কী ভাবে বোঝা যাবে কোনও প্রযোজনা বাণিজ্যসফল, না কি ব্যর্থ? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শহরের বুকে কোন সিনেমা কত লম্বা রেসের ঘোড়া, তা বলে দেবে বক্স অফিসের পাল্লা। কিন্তু নাটক? কোনটি ভাল ইনিংস খেলছে, বুঝবেন কী ভাবে? আপাত ভাবে প্রেক্ষাগৃহের সব আসন ভর্তি মানেই সেই প্রযোজনা হিট? নাটকের অন্য অঙ্ক নিয়ে কী বলছেন শহরের তাবড় নাট্যপরিচালকেরা, খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
বেশির ভাগ নাট্যব্যক্তিত্বই থিয়েটার আর বাণিজ্যকে আলাদা রাখতে চান। আবার কেউ কেউ সম্প্রতি নাটকেই লক্ষ্মীলাভের পথ দেখাচ্ছেন। কোন পথ শ্রেয়, কোন পথ থিয়েটারের আদর্শ— সে তর্ক মুলতুবি রেখে আপাতত তাকানো যাক অ্যাকাডেমি, মধুসূদন মঞ্চ কিংবা গিরিশে। শহরের এই মুহূর্তের সর্বাধিক জনপ্রিয় কয়েকটি প্রযোজনার নাম চোখ বুজে বলে দিতে পারবেন হালের দর্শক। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে সেই বিচার? শুধুই নাট্যগুণ, না কি নেপথ্যে ব্যবসায়িক ফলও?
দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নবীনতম প্রযোজনা ‘খোক্কস’-এর চাকচিক্য মুগ্ধ করেছে দর্শককে। ঠিক এর আগে ‘হয়বদন’ও বিপুল জনপ্রিয় হয়েছিল। সব শো-ই হাউসফুল! তা হলে কি দারুণ ব্যবসা করেছে দু’টি নাটকই? আনন্দবাজার অনলাইনকে দেবেশ বললেন, ‘‘ব্যবসা করব ভেবে তো থিয়েটারটা করি না। শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠ থেকে যদি কোনও কাজ করা যায়, সে কাজ এমনিই বাণিজ্যিক সাফল্য আনে। শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে হলে সেই সৃষ্টি ব্যর্থও হতে পারে।’’
তা হলে কী ভাবে বোঝা যাবে কোনও প্রযোজনা বাণিজ্যসফল, না কি ব্যর্থ?
দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
দেবেশের মতে, বোঝার কোনও নির্দিষ্ট এবং ফলিত উপায় নেই। নির্ভর করে দর্শকের উপর। ২০০২ সালে যখন ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ পরিচালনা করছেন, দেবেশের মনে হয়েছিল দু’টির বেশি শো হবে না এই নাটকের। দর্শক এ ধরনের গভীর নাটক দেখবেন না বলেই ধারণা ছিল তাঁর। পরিচালকের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে রমরম করে দেড়শো শো হয়েছিল সেই নাটকের। গত দু-আড়াই দশকের অন্যতম ‘হিট’ নাটক হিসাবে ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই পরিচালকেরও।
সুজন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
চেতনার নতুন নাটক ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’-রও একের পর এক শো হাউসফুল । সেটিই কি এই মুহূর্তে ব্যবসার দিক থেকে সফলতম নাটক? পরিচালক-অভিনেতা সুজন মুখোপাধ্যায় জানালেন, একেবারেই না। যত অর্থ এই প্রযোজনায় বিনিয়োগ করেছেন তার কাছাকাছি ফেরত আসতে বছর ঘুরে যেতে পারে। তার পর তো লাভের কথা! সুজন ফিরে গেলেন ইতিহাসে। তাঁর মতে, দীর্ঘ কাল পেশাদার থিয়েটার এবং গ্রুপ থিয়েটারের দু’টি ধারা সমান্তরাল ভাবে থেকেছে কলকাতা শহরে। থিয়েটারে ব্যবসার জায়গা ছিল। চলচ্চিত্র থেকে পেশাদার অভিনেতা এনে টাকা লগ্নি করা হত। সেই থিয়েটার আজ আর নেই।
