অমিতাভ বচ্চনের ‘ডুপ্লিকেট’ দাগ পড়ে গিয়েছিল তাঁর উপর। ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি ছিলেন ‘গরিবের অমিতাভ’। গরিবের সেবা করায় তাঁর এহেন নামকরণ নয়। বরং ব্যঙ্গ করেই লোকে তাঁকে ‘গরিবের অমিতাভ’ বলে ডাকতেন।
অভিনয়ে অত্যন্ত সাবলীল, পর্দায় দু’টি চিরকালীন জনপ্রিয় চরিত্রের মুখ হয়েছিলেন তিনি। তা সত্ত্বেও এই অভিনেতার বড়পর্দার নায়ক হয়ে ওঠা হল না। কখনও নায়কের বাবা তো কখনও শ্বশুর হয়েই রয়ে গিয়েছেন তিনি।
অভিনয় জীবনের অনেকটা অংশ কাটিয়েছেন ‘শরশয্যায়’। তিনি ভারতীয় টেলিভিশনের সবচেয়ে ‘শক্তিমান’। তিনি মুকেশ খন্না।
পাকিস্তান থেকে মুম্বই এসে একটি কাপড় রং করার কারখানা চালাতে শুরু করেছিলেন মুকেশের বাবা। মুম্বইয়ে ১৯৫৮ সালে জন্ম মুকেশের।
পড়াশোনায় মনোযোগী মুকেশ মুম্বইয়ে বড় হলেও কোনও দিন তাঁর বলিউড নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়নি। বরং তিনি বড় হয়ে প্লাস্টিক ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন। সেই মতো নিজেকে প্রস্তুতও করছিলেন।
স্নাতক হওয়ার পর তিনি একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু সামান্য নম্বরের জন্য সুযোগ হারান। তারপরই তিনি ভাইয়ের কথায় নাটকের দলে যোগ দেন।
ক্রমশ অভিনয়কে ভালবেসে ফেলেন মুকেশ। এফটিআইআই-এও পড়াশোনা করেছেন তিনি। তাঁর ভাই তখন একটি ছবি প্রযোজনা করছিলেন। নিজের ছবিতে তিনি মুকেশকে সুযোগ দিতে চেয়েছিলেন। প্রস্তাব গ্রহণ করেননি মুকেশ।
মুকেশ চেয়েছিলেন প্রথম ছবিতে তিনি নিজের অভিনয় ক্ষমতায় সুযোগ করে নেবেন। সেটাই হয়েছিল। এর কয়েকদিন পরই পরিচালক নরেন্দ্র বেদী একটি ছবিতে তাঁকে নেন। যদিও শ্যুটিংয়ের মাঝে পরিচালকের মৃত্যু হওয়ায় সে ছবি মুক্তি পায়নি।
ওই ছবির চিত্রনাট্যের সঙ্গে অমিতাভ বচ্চনের ‘আদালত’ ছবির অনেকটাই মিল ছিল। তার উপর মুকেশের কণ্ঠস্বরও ছিল অমিতাভের মতোই। যে কারণে প্রথম থেকেই ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে নিয়ে একটি নেগেটিভ ধারণা গেঁথে গিয়েছিল।
মনে করা হত, তিনি আসলে অমিতাভের নকল করেন। ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যঙ্গ করে তাঁকে ‘গরিবের অমিতাভ’ বলে ডাকা হতো। শুরু থেকেই দাগ পড়ে গিয়েছিল তাঁর উপর। এতে অনুঘটকের কাজ করেছিল যখন পর পর তাঁর প্রথম চারটি ছবিই মুখ থুবড়ে পড়ে।
পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠেছিল যে ইন্ডাস্ট্রি থেকেই একপ্রকার উধাও হয়ে যান মুকেশ। কোনও চরিত্রের প্রস্তাব নিয়ে তাঁর ফোন আর বেজে উঠত না।
সে সময় বি আর চোপড়া ‘মহাভারত’-এর জন্য উপযুক্ত মুখ খুঁজছিলেন। দুর্যোধনের জন্য অডিশনে ডাক পান মুকেশ। কিন্তু মুকেশ নেগেটিভ চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি ছিলেন না।
তিনি অর্জুন কিংবা কর্ণের চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। দুই চরিত্রের জন্যই মুখ ভেবে ফেলেছিলেন বি আর চোপড়া। মুকেশকে তখন তিনি পিতামহ ভীষ্মের জন্য বেছে নেন।
১৯৮৮-র দুই অক্টোবর থেকে দূরদর্শনের ‘মহাভারত’-এর সম্প্রচার মুকেশের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু এর পর আরও একটা সঙ্কট তৈরি হয় তাঁর সামনে। বয়স্ক চরিত্র করার পর থেকে যে কটা ছবির প্রস্তাব তিনি পাচ্ছিলেন সবেতেই তাঁকে হয় বাবা, নয় শ্বশুরের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছিল। শেষে বিরক্ত হয়ে নিজের প্রোডাকশন সংস্থা খুলে ফেললেন।
নিজের ভাবমূর্তি বদলাতে দূরদর্শনে ‘শক্তিমান’ নিয়ে আসেন। সুপারহিট এই চরিত্র তাঁকে আলাদা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। ধারাবাহিক এত জনপ্রিয় হয় যে তা শুরুর অপেক্ষা করতেন দর্শক।
তাঁকে আদর্শ মনে করে পর্দায় তাঁর দেওয়া উপদেশগুলো মানতে শুরু করেছিল শিশুরা। কিন্তু সঙ্কট যেন পিছু ছাড়ছিল না তাঁকে। পর্দার শক্তিমানকে অনুসরণ করতে গিয়ে নানা দুর্ঘটনার খবর আসতে শুরু করে।
ধারাবাহিকটি বন্ধের জন্য চাপ বাড়তে থাকে মুকেশের উপর। সত্যিই ‘শক্তিমান’-এর জন্যই দুর্ঘটনাগুলি ঘটছিল কি না তা জানতে আদালতে মামলা হয়। মুকেশের বিরুদ্ধে সে সময় প্রচুর নেগেটিভ প্রচারও হয়েছিল।
সব কিছুর সঙ্গে লড়াই করে যতটা পেরেছিলেন ‘শক্তিমান’-কে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দূরদর্শনের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়ে যাওয়ায় ধারাবাহিকের সম্প্রচার তাঁকে শেষমেশ বন্ধ করতে হয়।
সম্প্রতি ৬৩ বছরে পা দিয়েছেন মুকেশ। চলার পথে বারবার সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। কেরিয়ারে বারবার খাঁড়ার ঘা নেমে এসেছে। সব কিছুর পরেও তাঁর জীবন যেন খোলা পাতা। নেটমাধ্যমে সক্রিয় মুকেশ কোনও কিছু বলতেই দ্বিধা বোধ করেন না।
তা সত্ত্বেও তাঁর অনুগামীদের কাছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের একটি বিষয় আজও রহস্যই রয়ে গিয়েছে। মুকেশ বিয়ে করেননি। বিয়ের না করার কারণও জানিয়েছেন। বেশির ভাগ বাড়ির মেয়েদের বিয়ের পর যে ভাবে জীবন কাটাতে হয়, সেটা মানতে পারেন না বলে জানিয়েছেন ‘শক্তিমান’। এই জন্যই তিনি নাকি বিয়ে করেননি। এ উত্তরও হজম হয়নি অনেকের। তাঁকে ‘মহিলাবিদ্বেষী’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল তাই।