soumitra chatterjee

Soumitra Chatterjee: সৌমিত্র জেঠু হয়তো আক্ষরিক অর্থে ‘ভাল মানুষ’ ছিলেন না, ‘ভাল’ হওয়ার চেষ্টা করতেন

‘‘ভাল মানুষ হওয়ার পাশাপাশি ভাল শিল্পীকে ভীষণ নিস্পৃহ, নিরাসক্তও হতে হয়’’ বললেন কৌশিক সেন।

Advertisement

কৌশিক সেন

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৪:০০
Share:

কেমন মানুষ সৌমিত্র? লিখছেন কৌশিক সেন

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতা বহু বছরের। ফলে তাঁকে ঘিরে স্মৃতিও অনেক রকম। কেমন ছিল সেই স্মৃতি? ভুলেও বলব না। কারণ আমি যেমন কৃপণ, তেমনই লোভী। এই স্মৃতিগুলো শুধুই আমার। কৃপণ যেমন তাঁর ধনসম্পত্তি ব্যাঙ্কে জমা রেখে খুঁটে খুঁটে খরচ করে এবং তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, আমিও তা-ই। কেমন মানুষ ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়? এই প্রশ্ন উঠলে তার উত্তর বোধহয় দিতে পারব।

Advertisement

এক জন অভিনেতার কাজে প্রচুর স্তর। নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের দৌলতে। অভিনয় দুনিয়ার মানুষেরা জানেন, ‘ভাল মানুষ’ না হলে ভাল শিল্পী হওয়া যায় না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কিংবদন্তি অভিনেতার পাশাপাশি কি মানুষ হিসেবেও সেরা ছিলেন? আমার উপলব্ধি বলে, আক্ষরিক অর্থে ‘ভাল মানুষ’ বলতে যেটা বোঝায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বোধহয় সেটা ছিলেন না। ছিলেন না বা চাইলেও যে পারতেন না, তারও কারণ আছে। কিংবদন্তি শিল্পী হওয়ার দৌলতে তাঁকে নানা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে প্রতিনিয়ত যেতে হত। ফলে, ইচ্ছে থাকলেও উপায় ছিল না। বা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠত না। কিন্তু ওঁর প্রচণ্ড চেষ্টা ছিল, ‘ভাল’ হওয়ার। প্রতি দিন ওঁর কাজের মাধ্যমে, অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নিজের কাজের পাশাপাশি ব্যক্তি সৌমিত্ররও উত্তরণ ঘটানোর চেষ্টা করতেন। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। কাজের অবসরে সৌমিত্র জেঠু অনেক সময়ে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতেন। তিনি কবিতা পড়ছেন, এটাই কিন্তু তাঁর এক মাত্র লক্ষ্য থাকত না। আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে তিনি যেন আত্মশুদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করতেন। প্রকৃত শিল্পী এই কাজটিই করেন।

সেই মানুষটিই যখন মঞ্চে, অভিনেতা এবং পরিচালক হিসেবে— তিনি কিন্তু অনবদ্য। তাঁর অভিনীত একটি নাটক ‘টিকটিকি’ সম্প্রতি সিরিজ হিসেবে আসছে। মঞ্চের পরে নাটকটি ছোট পর্দাতেও সফল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রচুর নাটকের আমি ভক্ত। ওঁর সঙ্গে এক সঙ্গে মঞ্চে বেশ কিছু নাটকও করেছি। কিন্তু ‘টিকটিকি’-র আলাদা জায়গা আমার কাছে। আমার সৌভাগ্য, আমি সৌমিত্র জেঠুর সঙ্গে এতে অভিনয় করেছিলাম। নাটকে চরিত্র বলতে আমরা দু’জন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীর উত্তরসূরী, ‘সত্যসিন্ধু’। আমি ‘বিমল’। এই নাটকে তিনি অভিনেতা এবং পরিচালক। ফলে, প্রথম তিন-চারটে শো-য়ে অভিনয়ের সময়ে আমি দেখতাম জেঠুর অভিনেতা সত্তাকে ছাপিয়ে যেত পরিচালক সত্তা। আমার অভিনয়ের পাশাপাশি ওঁকে দেখতে হত মঞ্চ, আলো, শব্দের প্রক্ষেপণ, রূপটান--- সমস্তটাই। চারটে শো-এর পরে সকলেই মোটামুটি ধাতস্থ। তাই দেখে মঞ্চের ‘সত্যসিন্ধু’ও যেন অনেকটাই নিশ্চিন্ত। এ বার বেরিয়ে এলেন অভিনেতা সৌমিত্র। কী দাপট মঞ্চে! আমার প্রতিটি সংলাপ বলার পটভূমিকা তৈরি করে দিত ওঁর অভিনয়!

