মেয়েরাই যে স্বামী বা বয়ফ্রেন্ডের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা—মানেন?
তা আর বলতে...! ছেলেদের মোবাইলের কল লিস্ট, ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্ট চেক করাতে মেয়েদের জুড়ি আছে? ছেলেদের ওপর নেট প্র্যাকটিস করতে করতে মেয়েরাই তো এখন সবচেয়ে দক্ষ গোয়েন্দা (হাসতে হাসতে)।
ফেলুদা, ব্যোমকেশ, শবর, কিরীটী... পুরুষ-গোয়েন্দাদের পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মেয়ে-গোয়েন্দা কিন্তু একমাত্র আপনিই... সে টিভিই হোক বা...
জি বাংলার একটা অ্যাওয়ার্ড সেরিমানিতে এই নিয়েই একটা দারুণ মজার দৃশ্য করলাম। স্টেজে ব্যোমকেশ বলছে, ‘‘আমার কোনও ‘কেস’ নেই’’, ফেলুদা বলছে, ‘‘আমাকে তুমি সত্যি সত্যিই ‘ফেলু’ বানিয়ে দিলে’’... ফেলুদা-ব্যোমকেশের পৃথিবী... সেটা ওঁরাও ভেবেছেন।
‘গোয়েন্দা গিন্নি’ তো কয়েক মাস হল শুরু হয়েছে। তা বেশ ক’বছর কিন্তু আপনাকে আমরা বাংলা ছবিতে মিস করেছি। মাঝে কখনও ‘অংশুমানের ছবি’ বা ‘তখন তেইশ’...এই পর্যন্ত।
(হেসে) কী করে দেখবেন? ছ’বছর মুম্বইতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলাম। ‘সুজাতা’, ‘মর্যাদা’, ‘মা শক্তি’, ‘সাবিত্রী’— একটার পর একটা হিন্দি সিরিয়াল করে গেছি। বাংলায় দেখবেন কী করে?
তবু... সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত বা শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের ছবিতে আপনার মতো জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রীকে কি একটি বারের জন্যেও দেখা যেতে পারত না? গত কয়েক বছর ধরে তো বাংলা ছবিতে কত রকমের এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে!
(মিষ্টি হেসে, একটু ভেবে নিয়ে) আসলে ওঁরা যখন এগোতে শুরু করেছেন...ঠিক সেই সময়টাতেই আমি মুম্বই চলে যাই। মাঝে দুটো-একটা কথা যে হয়নি তা নয়... থাক।
তবে সকলের সঙ্গেই আমার আলাপ আছে। আশা করি ওঁরা জানেন, আমি কী পারি, না পারি।
এটা কোনও কথা হল! ‘তেরো পার্বণ’ থেকে ‘দহন’—মানুষ কি জানে না আপনার অভিনয় সম্পর্কে?
আসলে সকলেরই একটা দায়িত্ব থাকে। যেমন ধরুন, সৃজিত-কৌশিকরা অত্যন্ত গুণী পরিচালক। এঁদের সেই গুণকে দায়িত্ব নিয়ে সম্মান দিয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের মতো বড় ব্যানাররা। তেমনই এঁদেরও দায়িত্ব থাকে শিল্পী-মানুষদের কথা ভাবার। যাতে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কাজ পান। তাই না?
তাই তো সোজাসুজি জানতে চাইছি, এঁরা কখনও আপনার কাছে কোনও চরিত্র অফার করেননি?
বেশ কিছু আগে সৃজিতের সঙ্গে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল... ও জানতে চাইল, আমি এখন কলকাতায় থাকছি কি না। বললাম, থাকছি। বলল, তা হলে নিশ্চয়ই একসঙ্গে কাজ হবে।
তার কিছু দিন পরেই ‘রাজকাহিনী’ হল। প্রায় এক ডজন অভিনেত্রী কাজ পেলেন। আমাকে হয়তো মনে পড়েনি সেভাবে কিংবা ওঁর মনের মধ্যে আমি সেভাবে দানা বাঁধতে পারিনি।
শিবপ্রসাদও ‘বেলাশেষে’ ছবিতে একটা চরিত্রের জন্য বলেছিল। আমি ওঁদের বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। তার পরে কী যে হল... জানি না।
কী বলছেন? ইন্দ্রাণী হালদারের অভিনয় নিয়ে কোনও সংশয় আছে? ‘গোয়েন্দা গিন্নি’তে রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আপনি তো কত সময় সম্পূর্ণ একাই অভিনয় করে যাচ্ছেন ক্যামেরার সামনে। অন্য গোয়েন্দাদের মতো কোনও সহকারীও নেই আপনার...
সত্যিই মাঝে মাঝে কুড়ি-বাইশ পাতা টানা মুখস্থ বলতে হচ্ছে। তার ওপর ক্যামেরার টাইট ক্লোজআপ (থেমে)।
তবে হ্যাঁ, বহু দিন বাদে কলকাতায় কাজ করে দারুণ আনন্দ পাচ্ছি। এত জনপ্রিয় হয়েছে চরিত্রটা...বিশেষ করে বাচ্চারা এত নিয়েছে। ক’দিন আগে ‘নীরজা’ দেখতে গেছি... কয়েক জন ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে আমার কাছে চলে এল ‘গোয়েন্দা আন্টি-গোয়েন্দা-আন্টি’ বলতে বলতে। ওদের বাবা-মায়েরা দেখি একটু দূরে দাঁড়িয়ে হাসছেন। লস এঞ্জেলেসে থাকে অর্ঘ্য নামের একটি ফুটফুটে বাচ্চা। ক’দিন আগে কলকাতায় এসেছিল। আমাকে ‘গোয়েন্দা গিন্নি’র একটা জলরঙের ছবি নিজে হাতে এঁকে দিয়ে গেছে।
‘গোয়েন্দা গিন্নি’র জন্যেই কি কলকাতায় চলে এলেন?
না না। আমি গত তিন বছর ধরেই কলকাতায় রয়েছি। ২০১৪-য় কোনও কাজ করিনি। অনেকগুলো দেশ ঘুরলাম। ইউরোপ, এশিয়ার অনেকগুলো জায়গা... ভারতেরও অনেক জায়গা... বলতে পারেন, এ বার কলকাতায় থাকব প্ল্যান করেছি বলেই ‘গোয়েন্দা গিন্নি’র অফারটা নিলাম।
হঠাৎ মুম্বই ছেড়ে এ রকম ভাবে চলে আসার কারণ?
আমার বরের শরীরটা ভাল না, সুগার... আমিও একটু থামতে চাইছিলাম...একটু হালকা থাকতে চাইছিলাম। আমার নিজেরও শরীরটা... ব্যাক পেন... তা ছাড়া ভাস্কর (স্বামী) এখানে, আমি ওখানে...এ ভাবে আর হচ্ছিল না।
খুব ব্যক্তিগত একটা প্রশ্ন করব?
হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন।
আপনারা স্বামী-স্ত্রী কি স্বেচ্ছায় সন্তান চাননি?
ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয় জানেন। কিছু দিন আগে ‘আরও একবার’ ছবিটা করার সময় ঋতুপর্ণাও আমাকে বলেছিল এই ব্যাপারটা।
আসলে বয়স যখন ছিল, তখন নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। আর এখন তো কত রকম ভাবে সন্তানের জন্ম দেওয়া যায়...আমি ভাস্করের সঙ্গে আলোচনাও করেছিলাম। ও বলল, ‘দ্যাখো, আমি প্রায় পঞ্চান্ন...যাকেই পৃথিবীতে আনি...তার প্রতি ঠিক সুবিচার হবে না। ’
তাই আমরা ঠিক করেছি, যে-ই আগে যাই না কেন, যে থাকবে, সে-ই পাটুলির বাড়ি, নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাট, টাকা-পয়সা সবই কোনও আশ্রমে দান করে দেবে। এমনিতেও কয়েকজন বাচ্চার পড়াশোনার খরচ ইত্যাদি চালাই... সেগুলো বলতে চাই না।
(ভেবে)... আমার সঙ্গে ভাস্করের বয়সের তফাত অনেকটাই। যদিও আমি জানি আমার আয়ু কম। যাই হোক, অত্যন্ত বেশি ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে—বিষয়টা বরং থাক।
পাটুলিতে আপনার বাড়ি আছে?
হ্যাঁ, চার তলা। ‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড উইনার’ কোটায় পেয়েছিলাম জমিটা।
আচ্ছা একটু অন্য বিষয়ে যাই?
তাই ভাল।
হিন্দি সিরিয়াল করে আর্থিক ভাবে থিতু হয়ে তার পর নীড়ে ফিরলেন, তাই তো? মুম্বইতে থাকতেন কোথায়?
লোখান্ডওয়ালায়।...আর আর্থিক ভাবে থিতু? তা এক রকম বলতে পারেন।
তবে হিন্দিতে সিরিয়াল করলে ওরা টাকা যেমন দেয়, তেমনই পিষে কাজও বার করে নেয়। দিনের মধ্যে আঠেরো ঘণ্টা, কুড়ি ঘণ্টা কাজ। বড় মেকআপ রুম, দামি গাড়ি, ফ্ল্যাট...সব দেবে। কিন্তু তুমি ‘বন্দিনী কমলা’। স্টুডিও ছেড়ে বেরোনোর উপায় নেই। ওখানেই বন্দি (হেসে)।
তবে আপনি বলছিলেন না, বাংলা ছবিতে আমাকে মিস করেছেন। জানেন, এই হিন্দি সিরিয়ালের জন্য অবাঙালি কমিউনিটির কাছে
কী সাংঘাতিক জনপ্রিয় আমি। বিদেশের বঙ্গ সম্মেলনে গিয়েছি— সেখানে পঞ্জাবি, গুজরাতিরা নিজে থেকে এসে আলাপ করেছেন আমার সঙ্গে।
তার মানে আপনি নিজে বাংলা সিনেমা মিস করেননি?
