নাটকের একটি দৃশ্যে বিনয় পাঠক-সহ অন্য কুশীলবরা।
জুটিটা সেই ভেজা ফ্রাইয়েরই। কিন্তু নাটক ভিন্ন। আঙ্গিক আলাদা। ভাষাও পৃথক। মুখের, শরীরেরও। গুয়াহাটি থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের প্রথম দিনে মঞ্চস্থ হল রজত কপূর পরিচালিত ও বিনয় পাঠক অভিনীত, ‘হ্যামলেট-দ্য ক্লাউন প্রিন্স’। শেক্সপিয়রের বহুপঠিত, বহুচর্চিত ট্র্যাজেডিকে আদ্যন্ত কমেডির মোড়কে ঢেলে যে মুন্সিয়ানায় দু’ঘণ্টার বাঁধনে মঞ্চ মাতালেন নেইল ভূপালন, বিনয় পাঠক, সুজয় সাপলে, নমিত দাস, পূজা স্বরূপরা তাতে পাঁচ দিনের নাট্যোৎসবের সুর তারসপ্তকে বাঁধা হয়ে গেল।
ডেনমার্কের রাজপুত্রের গল্পকে মঞ্চস্থ করবে জোকারের দল। মুখড়াতেই সংলাপ বদলে গুয়াহাটি ও ব্রহ্মপুত্রকে মঞ্চে ঢুকিয়ে দেন বিনয়। ইতালীয় ও ফরাসি ভাষার খিচুড়ি কাটিয়ে কুশীলবরা যখন ইংরেজিতে ঢুকলেন তত ক্ষণে দর্শকেরাও জোকারদের নো-ননসেন্স ভাষা বুঝতে শুরু করে দিয়েছেন। নাটকের মধ্যে নাটকে প্রথমেই পরিচালকের সাফ কথা, শেক্সপিয়রের ওই দাঁতভাঙা ভাষা, অতি দুঃখ ভারাত্রান্ত, চার ঘণ্টার নাটক এখন কেউ দেখতে চান না। তাই দুঃখ, হিংসা, যৌনতা, প্রতিশোধ, রক্তপাতকে সকলের মুখ চেয়ে ছ্যাবলামিতে বদলে ফেলা হচ্ছে।
হ্যামলেটের পর্দা উঠতেই আলো-আঁধারে বিনয় পাঠকের ইতালীয়, ফরাসি ও উদ্ভট শব্দ মেশানো স্বগতোক্তি। ওই অদ্ভুতুড়ে ভাষার মিশেল চলল পরের ১২০ মিনিট ধরে। মূল সংলাপ, পানিং, পাঞ্চলাইনগুলো তার মধ্যে অতীব মুন্সিয়ানায় স্পষ্ট ইংরেজিতে কানে পৌঁছে দেন অভিনেতারা।
দু’ঘণ্টার নাট্যঝড়ে সকলের শরীরের ভাষা, প্রতিক্ষণে সব অভিনেতার কিছু না কিছু অভিব্যক্তি, স্বগতোক্তি, সোসো-বুজোর ঝগড়া, পলোনিয়াসের প্রহসন, কখনও ফিডো, কখনও কিং ক্লডিয়াস বনে যাওয়া নেইলের জাম্প-কাট দর্শকদে হাসায়, ভাবায়। ট্রাজেডি হলেও, এই হ্যামলেটে কান্নার স্থান নেই। যৌনতা নিয়ে ব্যঙ্গ বা নারীর কষ্টের কথায় হাততালি পড়লেই হ্যামলেট ওরফে সোসো ওরফে বিনয় মনে করিয়ে দেন, এত তালি মারার দরকার নেই। এ মজার নাটক, সামাজিক নাটক নয়। অভিনেতারা সংলাপের মধ্যে দরকার হলেই ঢুকিয়ে ফেলেন সামনে বসা দর্শকদেরও। কারও টাক, কারও মোমের মতো পা, কারও বা পাশে বসা সঙ্গীকে নিয়ে চলে অমলিন ব্যঙ্গ।
এ ভাবেই মঞ্চ মাতালেন নেইল ভূপালন, বিনয় পাঠক, সুজয় সাপলে, নমিত দাস, পূজা স্বরূপরা।
বাঁধা সংলাপ তা-ও মনে রাখা যায়, কিন্তু নাগাড়ে বলতে থাকা জিবরিস বা খিচুড়ি ভাষা মনে রাখার মূলমন্ত্র কী? দর্শক অবাক, যখন নাটক শেষে পরিচালক জানান, নাটকের অধিকাংশ অংশেই কোনও লিখিত চিত্রনাট্য বা সংলাপ নেই। যত এগোচ্ছে শো, তাল মিলিয়ে বদলাচ্ছে তাঁদের জোকারদের ভাব ও ভাষা। দীর্ঘ কালের প্রশিক্ষণে শিল্পীরা অপেরা গাওয়ার সাহস দেখান, দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু পূজা ও নমিত যে অপূর্ব দক্ষতায় প্রশিক্ষণ ছাড়াই অপেরা গাইলেন, পূজার মতে তা কেবল ‘জোকার দেবতা’র আশীর্বাদ!
‘সি ফর ক্লাউন’, ‘হ্যামলেট’ বা ‘নাথিং লাইক লিয়ার’— সবেতেই কিন্তু রজতের সিগনেচার স্টাইল হয়ে উঠছে জোকাররা। কিন্তু কেন এত জোকার? রজত বলেন, “অনেক দিন থেকেই আমার নাটকগুলোয় সব বার্তা জোকাররাই দিচ্ছে। মনে হয়, চ্যাপলিন, নির্বাক আমেরিকার কমেডি, বাস্টার কিটন দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। আসলে এ ভাবে নাটক করলে সিরিয়াস কাহিনীতেও অনেক স্বাধীনতা আদায় করে নেওয়া যায়। নিজের বক্তব্য মজা করে বলা যায়।”
—নিজস্ব চিত্র।