সুজনের মতে, সিনেমায় ব্যবসার জায়গাটা অনেক বেশি, লাভ-ক্ষতির অঙ্কও জটিল। থিয়েটারে ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ বেশি। বললেন, ‘‘থিয়েটারে কোনও কাস্টিং ডিরেক্টর নেই বলেই গান্ধীর চরিত্রে আমি অনির্বাণ চক্রবর্তীকে ভাবতে পারি। সিনেমার ক্ষেত্রে আরও দশ রকম ভাবনা চলে আসবে। জানি না, সেখানে কেউ অনির্বাণকে গান্ধী হিসাবে ভাববে কি না।’’
থিয়েটারের হিট-ফ্লপের সঙ্গে কাজের মানের সম্পর্ক সব সময় নেই বলেই মনে করেন সুজন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অনেক বড়, ভাল কাজ দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারেননি বলে হারিয়ে গিয়েছে। আবার কোনও কাজ নিরীক্ষামূলক হলেও দর্শক গ্রহণ করেছেন।’’ তাঁর প্রযোজনায় ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’ নাটকের দু’টি শো হয়েছে। দর্শক প্রতিক্রিয়ায় ‘হিট’ বলা চলে এই নাটককে, কিন্তু বাণিজ্যিক ভাবে এখনই নয়।
বরং সুজন জানালেন, তাঁরই পরিচালিত ‘মাগন রাজার পালা’ নাটকটির বিপুল ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা। ৫৫টি শো হয়েছে নাটকটির। বেশির ভাগ কল শো, সঙ্গে নিজেদের শো-ও রয়েছে। তবে, ‘মাগন রাজার পালা’র প্রোডাকশন কস্ট অল্প বলে খরচ উঠে আসে সহজেই, ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’ ব্যয়বহুল নাটক বলে আরও বহু শো করতে হবে।
কৌশিক সেন। ছবি: সংগৃহীত।
কত টিকিট বিক্রি হচ্ছে তার হিসাব থেকে কি নাটকের লাভ-ক্ষতি বিচার করা যায়?
অভিনেতা-নাট্যপরিচালক কৌশিক সেন জানালেন, যায়। অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে যখন, অনায়াসেই সাধারণ দর্শক একটা সামগ্রিক ছবি পেতে পারেন। তবে লাভ দেখতে গেলে নাটক করা যায় না। তাঁর কথায়,‘‘অন্য ধারার থিয়েটারের ঐতিহ্য দর্শক সমাগমের বিচারে হিট-ফ্লপের হিসাব কষতে তৈরি হয়নি। কতটা নিরীক্ষামূলক কাজ করা যায় মঞ্চে, সেটা ভেবেই এই থিয়েটারের জন্ম। তার সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতিরও একটা যোগসূত্র আছে।’’
কৌশিক বলে চলেন, ‘‘আশির দশকের মাঝামাঝি অনেক নিরাপদ নাটক করা হয়েছে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার আবহে। নব্বই দশকে আমার সতীর্থরাই শহরে এবং মফস্সলে থিয়েটারকে নতুন ভাষা জুগিয়েছেন। গৌতম হালদারের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘গন্তব্য’ বা ব্রাত্য বসুর ‘অশালীন’ এর দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে একটা স্বরও উঠে আসছিল। তৈরি হচ্ছিল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। যা না থাকলে শিল্পচর্চা করা সম্ভবই নয়।’’
তবে থিয়েটারে লাভ-ক্ষতির সার্বিক কোনও খতিয়ান নেই বলেই মনে করেন কৌশিক। তাঁর মতে, যে কোনও শিল্পচর্চার পিছনেই অর্থনৈতিক চাপ রয়েছে। তবে থিয়েটার যেমন সে অর্থে উপার্জনের চওড়া রাস্তা দেখাতে পারে না, তেমনই কোনও প্রযোজকের কাছে জবাবদিহি করার দায়ও নেই বলে সে ভাবে হিট-ফ্লপের তত্ত্বও থিয়েটারে খাটে না। তাই এখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ অনেক বেশি।
দেবেশেরও মত, থিয়েটারে বাণিজ্যিক হিসাব কষা সম্ভব নয়। তবে তাঁর নিজস্ব একটা হিসাব আছে। প্রথম দু’টি শো সব সময়েই হিট হয় দেবেশের। তার পর দর্শকসংখ্যা পড়তির দিকে হলে বুঝে নেন, সেই নাটকের বাণিজ্যসফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আবার ব্যতিক্রমও ঘটে। দেবশঙ্কর অভিনীত ‘ইয়ে’ নাটকটির দর্শকসংখ্যা প্রথম দু’টি শোয়ের পর কমে এলেও সপ্তম শো থেকে দর্শক আবার হলমুখী হয়েছিলেন। সেই অর্থে হিটও হয় নাটকটি।
তবে মাথায় রাখতে হবে, দর্শক এলেই সব নাটক দীর্ঘ দিন ধরে করা যায় না। দেবেশ বলেন, ‘‘‘সওদাগরের নৌকো’-তে বড় বড় অভিনেতা ছিলেন। হিট প্রযোজনা, এখনও কল শো পাই, কিন্তু রিহার্সাল করতে পারি না বলে বন্ধ করে দিয়েছি। এটা মৃত নাটক বলে মনে হয়, এটার শো করা অর্থহীন।’’
অন্য দিকে, রমরমিয়ে ‘হ্যামলেট’ করে চলেছে কৌশিকের দল স্বপ্নসন্ধানী। দু’বছর ধরে চলছে এই প্রযোজনা, তার পরও জনপ্রিয়তায় কমতি নেই। প্রতি বার হাউসফুল। একে কি হিট নাটক বলা যায়? কৌশিক জবাবে বললেন, ‘‘‘হ্যামলেট’-এ হাউসফুল বোর্ড ঝুলতে দেখলে ভাল লাগে। তবে আমি যে থিয়েটারের আবহে বড় হয়েছি, সেখানে আমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারি যে, কাজটা আমি ভাল করেছি, তবে দশ জন দর্শক এলেও সেই প্রযোজনাকে আমি ‘হিট’ বলব।’’
তবে ‘হ্যামলেট’ যে সেই অর্থে হিট, তা মেনে নিলেন কৌশিক। জানালেন, পাঁচ-সাত বছর আগেও কল শো-র নিরিখে হিট-ফ্লপের একটা ধারণা পাওয়া যেত। আগে নানা অফিস ক্লাব, রিক্রিয়েশন ক্লাবের আমন্ত্রণে অনেক শো হত। অনেক কল শো হলে বোঝা যেত, নাটকটা হিট। যদিও কৌশিকের মতে, থিয়েটারের কর্মপদ্ধতিটা ভিন্ন। দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে সংযোগ তৈরি না-হলে প্রযোজনার কোনও অর্থ নেই।
কৌশিকের সাফ কথা, লোক কম হলেই কোনও থিয়েটার ততটা উৎকৃষ্ট নয়, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই, আবার হাউসফুল মানেই সেটা সফল থিয়েটার, এমন সহজ সমীকরণেও পৌঁছতে চাইছেন না তিনি।
কিন্তু থিয়েটারের সঙ্গে ব্যবসা জুড়লে ক্ষতি কী? হাতের কাছেই যে রয়েছে জলজ্যান্ত উদাহরণ। সুদীপ্তা চক্রবর্তী অভিনীত ‘বিনোদিনী অপেরা’! দর্শকের উন্মাদনা খেয়াল করলে বোঝা যায়, ঐতিহাসিক এক নারীই জোয়ার এনেছেন সাম্প্রতিক বাংলা থিয়েটারে। প্রযোজনাটির নাম নেওয়া মাত্র অবশ্য তিন পরিচালকের কেউই এর প্রভাব অস্বীকার করলেন না। তাঁদের দাবি, প্রযোজক নিয়ে বাণিজ্যিক ভাবে একটি নাটক পরিকল্পনা করা হলে সেটিও এক ধরনের নিরীক্ষা বটে। আবেগের দিক থেকে নাটকের বিষয়বস্তু দর্শকের মন ছুঁয়েছে, তবে অন্য কোনও প্রযোজনার ক্ষেত্রে এই ফর্মুলা বিফলেও যেতে পারে!