জানেন, আমার বরকে আমি ‘চাণক্য’ বলি। ওর সিদ্ধান্তগুলো এত ঠিকঠাক হয়। ‘গোয়েন্দা গিন্নি’র সময়েও স্টার প্লাসে একটা অফার ছিল। ভাস্কর বলল, ‘‘একটু বাংলায় থাকো না।’’ থেকে গেলাম। ভালই তো হল।
মুম্বইতে থাকার সময় এতটাই ঢুকে গিয়েছিলাম যে আর বেরোতে পারিনি। মিস করলেও কিছু করার ছিল না।
আচ্ছা, মহিলা গোয়েন্দা হিসেবে মিস মার্পল। বাংলায় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসি। ‘শুভমহরৎ’-এর রাঙাপিসি। আর এখন আপনি ‘গোয়েন্দা গিন্নি’তে পরমা।
‘পরমা’ নামটা লক্ষ করুন। বাড়ির বৌ হয়েও যে নিজের অস্তিত্ব খোঁজে। আমার চরিত্রটা দেখুন। বাড়ির বড় বৌ, কিন্তু রহস্যের সমাধান
করে চলেছে সব বাধা পেরিয়ে। শাশুড়িকে সামলে।
কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন— সব গোয়েন্দাদের একজন সহকারী থাকে। যার কাছে গোয়েন্দারা কথা বলে রহস্যের সমাধান শেয়ার করেন। কিন্তু আপনার কোনও সহকারী নেই!
সেই জন্যেই তো পাতার পর পাতা স্ক্রিপ্ট ক্যামেরার সামনে অভিব্যক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হয়। আমার সহকারী একমাত্র ক্যামেরা! (হেসে)
আপনি দেখছি চিরকালই জুটিহীনতায় ভুগেছেন। তাই না? শতাব্দীর যেমন তাপস পাল। ঋতুপর্ণার যেমন প্রসেনজিৎ। পরে রচনা-প্রসেনজিৎও জুটি হয়। কিন্তু আপনার সে ভাবে কোনও জুটিই ছিল না। আজও কোনও সহকারী নেই।
একেবারে ঠিক বলেছেন। সত্যিই সে ভাবে কোনও জুটিই পাইনি। ঋতুপর্ণা যখন প্রসেনজিতের সঙ্গে একের পর এক ছবি করছে, আমি তখন করেছি, ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’, ‘ফালতু’। আমার জুটি বাবা-মেয়ের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে (হাসি)।
আচ্ছা, আপনি সবই বলছেন, কিন্তু কিছুতেই যেন নিজের দুঃখ বা অভিমান মুখ ফুটে বলতে চাইছেন না। কী ভাবে যেন সব কিছু আড়াল করছেন!
তাই?
সৃজিত, শিবপ্রসাদের কথা বলতে গিয়েও বললেন না। তার পর বাংলা ছেড়ে মুম্বই গিয়ে বাংলাকে মিস করেছেন কি না, সেটাও খুলে বলছেন না। অথচ বুঝতে পারছি, ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ করে কলকাতার আরামটা পাচ্ছেন।
(জোরে শ্বাস নিয়ে) দেখুন, আমি কখনও ইগো-টিগো নিয়ে থাকিনি। সকলকেই দেখা হলে সোজাসুজি বলে দিই যে, আমি কাজ করতে চাই। আমি খুব পরিশ্রমী। তার পরেও যদি কেউ না চান, কিচ্ছু করার নেই।
এ বার যেমন ‘ভেঙ্কটেশ ফিল্মস’ আমাকে সুযোগ দিল। এর পরে হয়তো পরিচালকরাও নিশ্চয়ই ভাববেন। দিন তো ফুরিয়ে যায়নি।
তবে অভিমান আমার কয়েকটা আছে ঠিকই।
কী?
ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) ওপরে ছিল। ‘দহন’-এর পর আমাকে আর সুযোগই দিল না। ঋতুদা না হয় চলে গেল। কিন্তু রিনস্ (অপর্ণা সেন)?
‘পারমিতার একদিন’-এ রিনস্ আমাকে একটা গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স করতে বলেছিল। করেছিলাম। ব্যস ওই পর্যন্তই। কিন্তু রিনস্ চাইলে কি আমাকে একটা ছবিতেও কাস্ট করতে পারত না?
এত ছবি তো পরিচালনা করেছে!
তাই আজও আমার কাছে রহস্যই থেকে গেল, রিনস্ কেন আমাকে আর কাস্ট করল না!