নবাগত বাঙালি অভিনেতার পক্ষে বলিউডে কাজ পাওয়া কত কঠিন? উত্তর দিলেন দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সোহম মজুমদার।
‘দেব ডি’র চুন্নিলাল দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য। এক জন বাঙালি। ‘পাতাললোক’-এর হাথোড়া ত্যাগী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও এক বাঙালি। ‘কবীর সিংহ’-এর বন্ধু শিবা সোহম মজুমদার। তিনিও এক জন বাঙালি।
একটা সময় ছিল, যখন বলিউডের বাঙালি মানেই উঠে আসত একগুচ্ছ পরিচালকের নাম। আর অভিনেতা মানে জয়া বচ্চন থেকে মিঠুন চক্রবর্তী হয়ে রানি মুখোপাধ্যায়। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এখন বলিউডে কাজের পরিসর বেড়েছে। করোনা বা লকডাউন সেই পরিসরকে আরও বিস্তৃত করেছে। এখন দেশের বৃহত্তম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গেলে ‘সোর্স’, ‘ফরসা ত্বক’, ‘সাইজ জিরো’ বা ‘সিক্স প্যাক অ্যাবস’ আর আবশ্যিক শর্ত নয়। সহজ কথায়— বিগত কয়েক বছরে বলিউড প্রতিভার কদর করতে শিখেছে।
দার্জিলিং থেকে দিঘা— পশ্চিমবঙ্গে প্রতিভার অভাব নেই। এই ২০২২ সালের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নবাগত বা উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাঙালি অভিনেতার পক্ষে বলিউডে কাজ পাওয়া কত কঠিন? স্বপ্নপূরণের আগে কী কী পদক্ষেপ করা প্রয়োজন? প্রশ্ন তুলেছিল আনন্দবাজার অনলাইন। উত্তর দিয়েছেন আপাতত বলিউডের তিন জনপ্রিয় বাঙালি অভিনেতা— দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সোহম মজুমদার।
কলকাতার ছেলে দিব্যেন্দুর বলিউড সফর শুরু হয়েছিল মীরা নায়ার পরিচালিত ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবিতে। ‘মকবুল’, ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’, ‘চিটাগং’-এর মতো ছবি বা ‘সেক্রেড গেমস’ ও ‘জামতাড়া’ ওয়েব সিরিজ তাঁর সিন্দুকের কিছু মণিমানিক্য মাত্র। দিবেন্দ্যুর মতে, প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় বসলে ফল ভাল হবেই। আর মুম্বইয়ে ভাগ্যান্বেষণের আগে সেই প্রস্তুতি তাঁর ছিল। দিব্যেন্দু বলছিলেন, ‘‘১৯৮৮ সাল থেকে টানা ছ’বছর কলকাতায় গ্রুপ থিয়েটার করেছি। তার পর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা হয়ে মুম্বই। তাই আমি কিন্তু একদম তল্পি গুটিয়ে বম্বেতে হাজির হইনি। আমার কোনও শর্টকাট ছিল না।’’
মুম্বইতে এখন কাস্টিং ডিরেক্টরদের রাজত্ব। বলা হয়, একমাত্র তাঁদের পছন্দ হলে মিলতে পারে অভিনয়ের সুযোগ। বিষয়টায় কিছুটা হলেও আপত্তি রয়েছে দিব্যেন্দুর। তিনি বলছিলেন, ‘‘শুরুর দিকে আমরা সরাসরি পরিচালকদের সঙ্গে দেখা করতাম। তাঁরা সরাসরি কাস্ট করলে একটা মনের জোর পাওয়া যেত। বিক্রম ভট্ট, কেতন মেহতা, সুধীর মিশ্র, অনুরাগ কাশ্যপ তো আমাকে তাঁদের ছবিতে সরাসরি কাস্ট করেছিলেন।’’ তা হলে এখন পার্থক্যটা কোথায়? ইন্ডাস্ট্রিতে ২২টি বসন্ত কাটিয়ে-ফেলা দিব্যেন্দুর জবাব, ‘‘ধরা যাক আপনার অডিশন কাস্টিং ডিরেক্টরের পছন্দ হল না। আপনি আর সুযোগ পেলেন না। কিন্তু ওই একই অডিশন তো পরিচালকের পছন্দ হতেই পারত। এখন বলিউডে অভিনেতা ও পরিচালকের মধ্যে তাই দূরত্ব বেড়েছে।’’
দিব্যেন্দুর বলিউড সফর শুরু হয়েছিল মীরা নায়ার পরিচালিত ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবিতে। ছবি: সংগৃহীত।
