ্রা লতাজিকে মনে করবেন শচীন দেব বর্মনের সুর দেওয়া অভিমান ছবির বিখ্যাত গান ‘নদীয়া কিনারে হেরায়ে আয়ি কঙ্গনা’য়। যখনই খুব মনে পড়বে শিল্পীকে, তিনি গুনগুনিয়ে উঠবেন জগজিৎ সিংহের সঙ্গে লতাজির গজল অ্যালবাম ‘সাজদা’র জনপ্রিয় গজল— ‘দর্দ সে মেরা দামন ভর দে ইয়ার।’
সবাই যখন শোকে বাক্যহারা তখনই ভিন্নমত জাতীয় পুরস্কারজয়ী ইমন চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘লতা মঙ্গেশকরের শরীরের বিনাশ হল। আত্মা পাড়ি দিল সুরলোকে। সুর সম্রাজ্ঞী বিদায় নিয়েছেন। বদলে রেখে গিয়েছেন তাঁর অসংখ্য গান। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবিস্মরণীয় কাজ করেছেন। আজ তাঁকে, তাঁর গানকে, তাঁর কাজকে নতুন ভাবে ফিরে দেখার দিন। তাঁর অবদান উদযাপনের দিন।’’ গায়িকার মতে, তিনি বহু মৃত্যু দেখেছেন। আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী। তাই তিনি জানেন, লতা মঙ্গেশকর কোনও দিন মুছে যাবেন না। রবীন্দ্রগানের কথাতেই তাই কিংবদন্তি শিল্পীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা— ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে, তবুও শান্তি, আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।’