ঠিক পাশের ঘরটাতে থাকেন। প্রেস বক্স থেকে নিয়মিত পরিষ্কার দেখাও যায়। কখনও ঠিক উপরের তলায়। দশ-বারোটা সিঁড়ির দূরত্বে। অথচ তাঁকে ছোঁওয়ার উপায় নেই। কথা বলার তো নেই-ই।
লর্ডস থেকে সিডনি। অ্যাডিলেড থেকে এজবাস্টন। গত পঁচিশ বছরে অন্তত তিনবার রিচি বেনো অভিযানে গিয়ে প্রতিবার প্রথম বলে বোল্ড। অন্য কেউ হলে বলত, ‘‘না, ভাই, আমি ইন্টারভিউ দিই না।’’ তিনি রিচি বেনো। সংক্ষিপ্ততম অভিব্যক্তির জন্য দুনিয়া জুড়ে খ্যাত। মুখটা নেড়ে বলেছিলেন, ‘‘দিই না।’’ দিই না-টা এমন অনুচ্চারিত চূড়ান্ততার সঙ্গে বলা যে, তার উপর আর কোনও আবেদন চলে না।
এক এক সময় অসহায় হয়ে মনে হত, এর চেয়ে তো সুচিত্রা সেনও ভাল! সুচিত্রাকে দেখাই যায় না। তাঁর ইন্টারভিউ না পাওয়া নিয়ে হতাশা তৈরি হলেও সেটা এমন সর্বগ্রাসী নয়। এই ভদ্রলোক হাতের কাছে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। টিভিতে দিব্য কথা বলছে। পরের পর স্টুডিয়ো শো হোস্ট করছে। অথচ জীবনে কখনও দাঁড়িয়ে দুটো কথাও বলল না। ‘দিই না’ ব্যাস গল্প শেষ। এই ব্যর্থতা রাখি কোথায়!
ছবি সৌজন্য: মার্ক গ্রেগ
দু’জনেই উপরে: টনি আর তিনি
বহুবছর বিদেশে বসবাসকারী কলকাতার প্রবীণ এক চিকিৎসাশাস্ত্রের অধ্যাপক একবার বেনোর ধারাভাষ্যে সামান্য ক্ষুণ্ণ হয়ে ওঁকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সৌরভের ভারত তখন অস্ট্রেলিয়ায় খেলছে। প্রাক-ইন্টারনেট যুগ না হলেও দুমদাম ইমেল অ্যাড্রেস পাওয়া যায় না। ক্যুরিয়ারের ভূমিকা এককথায় সাগ্রহে পালন করেছিলাম এই দুরাশায় যে, বাড়িতে ক্যুরিয়ার এলে তো অনেক সময় লোকে তাকে জল মিষ্টি এগিয়ে দেয়। আমিও যদি ফাঁকতালে দু-চারটে উদ্ধৃতি পেয়ে যাই।
চিঠির বিষয়বস্তু— ধারাভাষ্য চলাকালীন বেনোর মন্তব্য। সে বারের সিরিজে দু-একবার তিনি বলেছিলেন, ‘মানকাডেড’। অর্থাৎ, বিনু মাঁকড়ীয় দৃষ্টান্ত অনুযায়ী ডেলিভারির আগেই ক্রিজ ছেড়ে নন-স্ট্রাইকার এগিয়ে গেলে বোলারের তাকে আউট করার চেষ্টা। বাঙালি চিঠি প্রেরকের মনে হয়েছিল, মাঁকড় ব্যাটসম্যান বিল ব্রাউনকে আউট করার আগে সতর্ক করেছিলেন। দ্বিতীয়বারও ব্রাউন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তবেই তাঁকে আউট করেন। তা হলে মাঁকড়কে কেন অন্যায় ক্রিকেটীয় সুবিধা নেওয়া সম্পর্কিত একটা টার্মের সঙ্গে জড়ানো হবে? আর তিনি রিচি বেনো, ক্রিকেট ধারাভাষ্যে ঈশ্বর, কেন এর মধ্যে থাকবেন?