পাশাপাশিই দিব্যেন্দু স্বীকার করছেন, এখন তিনি মুম্বইয়ে কেরিয়ার শুরু করলে অনেক বেশি সুবিধা পেতেন। তাঁর কথায়, ‘‘তখন শুধুই ছবি। ভাল অভিনেতারাও নায়কের ভাই বা বন্ধুর চরিত্রে রাজি হতেন। এখন কাজের সংখ্যা বেড়েছে। তাই কাজ পেতে নতুনদের লড়াইটাও একটু সহজ হয়েছে।’’ নতুনদের জন্য তাঁর পরামর্শ, ‘‘আমার কেরিয়ারের ৯০ শতাংশ কাজ বিনা অডিশনে পেয়েছি। হাতে ছবি নিয়ে প্রযোজনা সংস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কখনও কখনও চৌকিদারের হাতেও ছবি দিয়ে আসতাম। তাই এখনকার পদ্ধতি নিয়ে খুব বেশি জানি না। এটুকু বলতে পারি, বিভিন্ন কাস্টিং এজেন্সি এবং কাস্টিং ডিরেক্টরদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। অডিশন দেওয়া বন্ধ করলে চলবে না।’’ সেই সঙ্গে দিব্যেন্দু এ-ও জানাচ্ছেন যে, ইন্ডাস্ট্রির এখনকার ‘নিয়ম’ মেনে কোনও চরিত্রের জন্য অডিশন দিতে তাঁর কোনও আপত্তি নেই।
নতুনদের জন্য একটি সহজ রাস্তার সন্ধান দিতে চান দিব্যেন্দু। তিনি জানাচ্ছেন, এখন বলিউডে এক জন কাস্টিং ডিরেক্টরের প্রচুর সহকারী প্রয়োজন হয়। তাই নতুনরা সেই কাজে যুক্ত হলে সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি হবে। বেহালার বাসিন্দা বলছিলেন, ‘‘এই ভাবে অডিশনের তারিখ জানা বা কোনও চরিত্রের কী কী প্রয়োজন সেগুলো জানা যায়। শর্ত মিলে গেলে সে নিজেও সেই চরিত্রে অডিশন দিতে পারে।’’
ওয়েব সিরিজ ‘পাতাললোক’-এর দুর্ধর্ষ খুনি ‘হাথোড়া ত্যাগী’। খড়্গপুরের ছেলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই একটা পরিচিতিই যথেষ্ট। ছবি: সংগৃহীত।
ওয়েব সিরিজ় ‘পাতাললোক’-এর দুর্ধর্ষ খুনি ‘হাথোড়া ত্যাগী’। খড়্গপুরের ছেলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই একটা পরিচিতিই যথেষ্ট। হালে মুক্তি পাওয়া ‘ভেড়িয়া’ ছবিতেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত। নতুনদের জন্য অভিষেকের প্রথম পরামর্শ— সাবলীল হিন্দি। তিনি বলছিলেন, ‘‘অনেক বাঙালি ছেলেমেয়েদের দেখেছি হিন্দি বলতে গিয়ে একটা বাঙালিসুলভ টান আসে। কলেজজীবনে নাটক করার সময় আমার মধ্যেও এই দোষটা ছিল। তাই আগে নিজের হিন্দির উপর জোর দিতে হবে।’’
অভিষেক নিজে ‘কাস্টিং ডিরেক্টর’ হিসেবে তাঁর বলিউডযাত্রা শুরু করেছিলেন। মুম্বইয়ে এখন কাজ পাওয়ার অন্যতম শর্ত অডিশন। বাংলার কোনও অভিনেতা কী ভাবে সেই অডিশনের মঞ্চে হাজির হবেন? অভিষেকের জবাব, ‘‘আমার তো অভিনয় শুরু করতে ১০ বছর সময় লেগে গেল! এখন তো বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় বসেও এখন বলিউডের কাজ পাওয়া সম্ভব। কারণ, এখন অনলাইনেও অডিশন দেওয়া যায়। বাংলা থেকে কোনও অভিনেতাকে নির্বাচন করতে হলে তো আমরা অনলাইনেই অডিশন নিয়ে থাকি।’’ তবে পাশাপাশিই অভিষেক মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, মুম্বইয়ে কাজ করতে হলে নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘বাঙালিদের পড়াশোনা বেশি, তাঁরা জানেনও বেশি। কিন্তু মুম্বইয়ে কাজ করতে হলে শুরু থেকেই আমাদের বাঙালি পরিবারের কমফোর্ট এবং ইগো ছাড়তে হবে। নতুন জায়গার কাজের ধরন যত কেউ তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে, ততটাই মসৃণ হবে আগামীর পথচলা।’’
‘কবীর সিংহ’ ছবিতে সুযোগ পাওয়াকে নেহাতই ‘কাকতালীয়’ বলে ব্যাখ্যা করতে চান সোহম। ছবি: সংগৃহীত।
শোনা যায়, মায়ানগরীতে কাজ পেতে হলে নাকি ‘পকেটের জোর’ থাকতেই হয়। অভিষেক মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কী ছিল? নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। টাকাপয়সা প্রায় কিছুই ছিল না। শুধু মাত্র পরিশ্রম আর অভিনয়ের প্রতি প্যাশন রেখেই এখানে পৌঁছেছি। আমি যদি করতে পারি, তা হলে যে কেউ করতে পারবেন!’’
