শ্রীভূমির স্টুডিও ওয়ার্ল্ডে মান্নাদার রেকর্ডিং চলছে। সালটা ২০১০। মান্নাদার শেষ বেসিক ৮টা গান। মান্নাদার নিজেরই সুর। সেদিন মান্নাদা রেকর্ড করছিলেন আমারই লেখা গান ‘গভীর রাতে ক্লান্ত চোখে ঘুমায় যখন দিন’। টেকনিকাল কোনও কারণে রেকর্ডিস্ট রুদ্র বলল— ‘‘দাদা, এই জায়গাটা আর একবার গাইলে ভাল হয়।’’ মান্নাদা বললেন, ‘‘কোন জায়গাটা?’’ রুদ্র গানের একটা কিউ দিল। গানের লাইনটাও একটু গেয়ে শোনাল। শুনে মান্নাদা তো অবাক। বললেন, ‘‘আপনি তো সুন্দর গান করেন। আবার রেকর্ডিংও করছেন।’’ যাই হোক, রেকর্ডিং শেষ হল। মান্নাদা এত খুশি হলেন যে, রুদ্রকে দু’পাতার প্রশংসাবাণী লিখে দিলেন। গানগুলো মান্নাদা রেকর্ডিং করেছিলেন নিউ ইয়র্ক ও বাংলাদেশের বাঙালিদের উদ্যোগে। রেকর্ডিং-এর পর প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেল। মান্নাদা বারবার বলতেন, কেন ওরা সিডি-টা প্রকাশ করছে না! মূল উদ্যোক্তার ফোন নম্বরও দিয়েছিলেন আমাকে। আমি নিউ ইয়র্কে সেই উদ্যোক্তার সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলাম। তিনি শুধু বললেন, ‘‘এখনও প্রকাশ হয় নাই’’। বড় দুঃখ লাগে যখন ভাবি, মান্না দে-র মতো শিল্পীর সুর করা এবং গাওয়া শেষ আটটি গান বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে। মান্নাদা নিজেই অ্যালবামটির নাম দিয়েছিলেন ‘গানে গানে পরিচয়’।
বর্তমান সময়ে কে কেমন গাইছে, মান্নাদা বিলক্ষণ সে সব খবর রাখতেন। একদিন বললেন, ‘‘সোনু নিগম ছেলেটা বড় ভাল গায়। গলাটা খুব সুন্দর, গানটাও জানে। যে কোনও সময় জন্মালেই ও একই রকম সাকসেসফুল হত। হ্যাঁ, আমাদের সময়ে যদি গাইত, তবে ওর সঙ্গে একটু লড়াই করতে পারতাম।’’ ১ মে মান্নাদার জন্মদিন। প্রতি বছর ওই দিন কলকাতায় অনুষ্ঠান হয়। ২০১০ পর্যন্ত মান্নাদা নিজেই ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। গানে গানে মাতিয়ে রাখতেন শ্রোতাদের। ম্যাডাম অসুস্থ হবার পরে আর কলকাতায় আসতে পারেননি। কলকাতা থেকে উদ্যোক্তারা জানালেন, এ বছরও অনুষ্ঠান হবে। মান্নাদার প্রিয় সব গীতিকার-সুরকার-গায়ক-গায়িকা অনুষ্ঠানে আসছেন। মান্নাদা আগ্রহের সঙ্গে সব শুনলেন। তারপর বললেন, ‘‘ঠিকই আছে। এদের সঙ্গে শম্পা কুণ্ডুকেও রাখতে পারেন। খুবই ভাল গায়।’’ নচিকেতার ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ছিল মান্নাদার প্রিয় গান।