Advertisement

সোমিত্রের সঙ্গে কৌশিক

এই প্রসঙ্গে বলব, ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম নাট্যাভিনয় ‘ঘটক বিদায়’-এর কথাও। পেশাদারি মঞ্চে আমার প্রথম কাজ। বাবা শ্যামল সেনকে চিঠি দিয়ে জেঠু আমায় চেয়ে নিয়েছিলেন। তখন আমার পারিবারিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ খারাপ। ফলে, অভিনয় করে উপার্জন আর জেঠুর মতো ব্যক্তিত্বের সাহচর্য— দুটোই আমার কাছে প্রচণ্ড দুর্লভ। আদ্যন্ত কৌতুকরসের নাটক। সৌমিত্র জেঠু ছাড়াও ছিলেন তরুণ কুমার, মাধবী মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শ্রীলা মজুমদার। এতগুলো তারকাকে সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপরে আমি একেবারেই আনকোরা। ওঁকে দেখতাম, প্রত্যেক তারকাকে সামলাতেন তাঁদের মতো করে। আমাকে সামলাতেন আমার মতো করে। এর পাশাপাশি অভিনয় করতেন। এর আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কৌতুক অভিনয় ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবিতে অল্প দেখেছিলাম। এ বার তার বিস্তৃত রূপ দেখলাম মঞ্চে। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের অদ্ভুত বোঝাপড়া। তার পরেও যেন প্রত্যেকে প্রত্যেককে বলছেন, ‘আমায় দেখো’!

দেখতে দেখতে সেই মানুষটি এক বছর আমাদের মধ্যে নেই। ওঁকে ফিরে দেখতে গেলে ওঁর আরও একটি বিশেষ গুণের কথা বলতেই হয়। ভাল মানুষ হওয়ার পাশাপাশি ভাল শিল্পীকে ভীষণ নিস্পৃহ, নিরাসক্ত হতে হয়। সৌমিত্র জেঠু সেটা ভয়ঙ্কর ভাবে ছিলেন। ওঁর ‘অশনি সংকেত’ বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবি এবং সেরা অভিনেতার সম্মানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে একই ছবি দুটো পুরস্কার পেত না। ফলে, তিনি সেরা অভিনেতা হিসেবে সোনালি ভাল্লুক হাতে পাননি। তার জন্য কোনও দিন ওঁকে আক্ষেপও করতে দেখিনি! একই ভাবে অনেক দেরিতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এক মুঠো দুর্দান্ত ছবি এবং চরিত্রে অভিনয়ের অনেক পরে। তার জন্যও সৌমিত্র জেঠুকে কখনও আফশোস করতে দেখিনি।

মা-বাবাকে ভোলার জন্য সন্তানের কাছে মাত্র একটি বছর যথেষ্ট নয়। সৌমিত্র-কন্যা পৌলমী বসুর ক্ষেত্রে তো নয়ই। ও একের পর এক আঘাতে জর্জরিত। আমি যখন ‘বিদেহী’ নাটকটি পরিচালনা করেছিলাম, ওঁর ছেলে রণদীপ তাতে দুরন্ত অভিনয় করছিল। সেই অবস্থাতেই আচমকা পথদুর্ঘটনা ঘটে রণদীপের। বাকিটা সবাই জানেন। বাবাকে হারানোর পরে পরেই পৌলমী মাকেও হারিয়েছেন। শোক করবেন কখন? উল্টে সমানে লড়ে যাচ্ছেন। তাই ওঁকে স্বান্তনা নয়, কুর্নিশ জানাই। পৌলমী এর মধ্যেই দেবশঙ্কর হালদারকে নিয়ে ওঁর বাবার স্মৃতিতে নতুন নাটক টাইপিস্ট মঞ্চস্থ করছেন। এ ভাবেই ওঁর লড়াইয়ে উদযাপন। একই সঙ্গে বাবাকে স্মরণ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement