বাংলা বনাম বলিউডে জিতল কারা? গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
পান্তা ভাতে টাটকা বেগুনপোড়া! বাঙালির এতেই সুখ। বিরিয়ানির লোভ ভিতরে থাকলেও কালেভদ্রে বেপাড়া (ভিন্ন সংস্কৃতি) থেকে তার স্বাদ পায় বঙ্গবাসী। গরিব বাঙালির মতোই টলিপাড়ার দশা। বাংলা বিনোদন দুনিয়া অল্পের উপর সেই পান্তাভাতেই খুশি।
এ বছর দুর্গাপুজোয় অবশ্য ছবি দেখার হিড়িক ছিল বেশি। আরজি কর-কাণ্ড, চিকিৎসকদের আমরণ অনশন সেখানে কোনও ছেদ ঘটায়নি, এই যা রক্ষে! কিন্তু শেষরক্ষা হল কই? ছবির টিকিট বেচা আর লাভের মুখ দেখা কি এক কথা?
পঞ্চমীতে মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবির রিপোর্ট কার্ড একাদশীতে যখন প্রকাশ পেল, তখন সেই লক্ষ-কোটির হিসাব বুঝতে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল ছবির এক পরিবেশকের সঙ্গে। মুখ খোলার আগেই তিনি প্রথম শর্ত দিলেন, নাম প্রকাশ করা যাবে না। শর্ত মেনে নেওয়ায় প্রকাশ্যে এল রিপোর্ট কার্ড। পরিবেশকের কথা অনুযায়ী, এক সপ্তাহে ‘টেক্কা’র আয় ২.৫ কোটি । ‘বহুরূপী’ আয় করেছে ৩ কোটি। ‘শাস্ত্রী’ ৮০ লক্ষ। প্রসঙ্গত, এ বছরের পুজোয় তিনটি বাংলা ছবির সঙ্গে দুটো হিন্দি ছবি মুক্তি পেয়েছে। আলিয়া ভট্টের ‘জিগরা’ এবং রাজকুমার রাওয়ের ‘ভিকি বিদ্যা কা উও ওয়ালা ভিডিয়ো’ ছবিদু’টি ২.৫ কোটি করে আয় করেছে।
কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে দক্ষিণী ছবির হাজার কোটির ক্লাব, বলিউডি ছবির ৩০০ কোটি ক্লাবের রমরমা। প্রশ্ন ওঠে, তিন-চার কোটি ব্যবসা নিয়ে বাঙালি তা হলে কোথায় দাঁড়াবে?
সম্প্রতি সৃজিত মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজার অনলাইনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সাধারণত একটি ছবি মুক্তির কয়েক দিন পরে ব্লকবাস্টার হয়। ‘টেক্কা’ ছবি এক জায়গাতেই শুট হয়েছে। তাই তার খরচ কম। ছবির নির্ধারিত স্যাটেলাইট আয় এক কোটি। ওটিটি আয় এক কোটি। ছবি তৈরিতে যা খরচ, ইতিমধ্যে তার চেয়ে মোট দু’কোটি টাকা বেশি আয় হয়েছে ছবির। তাই বক্স অফিসে ছবি যা পাচ্ছে তার পাশাপাশি স্যাটেলাইট আয় এবং ডিজিটাল আয় মিলিয়ে ‘টেক্কা’ খুব অল্প সময়েই ব্লকবাস্টার। পাশাপাশি, তিন দিনে বক্স অফিস অনুযায়ী দেড় কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে ‘টেক্কা’।”
তিন দিনে দেড় কোটি টাকার ব্যবসা মানে দেড় কোটির মুনাফা? বিষয়টা এত সহজ নয়। নিভৃতে থাকা এক প্রযোজক হিসাব আরও পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, “উদাহরণস্বরূপ ধরে নিই, কোনও ছবির এক কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। তার মানে কখনওই ধরে নেওয়া যায় না, ছবিটি এক কোটির ব্যবসা দিয়েছে।” এ প্রসঙ্গে অনলাইন টিকিট বিক্রির একটি ওয়েবসাইটের পরিসংখ্যান তুলে ধরছে আনন্দবাজার অনলাইন। নবমীর সকালে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ‘বহুরূপী’র টিকিট বিক্রি ২৩ হাজার অতিক্রম করে গিয়েছিল। সেখানে এক দিনে ‘টেক্কা’র টিকিট বিক্রি হয়েছিল ১৪ হাজারের কিছু বেশি। মঙ্গলবার দেখা যাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ‘বহুরূপী’র টিকিট বিক্রি হয়েছে সাড়ে ১১ হাজার।
তা হলে একটি ছবির মুনাফার হিসাব দর্শক বুঝবেন কী করে? “কোনও ছবি ১০ কোটি আয় করলে ধরে নেওয়া যেতে পারে ৫ কোটি প্রযোজকের ঘরে ঢুকল। সেখানেই তাঁর লাভ”, বক্তব্য সেই প্রযোজকের। এ দিকে, পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে ১০ কোটি টাকার বেশি টিকিট বিক্রির নজির নেই!
