কোয়েল মল্লিক। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: চার বছর পর আবার পুজোয় মিতিন ফিরছে...।
কোয়েল: পুজোয় ছবি মুক্তি পেলে আলাদা মজা হয়। কারণ, পুজোর হইহুল্লোড় ছাড়াও বাংলা ছবি না দেখলে আমার ঠিক পুজো জমে না। এ বার আবার নিজের ছবি ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ মুক্তি পাচ্ছে। তাই বাড়তি উত্তেজনা তো রয়েছেই। তবে গত বার আমি বেশি চাপে ছিলাম। কারণ, বাঙালি ফেলুদা-ব্যোমকেশের পাশাপাশি মিতিনও পড়েছে। তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পর্দায় মিতিনকে ঠিক মতো ফুটিয়ে তুলতে পারব কি না, সেই নিয়ে মনে খানিক সংশয় ছিল। তার পর যখন ছবিটা মুক্তি পেল, দেখলাম দর্শক বিপুল ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। ছবিও সুপারহিট হল। তাই এ বার অতটা চিন্তা নেই।
প্রশ্ন: মিতিন হিসাবে মানাচ্ছে কি না, তা নিয়ে আপনার নিজের সংশয় ছিল?
কোয়েল: আসলে অনেক সময় আমরা খুব কষ্ট করে একটা কাজ করি। কিন্তু সেই কষ্ট সার্থক হয় তখনই, যখন দর্শক হলে গিয়ে ছবিটা দেখেন। সেটা তো আগে থেকে খুব একটা আন্দাজ করা যায় না। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অসাধারণ সৃষ্টি মিতিন। সেটাকে অরিন্দমদা (শীল, পরিচালক) একটা আলাদা সিনেম্যাটিক রূপ দিয়েছিল। তাই একটু মনে ভয় তো ছিলই। তবে দর্শকের প্রতিক্রিয়া সেগুলো সব মুছে দেয়। এই দ্বিতীয় গল্পটা নিয়ে আমি অনেক বেশি এক্সাইটেড।
‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ ছবির একটি দৃশ্যে কোয়েল। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: কেন? এখন মিতিনের চরিত্রটা আত্মস্থ হয়ে গিয়েছে?
কোয়েল: আজ সকালেই আমার দাদা আমায় দেখে মজা করে বলছিল, ‘‘তোর তো হাঁটাচলার মধ্যে আমি মিতিনকে দেখতে পাচ্ছি (হাসি)।” আসলে মিতিনের শুটিং শুরু হলেই বোধহয় আমার মধ্যে একটা সুইচ অন হয়ে যায়। তবে আগের গল্পের চেয়ে এই গল্পটা অনেকটা অন্য রকম। মিতিনকে সকলে বুদ্ধিমতী হিসাবে চেনেন। কিন্তু এখানে সে চোরাশিকারিদের সঙ্গে লড়বে। তাই সে অনেক বেশি ধারালো, অনেক বেশি শরীরী কসরত করে, অনেক বেশি বোল্ড। সেগুলোর জন্য আমি নিজের ফিটনেস রেজ়িমটা একটু বদলেছিলাম। অনেক বেশি পাওয়ার ট্রেনিং করেছিলাম, বক্সিং করেছিলাম। তবে একটা কথা বলব? আমি কিন্তু সব নারীর মধ্যেই কোথাও না কোথাও মিতিনকে দেখতে পাই। সকলেই আমার চোখে নিজের মতো করে প্রতিবাদী। ন্যায়ের জন্য লড়েন।
প্রশ্ন: মিতিন ঘর-সংসার সামলে রহস্যের সমাধান করে। অনেকটা আপনার মতো। আপনিও তো দিব্যি সংসার সামলে কেরিয়ার বজায় রেখেছেন?
কোয়েল: সংসার সামলে বাইরের কাজ করাটাই তো মহিলাদের জীবন। যাঁরা রোজ কাজে যান, তাঁরা ভোরে উঠে সংসারের কাজ সেরে ফেলেন। সেই কারণেই তো বলছিলাম, শুধু আমি কেন, সব মেয়েই তো অনেকটা মিতিনেরই মতো। তবে আমার মনে হয়, সকলের জন্য ভাবা ভাল, কিন্তু নিজের জন্যেও ভাবা উচিত। এতটা আত্মত্যাগী হয়ে যাবেন না যে, নিজের স্বপ্নটাই পূরণ করতে পারলেন না। মিতিন কিন্তু সেটাই শেখায়। সেই কারণেই এই চরিত্রটা আমায় এতটা অনুপ্রাণিত করে।
প্রশ্ন: আপনি তা হলে সব দিক সামলে চলতে পারদর্শী?
কোয়েল: আসলে গোটাটাই বাবা-মায়ের কাছে থেকে পাওয়া। মা যখন শিক্ষিকা ছিলেন বাড়ির সব কাজ সামলে স্কুলে যেতেন। ফিরে আবার খাতা দেখতে দেখতেই আমার পড়াশোনা দেখতেন। বাবাও একই রকম। বাবা-মাকে হাতে হাত মিলিয়ে সব দায়িত্ব সামলাতে দেখেছি। তাতে কারও কেরিয়ারের ক্ষতি হয়নি। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক না হলে কিন্তু সমাজব্যবস্থার উন্নতি হবে না। ছোট থেকে আমি যৌথ পরিবারের ভাই-দাদার সঙ্গে একই ভাবে ভালবাসা পেয়ে বড় হয়েছি। একটু যখন বড় হলাম, তখন খবরের কাগজ পড়ে বুঝলাম যে, ছেলেমেয়ের বৈষম্য কতটা। খুব খারাপ লাগত। ভাবতাম, প্রত্যেক নারীর মধ্যেই তো মা দুর্গার একটা রূপ আছে। তা হলে তাঁরা কেন প্রতিবাদ করেন না। বাবা-মায়েদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা খুব জরুরি। কারণ, ছেলেমেয়েরা তাঁদের দেখেই বড় হবে।
‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়েদের দেখেই শেখে। সে কথা মাথায় রেখেই কি কবীরের জন্মের পর থেকে ‘রক্ত রহস্য’, ‘বনি’, ‘সাগরদ্বীপে যখের ধন’, ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’-র মত পর পর বোল্ড চরিত্র বেছে নিচ্ছেন?
কোয়েল: আমি যদি আমার এক শতাংশ দর্শককেও আমার কাজের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করতে পারি, তা হলেই আমি নিজেকে সফল মনে করব। ‘সাত পাকে বাঁধা’ থেকে ‘শুভদৃষ্টি’— আমি আমার কেরিয়ারে যত ছবিই করেছি, বাণিজ্যিক হলেও কিন্তু আমি বরাবরই খুব দৃঢ় চরিত্র বেছে নিয়েছি। কোনও দিনই এমন চরিত্র করিনি, যেগুলো খালি কেঁদে ভাসাচ্ছে। সচেতন ভাবেই হোক বা অজান্তেই হোক, বরাবর এমন ছবি বেছেছি, যেখানে চরিত্রগুলোর মেরুদণ্ড রয়েছে। কারণ, আমার কাছে মহিলা মানেই তাই। যদি কবীরকে বা আমার কোনও দর্শককে একটুও অনুপ্রাণিত করতে পারি, তা হলে মনে হবে নিজের কাজের কিছুটা ছাপ ফেলে যেতে পারছি।
প্রশ্ন: কবীর তো দেখতে দেখতে বেশ বড় হয়ে গেল..।
কোয়েল: এত তাড়াতাড়ি সময় কেটে যায়। এই কাল রাতেই দেখলাম, নাইট স্যুট ছোট হয়ে গিয়েছে। তার মানে লম্বা হয়ে গেল! এখন তো স্কুলেও যাচ্ছে। স্কুলে যেতে অসম্ভব পছন্দ করে। তবে ও সব জায়গায় যেতেই পছন্দ করে। যেখানেই যায় নিজের জগতে থাকে। দারুণ মজা করে। আর অনবরত নানা রকম প্রশ্ন করে যায়। সেগুলোর উত্তর না পেলে আবার খুব রেগে যায়! সারা ক্ষণ ওর সঙ্গে আমায় কথা বলতে হয়।
প্রশ্ন: তা হলে তো মা হওয়ার পর আপনার জীবন অনেকটাই বদলে গিয়েছে।
কোয়েল: মাতৃত্ব সব নারীকেই কোনও না কোনও ভাবে বদলে দেয়। আগে আমার দিনটা অন্য ভাবে কাটত। এখন শুধু অ্যাকশন থেকে কাটটুকু আমি দর্শকের। তার বাইরের সময়টা আমি সারা ক্ষণ ভাবছি কবীর কী করছে। সিসিটিভি-তে দেখছি, ঘরে খেলছে কি না। কী খেল, কী খেল না— সব সময় এ সবই তো ভাবছি।
প্রশ্ন: মা হওয়ার পর কাজের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন। এখন কোন ধরনের চিত্রনাট্য পেলে ‘না’ করতে পারেন না?