অবন্তী চক্রবর্তী। ছবি: সংগৃহীত।
কী সেই ফর্মুলা? ‘বিনোদিনী’ কি ঢাল-তলোয়ারে সজ্জিত হয়েই একেবারে ময়দানে নেমেছেন? ‘বিনোদিনী অপেরা’র পরিচালক অবন্তী চক্রবর্তী অবশ্য অন্য কথা বললেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমি শুধু চেয়েছিলাম বিনোদিনীকে নিয়ে একটা জমজমাট পালা তৈরি করব। দর্শকের এত ভাল লাগবে, ধারণাই ছিল না! শৈল্পিক উৎকর্ষের পাশাপাশি মানুষের আবেগকে ছুঁতে চেয়েছিলাম। সেটা হয়েছে বলে আমি খুশি।’’
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য কি তবে কিছুই ছিল না? অবন্তীর মতে, দর্শকের গ্রহণযোগ্যতা থাকলেই থিয়েটারে একমাত্র ব্যবসা সম্ভব। তা হলে শহর জুড়ে যে কানাঘুষো, প্রযোজকের সহায়তায় নাটক হয়েছে? সে তথ্য কি ভুয়ো? অবন্তী জানালেন, খানিকটা তো তাই। জট কাটাতে স্পষ্ট করে বললেন, ‘‘শুরুতে দু’জন প্রযোজক এসেছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা থাকেননি। প্রাথমিক ভাবে প্রোডাকশনের খানিকটা খরচ উঠেছিল বটে, কিন্তু বিনোদিনী নিজের গুণেই পর পর শোয়ে অর্থ তুলে নিচ্ছে, সাহায্যের আর প্রয়োজন পড়ছে না।’’
অবন্তীর মতে থিয়েটারের সঙ্গে বাণিজ্যের বিরোধ নেই। ‘বিনোদিনী অপেরা’র ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় জীবনে প্রথম বার তিনি থিয়েটার দল গঠন করার কথা ভেবেছেন। আঙ্গিক নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁর। পরবর্তী প্রযোজনায় আনতে চলেছেন ‘হ্যামলেট’। বহু চর্চিত এবং অভিনীত শেক্সপিয়রের নাট্য নিয়েও নতুন নিরীক্ষায় আত্মবিশ্বাসী তিনি। তাঁর মতে, অর্থ বিনিয়োগ করে যদি ভাল নাটক হয় শহরে, হোক না! অবন্তী বললেন, ‘‘যদি আবার প্রযোজকরা ফিরে আসেন থিয়েটারে, স্বাধীনতা দিয়ে যদি টাকা ঢালেন, পরিচালক এবং অভিনেতার কাজের জায়গাটা যদি তৈরি করে দেন, তবে মন্দ কী? ‘বিনোদিনী অপেরা’ তো প্রমাণ করেছে যে, ভাল নাটক হলে লোক আসবে।’’
যদি শিল্পগুণের সঙ্গে সমঝোতা না-করে এমন নাটক নির্মাণ করা যায়, তবে প্রযোজকদের আসা উচিত বলেই মনে করেন অবন্তী। নাটকের হিট বা ফ্লপের বিচারের ক্ষেত্রে অবন্তীও জোর দিলেন উৎকর্ষে। তাঁর মতে, নাটকের মান এবং দর্শকের গ্রহণযোগ্যতা একটা বিন্দুতে মিশলে তবেই আদর্শ থিয়েটারের পরিবেশ গড়ে ওঠা সম্ভব। তাই বলে দর্শক হল না মানেই নাটক খারাপ, এমনটা ভাবার কারণ নেই। অল্প দর্শকের মাঝেও দুর্দান্ত মঞ্চায়নের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। বললেন, ‘‘সে নাটক ফ্লপ বলি কী করে!’’