আরও গভীরে যাওয়া যাক। আঞ্চলিক ভাষার ছবি কেমন করেই বা জাতীয় স্তরের ছবির মাপকাঠিতে বিচার্য হবে?
‘বহুরূপী’ ছবিতে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কৌশানী মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, কেরলের ভিন্ন ধারার ওটিটির ছবি, যেখানে বড় তারকা নেই, নিছক মনোরঞ্জনের জন্য গানও নেই— সেই ছবিও সাত কোটি টাকা আয় করে। বাংলা ছবি সেই লাভের মুখ দেখছে না কেন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক প্রযোজক বলেছেন, “দক্ষিণে ১২০০টি স্ক্রিন। কলকাতায় ১১২টি। এই পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে কেন একটি দক্ষিণী আর্ট ফিল্ম সাত কোটি টাকা আয় করে, বাংলা ছবি পাঁচ কোটি।” তাঁর মতে, কলকাতা বা বাংলায় একই সংখ্যক স্ক্রিন থাকুক। বাংলা ছবিও তা হলে একই আয় করবে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই প্রযোজকের দ্বিতীয় উদাহরণ, উত্তর কলকাতার একটি অঞ্চল। আগে সেখানে সাতটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল। পাঁচটি বন্ধ হয়ে প্রেক্ষাগৃহ সংখ্যা এখন দুই। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, এ ভাবে একের পর এক প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেলে কী করে বাংলা ছবি কোটির ক্লাবে ঢুকবে?
নিজেই সেই উত্তর দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “ছবির মান নয়, রাজ্যের বা শহরের আর্থিক পরিকাঠামো এর জন্য দায়ী। যে পরিমাণে ছবি তৈরি হয় সেই পরিমাণে প্রেক্ষাগৃহ থাকলে বাংলা ছবির বাণিজ্য়ের ছবিটাও বদলে যেত।” পাশাপাশি, বাণিজ্যিক আয় ধরেও একটি হিসেব দিয়েছেন তিনি। তাঁর মতে, “সাধারণত, সাড়ে পাঁচ কোটির উপরে আয় করলে সেই বাংলা ছবি ‘ব্লকবাস্টার’। সেই ছবিই ১০ কোটির বেশি আয় করলে ‘অলটাইম ব্লকবাস্টার’-এর তকমা পায়।”
পরিচালক অতনু ঘোষের কাছে অবশ্য ব্লকবাস্টারের সংজ্ঞাই আলাদা। তিনি বলেছেন, “মাপকাঠি এক হলে এটাও মনে রাখতে হবে, হিন্দি ছবি সারা দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরেও মুক্তি পায়। তখন ব্যবসা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০ কোটি। বাংলা ছবি কিন্তু এই বাজার পায় না। শুধুই ব্যবসা বা বাজেট নয়, কোনও ছবির ট্রেন্ড যদি ইতিবাচক হয় সেই ছবিটিও কিন্তু সিনেমার পরিভাষায় ব্লকবাস্টার।” তিনি উদাহরণ হিসাবে ‘দোস্তোজী’ বা ‘মানিকবাবুর মেঘ’-এর নাম করেছেন। যুক্তি, এই ধরনের ছবি দর্শক প্রচুর পরিমাণে দেখতে গিয়েছেন। এতে ছবির ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে। তাই, ১০০ কোটি বা ৫০০ কোটির ঘরে না গিয়েও আঞ্চলিক ভাষার ছবির ট্রেন্ড মেনে ছবি দুটো ‘ব্লকবাস্টার’।