কোয়েল: সে ভাবে আমার কোনও চেকলিস্ট নেই। তবে যে কোনও চিত্রনাট্য আগে আমায় এন্টারটেন করতে হবে। আর পাশাপাশি আমায় কোনও ভাবে প্রভাবিত করতে হবে। একটা চিত্রনাট্য শুনে ভুলে গেলাম, তা হল হবে না। যদি সেটা শোনার পর বাড়ি গিয়ে সেটা নিয়েই চিন্তাভাবনা করি, তা হলে বুঝব, চিত্রনাট্যটা অন্য রকম। তবে আগেও আমি বেছে কাজ করতাম। মা হওয়ার পর আমার প্রায়োরিটি বদলে গিয়েছে। তাই আরও বেছে কাজ করি। আমি আসলে বাড়িতে থাকতে খুব ভালবাসি। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালবাসি। তাই বাড়ি ছেড়ে যদি কাজে যাই, এমন ছবি করব, যাতে আমার বাড়তি কিছু দেওয়ার থাকবে। অতটুকু দায়বদ্ধতা আমার দর্শকের প্রতিও আছে। তাঁরা আমার ছবি দেখতে এলে যেন দারুণ কিছু প্রত্যাশা করতে পারেন।
প্রশ্ন: প্রায় দু’দশক হয়ে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে। ক’টা ছবি করেছেন, কখনও গুনে দেখেন?
কোয়েল: (হাসি) না, না। আমি একদমই গুনি না। তবে কে যেন আমায় সে দিন বলল, এই মিতিনের ছবিটা আমার নাকি ৫০তম ছবি। শুনে তো আমি হাঁ। মনে হচ্ছিল, ‘এমা এই তো সবে শুরু করলাম, এর মধ্যে ৫০ হয়ে গেল’। তবে পরে ভেবে দেখলাম, এক জন অভিনেত্রীর কেরিয়ারে ৫০টা ছবি মুখের কথা নয়। আমার মনে হয় আমার কাছের লোকেরা জানেন যে, মেয়েটা নিজের কথা অত ভাবে না। তাই তাঁরা আমার জন্য ভাল ভাল ছবি বেছে রাখেন। আপনি বিশ্বাস করবেন না, ২০১৭ সালে আমি একটা ফেসবুকে লাইভ সেশন করছিলাম। একটা প্রশ্ন হঠাৎ আসে, আপনাকে মিতিন রূপে কবে পর্দায় দেখতে পাব। আমি কিছুই ভাবিনি। যে ভাবে নায়িকারা সব প্রশ্নের উত্তর দেয়, আমিও বলেছিলাম, যে দিন প্রযোজক-পরিচালকরা আমায় এই চরিত্রে ভাববেন। (হাসি) তার পর ২০১৯-এ প্রথম মিতিন করি। মনে হয় আমার দর্শকই আমার জন্য আগে স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের ভালবাসার জোরেই তাই এত তাড়াতাড়ি স্বপ্নগুলো সত্যি হয়ে যায়! দর্শকের ভালবাসাতেই আমার এত দূর আসা।
প্রশ্ন: ওটিটি-তে এত ভাল কাজ হচ্ছে। আপনি সেখানে অভিনয়ের কথা ভাবেন না?
কোয়েল: আমি কিন্তু ওটিটি-তে আছি, কিন্তু অন্য ভাবে। ‘আড্ডাটাইমস’ নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। সেখানে খুব ভাল ভাল কিছু কাজ হয়। আমাদের নিজস্ব কয়েক জন চিত্রনাট্যকার রয়েছে। তাঁরা যা লেখেন, সেগুলো আমরা আবার বসে দেখি, দর্শকের কোনটা পছন্দ হতে পারে। গল্প বাছাই করি। আপাতত এই ক্রিয়েটিভ প্রসেসটা খুব উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: আর কোন ধরনের চরিত্র পেলে ওটিটি-তে অভিনয়ও করবেন?
কোয়েল: কেট উইন্সলেটের ‘মেয়ার অফ ইস্ট টাউন’ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কী দাপুটে অভিনয়। দেখে মনে হয়েছিল, ‘আহা এমন চরিত্র যদি পেতাম!’
প্রশ্ন: এ বার পুজোয় তো চারটে ছবির হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। বক্স অফিস নিয়ে আপনি ভাবেন?
কোয়েল: বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ। তাঁকে দেখে বড় হয়েছি। পাশাপাশি দেব। আমার কেরিয়ারের বেশির ভাগ ব্লকবাস্টার ওর সঙ্গে। যিশু (সেনগুপ্ত) আছে, ও আমার ভীষণ প্রিয়। এ দিকে আবীর (চট্টোপাধ্যায়) আছে। সে-ও আমার খুব প্রিয়। বক্স অফিস নিয়ে আমি ১০০ শতাংশ ভাবি। কেন ভাবব না? কিন্তু কোনও রকম লড়াই নিয়ে ভাবি না, বন্ধুত্বের জায়গাটাই বেশি ভাবি। আর দর্শকের জন্য এটা একটা ফিস্টের মতো। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী— চার দিনে চারটে ছবি দেখবেন সবাই। বিরিয়ানি, পোলাও, এগরোল— যাঁর যা পছন্দ, বেছে নেবেন।