তা ক্যুরিয়ার তার উদ্ধৃতি মোটেও পেল না। কিন্তু দু’সপ্তাহের মধ্যে কমেন্ট্রি বক্সের লাউঞ্জে ফের দেখা হতেই বেনো জানিয়ে দিলেন, উত্তর পাঠিয়ে দিয়েছেন। কলকাতা ফিরে বেনোর উত্তরটা পড়ে মনে হয়েছিল যে কোনও ক্রিকেট জাদুঘরে ঠাঁই পেতে পারে। তাতে ছিল, ‘বিনু দু’বার এই ভঙ্গিতে ব্রাউনকে আউট করেছিলেন। একবার সতর্ক করে। একবার না করে। তারপর থেকেই মাঁকড়ীয় শব্দটা ক্রিকেটের অভিধানে ঢুকে গিয়েছে এই তথ্যটাকে অগ্রাহ্য করে যে, মূল দোষটা ছিল বিল ব্রাউনের। বারবার নন-স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে তিনি বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। আপনার সুবিধের জন্য আমি ব্রাউন আর মানকডিংয়ের উপর অক্সফোর্ড কম্প্যানিয়ন আইটেমটা তুলে দিচ্ছি।’
এই ছিলেন বেনো! অগাধ ক্রিকেটীয় পাণ্ডিত্য। সাহস। আর তার সঙ্গে বিনম্রতা।
কলকাতার চিঠির জবাব না দিলেও তাঁর বিলক্ষণ চলত। তবু শেষ প্যারাগ্রাফে যোগ করেছিলেন, ‘আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি, আমাদের দেশে বিনু ক্রিকেটার আর মানুষ হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয়।’
বেনোর মৃত্যুর পর ১২০ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। এখনও কোথাও তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার দেখা দূরে থাক, শেষ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারেরও দেখা নেই। কবে দিয়েছেন বেনো মিডিয়ায় শেষ ইন্টারভিউ? কেউ জানে না। বহুবছর কেউ পায়নি। অথচ অজাতশত্রু। বিশ্বকাপের শেষ দিকে তাঁর শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হওয়া শুরু। এমসিজি-তে যখন মাইকেল ক্লার্ক কাপ হাতে তুলছিলেন, অসমের এক ক্রিকেটকর্তা গ্যালারিতে বললেন, ‘‘আহা! বেনোকে মিস করছি!’’ ততদিনে জানা হয়ে গিয়েছে, চামড়ার ক্যান্সারে গুরুতর অসুস্থ বেনো সিডনির বাড়িতে শুয়ে। সবে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। আনন্দবাজারে সেটা লিখিও। অথচ আশ্চর্য লাগছিল, স্থানীয় কাগজে কোথাও এক ফোঁটা খবর নেই। ক’দিন বাদে শরীরের অবস্থা আরও খারাপ হল। তবু কেউ এক লাইনও লেখেনি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট অবধি নীরব ছিল। পরে জানতে পারি, সবটাই বেনোর প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধায়!