কোটি ক্লাবের গল্প নিয়ে মতামত দিয়েছেন আরও এক প্রযোজক। তাঁরও শর্ত, নাম প্রকাশ করা যাবে না। এই শর্তে তাঁর বক্তব্য, “হিন্দি ছবি যদি ১০০ কোটিতে ব্লকবাস্টার হয় তা হলে বাংলা ছবি কিন্তু ৫ কোটিতেই সেই তকমা পাবে।” কেন পাবে তার সবিস্তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি, “জাতীয় স্তরের মার্কেট যত বিস্তৃত, বাংলা ছবির মার্কেট ততটাই ছোট। ওখানে তাই যত সংখ্যক ছবি মুক্তি পায় বাংলায় সেটা অসম্ভব। তাই ওখানকার ১০০ কোটির সমান আমাদের পাঁচ কোটি।” তা হলে একটি ছবির মুকুটে হিট, সুপারহিট, ব্লকবাস্টার পালক জুড়বে কী হিসাবে? প্রযোজকের ঘরে ছবি তৈরির টাকা ঢুকলেই কি এই তকমাগুলো জুড়বে? না কি, আরও বাড়তি অর্থ যুক্ত হলে এই তকমাগুলো পাওয়া যাবে?
‘শাস্ত্রী’ ছবিতে মিঠুন চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
এ বার প্রযোজকের সাফ বক্তব্য, “প্রথম সপ্তাহে কখনওই ছবি তৈরির টাকা প্রযোজকের ঘরে ফেরত যেতে পারে না। পুরোটাই প্রচার কৌশল। প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানার অনেক পদ্ধতির একটি। যাঁরা বলেন তিন দিনে বাংলা ছবি লাভের মুখ দেখছে তারা ঠিক বলেন না। ”
স্বীকারোক্তির পাশাপাশি তিনি এ-ও জানিয়েছেন, যিনি সাত দিনের মধ্যেই কোনও ছবিকে ‘ব্লকবাস্টার’ ঘোষণা করছেন তিনি সঠিক কথা বলছেন না। এই ধরনের বক্তব্য দর্শকদের আদতে বিভ্রান্ত করে। এই প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন বলিউডের হিন্দি ছবি ‘স্ত্রী ২’-এর। কলকাতায় ছবিটি ২২ কোটির বেশি ব্যবসা করেছে, এই প্রচারের সত্যতা নিয়ে তিনি যথেষ্ট সন্দিগ্ধ। প্রযোজকের দাবি, তিন কোটি টাকায় তৈরি একটি বাংলা ছবি কম করে সাত কোটি টাকা ব্যবসা করলে তবে গিয়ে সেটি ব্লকবাস্টার। এবং এই আয় ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ একটানা না চললে কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।
বাঙালিকে বিরিয়ানির স্বাদ পান্তাভাতেই মেটাতে হল। ‘বহুরূপী’ আর ‘টেক্কা’ বক্স অফিসের নিরিখে আপাতত বাংলার পাতে টাটকা বেগুনপোড়ার কাজ করল।
(সংশোধনী: এই প্রতিবেদনে আনন্দবাজার অনলাইনকে ‘ব্লকবাস্টার’ বাংলা ছবির উদাহরণ প্রসঙ্গে পরিচালক অতনু ঘোষ ‘দোস্তোজী’ এবং ‘মানিকবাবুর মেঘ’ ছবির নাম উল্লেখ করেননি। এর ফলে যদি কোনও বিভ্রান্তি তৈরি হয়ে থাকে, তার দায় আনন্দবাজার অনলাইনের। অনিচ্ছাকৃত এই ত্রুটির জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।)