বহু দিন বাদে সায়েন্স সিটিতে মান্নাদা ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের একসঙ্গে অনুষ্ঠান হচ্ছে। গ্রিনরুমে মান্নাদা আর অজয় চক্রবর্তী গল্প করছেন। দুই কিংবদন্তির গান শুনতে কলকাতার প্রায় সব নামকরা শিল্পীই এসেছেন। এক সময় শুভমিতা মান্নাদাকে প্রণাম করতে এল। প্রণাম করে চলেও যাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘‘দাদা, ইনি শুভমিতা। খুব ভাল গান করে।’’ মান্নাদা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘আচ্ছা আচ্ছা! বসুন। আপনার গান আমি শুনেছি। ভারী ভাল গান আপনি।’’ এ রকমই একদিন কথায় কথায় লোপামুদ্রার প্রসঙ্গ উঠল। মান্নাদা বললেন, ‘‘ও একটা বিশেষ ধরনের গান করে। একটু ‘রাগাশ্রয়ী’ গানই বেশি করে। তবে আমার ধারণা, রোম্যান্টিক গানও খুব ভাল গাইবে। আমি তো ওর গলায় ‘আমার পরাণ যাহা চায়’ শুনে অবাক হয়ে গিয়েছি। কী ভাল গেয়েছে গানটা!’’ শুনে আমি অবাক। বুঝলাম, সত্যিই মান্নাদা সব খবরই রাখেন।
মান্নাদার কাছাকাছি যে যতটা যেতে পেরেছে, কিছু না কিছু শিক্ষালাভ তার হয়েছে। গীতিকার যে-লেখাটি সুরকারকে দেন, সেই লেখাটির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল ছন্দ। সুরের মেরুদণ্ড তো ওই ছন্দই। একবার মান্নাদাকে কিছু লেখা পাঠিয়েছি। গানগুলো পড়ে মান্নাদা বললেন, ‘‘লেখা তো ঠিক আছে, তবে আপনি ‘দাদরা’বাবুকে একটু বেশি ভালবেসে ফেলেছেন। কাহারবা, তিনতাল, তেওড়া—ওদের কথাও একটু ভাবুন। নইলে ওরা তো রাগ করবে।’’ সেদিন থেকে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। একই ছন্দে বেশি লেখা হয়ে যাচ্ছে। এদিকটা খেয়াল রাখতে হবে।
‘যত দিন বাঁচি তত দিন শিখি’— এই আপ্তবাক্যটি মান্নাদা রপ্ত করেছিলেন তাঁর কাকা তথা সংগীতগুরু কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। একদিন প্রভাসবাবু (মান্নাদার অনুজ)-কে নিয়ে প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছেন কাকা। হঠাৎ দূর থেকে কীর্তনের আওয়াজ ভেসে এল। বড় সুমধুর সেই গান। প্রভাসবাবুকে কাকা বললেন সেই গায়ককে ডেকে আনতে। গায়ক এলেন। তাঁকে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে কাকা অনুরোধ করলেন একদিন আসতে। তো সেই কীর্তনিয়া বংশীধারী চট্টোপাধ্যায় একদিন কাকার বাড়িতে এলেন। কাকা তাঁকে সোজাসুজি বললেন, ‘‘আপনার গান আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। আমি আপনার কাছে কীর্তন শিখতে চাই।’’ শুনে বংশীবাবুর তো ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। তখন কাকার ভারতজোড়া নাম। তাঁর গাওয়া ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু’, ‘কালো লোকে বলে’, ‘নবদ্বীপের শোভন’—এমন সব কীর্তনে মজে আছে সারা বঙ্গদেশ। বংশীবাবুর তো সংকোচে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। তিনি যত ‘না- না’ করছেন, কাকা তত বলছেন ‘শেখাতেই হবে’। শেষ পর্যন্ত কাকার জেদের কাছে হার মেনে বংশীবাবু শেখাতে রাজি হলেন। এ রকমই ছিল কাকার শেখার আগ্রহ। যাঁর কাছ থেকে যতটুকু নেওয়া যায়, নিয়ে নাও। গুরু কত বড়, অনেক ক্ষেত্রে সেটা নির্ভর করে শিষ্য কেমন ভাবে এবং কতটা শিক্ষা নিতে পারছে তার ওপর। এ জন্য একই গুরুর সব শিষ্য সমান পারদর্শী হয় না। জীবন এবং গানের প্রতিপদে মান্নাদা অনুসরণ করেছেন কাকাকে। বড় বড় ওস্তাদদের কাছে সংগীতশিক্ষা করেছেন, সুযোগ পেলেই রেডিওতে অন্য শিল্পীদের গান শুনেছেন। তাঁদের গায়কির বিষেশত্ব লক্ষ করতেন। এ সবই ছিল তাঁর শিক্ষার অঙ্গ।
পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড লাইব্রেরিতে মান্নাদার আত্মজীবনী প্রকাশের অনুষ্ঠান। প্রকাশ করবেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক শংকর এবং পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। একঘর প্রেসের লোক। মান্নাদা বললেন, ‘‘বয়সটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। থাকিও অনেক দূরে সেই বেঙ্গালুরুতে। নইলে খুব ইচ্ছে ছিল অজয়বাবুর কাছে ঠুংরিটা একটু ভাল করে শিখি। এ কথা শুনে তো অজয়বাবু বেশ বিব্রত। মান্নাদা কিন্তু অন্তর থেকেই কথাটা বলেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে সাহিত্যিক শংকর একটা দারুণ কথা বলেন—‘‘আমি হাওড়ায় যেখানে থাকি, সেখানে তো মশায় শুধু চোর-ডাকাতদের বাস। রোজই খুনখারাপির খবর। আর মান্নাদা কোথায় জন্মেছেন দেখুন। একই বাড়িতে কৃষ্ণচন্দ্র দে, একই পাড়ায় স্বামী বিবেকানন্দ, একটু এগিয়ে রবীন্দ্রনাথ। খুব কাছে রামমোহন রায়, গিরিশ ঘোষ। এমন পুণ্যস্থান কলকাতায় আর কোথাও নেই।’’
মান্নাদার মতো এত বাস্তববাদী মানুষ আর দুটি নেই। যুগের স্বাভাবিক পরিবর্তনে খাপ খাওয়াতে না পেরে হা-হুতাশ করতে করতে অনেক শিল্পীই বাধ্য হয়ে অবসর নিয়েছেন। মান্নাদা ছিলেন একেবারে অন্য ধাতুতে গড়া। গান-বাজনার প্রতিটি পরিবর্তনকে খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। আমার লেখা ও তাঁর নিজের সুরে পুজোর শেষ অ্যালবাম (২০০৭) ‘ঠিক ছবির মতো’-র আটটি গানই মূলত মিউজিক ট্র্যাকের সঙ্গে ডাবিং করেছিলেন।
শিল্পী আসেন, শিল্পী যান। জীবনের মতো শিল্পেরও এমনই ধর্ম। মান্নাদা এটা মানতেন। কেরিয়ারের প্রথম দিকে কিশোরকুমার যখন অভিনয় করতেন, তখন তার হয়ে গান করতেন মান্নাদা। কিশোরকুমার শুধু লিপ দিতেন। সেই কিশোরকুমার পরে গায়ক হিসেবে কোথায় উঠে গেলেন। মহম্মদ রফি এক সময় মান্নাদার গানে কোরাস গাইতেন। সেই রফিও গায়ক হিসেবে সঙ্গীতের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিলেন। মান্নাদা এ সব কিছুই সহজ ভাবে মেনে নিতেন। কিশোরকুমার যখন অন্য গায়কদের ছাপিয়ে গেল তখন কিন্তু মহম্মদ রফি সেটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি মান্নাদাকে বলতেন, ‘‘এ কেমন গান করে কিশোর! কোনও হরকত নেই, শুধু চিৎকার করে।’’ মান্নাদা বোঝালেও তিনি বুঝতেন না। আফশোস করতে করতে খুব অল্প বয়সেই চলে গেলেন তিনি। মান্নাদা কিন্তু শান্ত ও অবিচল ভাবে আরও বহু বছর গান শুনিয়ে গেলেন।