সিডনিতে মাত্র ক’দিন আগেই টনি গ্রেগের ছেলে মার্কের একটা ইন্টারভিউ করতে গিয়ে মনে হয়েছে, তাঁর বাবার মতোই অনর্গল। অথচ বেনো-মৃত্যুর পর কথা বলতে গিয়ে মনে হল, যেন তাঁর বাবাই নতুন করে মারা গিয়েছেন— এমন শোকস্তব্ধ। মার্কের জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিন ধ্রুবতারা। তাঁর বাবা। কেরি প্যাকার। আর বেনো। মার্ক বলছিলেন, ‘‘নেট-য়ে দেখছি অবলীলাক্রমে লোকে লিখছে রিচি রেস্ট ইন পিস। কী করে লিখছে কে জানে? আমি তো চিরসম্ভ্রমের মিস্টার বেনো ছাড়া আজও কিছু ভাবতে পারি না।’’
এক এক সময় মনে হচ্ছে ব্র্যাডম্যান মারা যাওয়ার পরেও তো ক্রিকেট বিশ্বে এমন উথালপাথাল করা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়নি। বরং ব্র্যাডম্যান চলে যাওয়ার পরেও অনেকে প্রতিক্রিয়া দিতে সম্মত হননি। যেমন ইয়ান চ্যাপেল। নটিংহ্যামশায়ারে লারউড ভক্তদের একাংশ। ডগলাস জার্ডিনের নিকট আত্মীয়রা। সদ্যমৃতর সমালোচনা উচিত নয় এই স্টান্সেই প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকা। বেনোর এমন দুর্ভাগ্য হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর বিশ্বখ্যাত সিডনি হারবার ব্রিজের পতাকা যেমন অর্ধনমিত থেকেছে, তেমনি পাঁচদিন পরেও অর্ধনমিত গোটা ক্রিকেট বিশ্বের মেজাজ। বিশ্বের বিভিন্ন ক্রিকেট মহলে ঘুরে বেড়িয়ে অবশ্য আগেও মনে হয়েছে, ক্রিকেটারদের গোপন ব্যালটে প্রিয়তম ক্রিকেট ব্যাক্তিত্ব বাছার লড়াইয়ে বেনোর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন একমাত্র ফ্র্যাঙ্ক ওরেল। ব্র্যাডম্যান আসবেন তৃতীয় বা চতুর্থ। শেন ওয়ার্ন কি সাধে বলেছেন, ‘‘ক্রিকেটের গডফাদারই চলে গেলেন।’’
বেনোর ২২৮ উইকেট আর ২২০১ রানের আড়ালে লুকিয়ে ছিল অবিরাম মস্তানি।
সেই পঞ্চাশ দশকে বল করতেন বুকের বোতাম খুলে
বেনো আসলে বরাবর প্রতিবাদী এবং প্লেয়ারদের মানুষ। ব্র্যাডম্যান যা কখনও ছিলেন না। প্যাকার ক্রিকেট উদ্ভাবনের প্রথম কারণ হিসেবে আজও চ্যাপেলরা চিহ্নিত করেন সেই সময় অস্ট্রেলীয় বোর্ডের চেয়ারম্যানকে। বহু অনুরোধেও যিনি প্লেয়ারদের টাকা বাড়াতে রাজি হননি। ফলে তারা প্যাকারের প্রলোভনে আরও ঢলে পড়ে। চেয়ারম্যানের নাম ছিল ব্র্যাডম্যান। আর ঠিক সেই সময় প্লেয়ারদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেনো। কোনও প্রয়োজনই ছিল না তাঁর। ততদিনে তিনি নিজের দেশে প্রতিষ্ঠান হয়েই গিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান হয়ে আবার প্রতিষ্ঠান বিরোধী হওয়ার ঝকমারি নেয় ক’জন! বেনো এ জন্যই ব্যতিক্রম।
ওই রূপবান চেহারা আর খয়েরি স্যুটের মার্জিত আভিজাত্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল ডাকাবুকো একটা মন। যা খেলোয়াড় জীবনেও তাঁর সঙ্গে ছিল। বেনোর ২২৮ উইকেট আর ২২০১ রানের আড়ালে লুকিয়ে ছিল অবিরাম মস্তানি। সেই পঞ্চাশ দশকে বল করতেন বুকের বোতাম খুলে। ধারাভাষ্যকার হয়েও জগতটা বদলানোর কোনও কারণ দেখেননি। এই যে মৃত্যুর পর অস্ট্রেলিয়ান সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হল, সেটাও তো চিরবিদ্রোহী বেনো! তিনি আজীবন ব্যক্তিগত এবং প্রতিবাদী। সমাধিতেও সে ভাবেই শুয়ে থাকতে চান।
প্রবাদপ্রতিম ক্রীড়াবিদ বিদায় নিলে পরবর্তী সময়ে নানান তর্ক ওঠে। আধুনিক যুগে অক্ষুণ্ণ থাকত তার শ্রেষ্ঠত্ব? প্রাসঙ্গিক থাকত সে? নেভিল কার্ডাসকে যেমন আধুনিক ব্রিটিশ ক্রিকেট সাংবাদিকতা ‘অচল’ আখ্যা দিতে শুরু করেছে!