সোহম মজুমদার বলিউডে সে তুলনায় নতুন বাঙালি মুখ। কাজ করছেন টলিউডেও। কার্তিক আরিয়ানের ‘ধামাকা’র খলনায়ক থেকে ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি’ ছবিতে ঋতাভরী চক্রবর্তীর সহজ-সরল স্বামী— দর্শকের কাছে স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরি করে নিয়েছেন সোহম। তবে ‘কবীর সিংহ’ ছবিতে সুযোগ পাওয়াকে নেহাতই ‘কাকতালীয়’ বলে ব্যাখ্যা করতে চান সোহম।
২০১৭ সালে ডিজ়নি প্রযোজিত ‘আলাদিন’ নাটকের অডিশনে নির্বাচিত হওয়ার পর শোয়ের জন্য পাঁচ মাস মুম্বইয়ে ছিলেন সোহম। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও একটা শোয়ের দিন হঠাৎ করেই ‘কবীর সিংহ’র অডিশনের জন্য ডাক আসে। শুধু জানতাম, ছবিতে শাহিদ কপূর রয়েছেন। ওটাই ছিল মুম্বইয়ে আমার প্রথম অডিশন।’’
কিন্তু ঘটনা হল, সেই অডিশনটা সোহমের দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ভেবেছিলেন, নাটকের চাপে পারবেন না। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চার পাতার সংলাপ মুখস্ত করা! তা-ও আবার হিন্দিতে! সোহম বলছিলেন, ‘‘ভাবিনি নির্বাচিত হব। ১০ দিন পর জানতে পেরেছিলাম আমাকে নেওয়া হচ্ছে। গর্ব নয়, এগুলো বলছি কারণ, মুম্বইয়ে কখন কী ভাবে সুযোগ আসবে, কেউ বলতে পারবে না।’’
সোহমও মানছেন, বাংলা থেকে মুম্বইয়ে কাজ করতে হলে আগে নিজের হিন্দির উপর জোর দিতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘আরও একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত। বাইরে থেকে এসে চটজলদি প্রচারের আলো চাইলে অবশ্যই ভাল কনট্যাক্ট প্রয়োজন। কিন্তু বলিউডে অভিনয় করতে এলে তার একটা কাঠামোও রয়েছে।’’ কী সেই কাঠামো? সোহমের কথায়, ‘‘এখানে মুকেশ ছাবড়া, টেস জোসেফের মতো কাস্টিং ডিরেক্টররা রয়েছেন। তাঁদের সংস্থায় গিয়ে নিজের বায়োডেটা জমা দেওয়া যায়। অনলাইনেও বায়োডেটা জমা দেওয়া যায়। আরও একটা বিষয়— সকলেই কাজ পান। কারণ, এখন বলিউডের ভাল কাস্টিং ডিরেক্টরদের হাতে যে কোনও সময়ে চার-পাঁচটা ছবির কাজ চলে। তাই নিরাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই।’’
কলকাতায় প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিভার বিচ্ছুরণে অনেক সময়েই বাধা হয়ে দাঁড়ায় ‘আলস্য’। সেটা কাটাতে সোহমের টিপস্, ‘‘অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের কোনও স্কিল উন্নত করা যেতে পারে। গান শেখা বা কারাটে শিখলে সেটাও কোনও দিন কাজে লেগে যেতে পারে।’’ সেই প্রসঙ্গেই বলছিলেন, ‘‘হালে আমার একটা অডিশন ওদের পছন্দ হল। কিন্তু চরিত্রটা সেতার বাজায়। আমি বলেছিলাম, শিখে নেব। কিন্তু এতটাই কম সময় ছিল, যে কাজটা শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হল!’’
‘কাস্টিং কাউচ’ শব্দবন্ধের প্রভাব থেকে এখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি বলিউড। পুরুষ, বিশেষত মহিলাদের জন্য কতটা নিরাপদ এই ইন্ডাস্ট্রি? সোহম বলছিলেন, ‘‘সব ইন্ডাস্ট্রির ভাল-খারাপ রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমাকে তেমন কোনও আপত্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।’’ কিন্তু নতুনদের প্রতারণার ফাঁদ থেকে সাবধান করতে চান সোহম। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক প্রলোভন আসবে। বলা হবে, মোটা টাকার বিনিময়ে সব শিখিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু শেষে দেখা যাবে, কিছুই শিখতে পারলেন না! তাই মুম্বইয়ে কাজ পাওয়ার জন্য অন্তত কাউকে টাকা দেওয়া উচিত নয়।’’ বরং অভিনয়ের জন্য স্থানীয় ওয়ার্কশপের মূল্য তাঁর কাছে অনেক বেশি। সোহমের কথায়, ‘‘কলকাতায় অনেকেই প্রকৃত অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ করান। সেখানে তা-ও কিছু শেখা যায়। কাজের সুযোগও আসে। বলিউডে কাজ করতে গেলে অভিনয়টা আসলে জানতেই হবে!’’