বেনোর মৃত্যুর বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে এই উপমহাদেশও নতুন ক্রিকেট তর্কে আচ্ছন্ন। এখানে জন্মালে তাঁর ‘রিচি বেনো’ হওয়া সম্ভব হত?
ধারাভাষ্যকার বেনোর আসল মুন্সিয়ানা তাঁর উপযুক্ত এবং পরিমিত শব্দ চয়নে। ঠিক সময়ে মোক্ষম অভিব্যক্তি তুলে আনার জন্য। গ্রেম হিক টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বল পেলেন তাঁর নাক ছুঁয়ে চলে যাওয়া মার্শালের বিদ্যুৎ গতির বাউন্সার। বিবিসি-তে বেনো বললেন, ‘‘গ্রেম হিক, ওয়েলকাম টু টেস্ট ক্রিকেট।’’ গোটা ক্রিকেট দুনিয়া যা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, আহা এক কথায় হাজার শব্দের প্রভাব! সেই ইংল্যান্ডের মাঠেই ওয়াকার ইউনিসকে টিভি ক্যামেরা ধরল নখ দিয়ে বলের চামড়া তুলতে। পরিষ্কার বল ট্যাম্পারিং। বেনো কী বললেন? না, ‘‘স্ট্রেঞ্জ থিংস হ্যাপেন ইন বিগ সিটিজ। বড় বড় শহরে কিম্ভুতকিমাকার জিনিস হয়।’’ বেনো সেই ঘরানার সফল প্রবর্তক যা বলে, স্ক্রিনের ছবিকে যদি কথা দিয়ে আরও উজ্জ্বল করতে না পারো, তা হলে নীরব থাকো। বেনো সভ্যতার সবচেয়ে বড় স্তম্ভ নীরবতার ঐশ্বর্য। আর মুখ খুললেও ছোট ছোট ফুলকি। যা আন্ডারস্টেটমেন্ট হয়েও ভীষণ ভাবে স্টেটমেন্ট।
এহেন বেনো মহিমা প্রথমে ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয়ে তার পর অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে যায়। আর তারপর অলিম্পিক মশালের মতো প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে পৃথিবীর বিভিন্ন ক্রিকেট দেশে। বেনো ধারাভাষ্য হয়ে যায় একটা টেমপ্লেট। যাকে সামনে অনুকরণ করে এগিয়েছে তাঁর তিন-চার পরের প্রজন্মও। রবি শাস্ত্রী সবে ধারাভাষ্যকার হয়েছেন। প্রথম লক্ষ্য কী? তা আনন্দবাজারকে বললেন, ‘‘লর্ডসে একবার বক্সে বসে বেনোর কমেন্ট্রি শুনছিলাম। নার্সারি এন্ডের দিকে গাওয়ার সবে ড্রাইভ করেছে। বেনো বলেছিলেন এটায় তিন আছে। তিন-ই হয়েছিল। অথচ বলটা তখনও মাঝ উইকেট পেরোয়নি। আমায় এই লেভেলে পৌঁছতে হবে!’’ ২০০৫। সৌরভ তখনও ক্যাপ্টেন। প্রচণ্ডতম সমালোচনায় তাঁকে নিয়মিত রক্তাক্ত করছেন বেদি-চ্যাপেলরা। রাতে নিজের ঘরে অস্ফুটে সৌরভ বললেন, ‘‘যদি কমেন্টেটর হই, বেনোর মতো হতে চেষ্টা করব। কখনও প্লেয়ারের উগ্র সমালোচনা করবো না।’’
পরবর্তীকালে অবশ্য বেনোর পথে এগোতে চাই, এটা কেউ সাহস করে বলতে পারেনি। এমনই দুর্লঙ্ঘ্য গিরিশৃঙ্গ দেখিয়েছে তাঁকে।
কিন্তু আধুনিক সময় প্রশ্ন তুলবেই, নতুন উপমহাদেশীয় ভাষ্যকার বেনোর টেমপ্লেট নেবে কী করে? পশ্চিমী বিশ্ব আন্ডারস্টেটমেন্টের ভাষা বোঝে আর তাকে কদর করে। তৃতীয় বিশ্ব বোঝে ক্যাচোরম্যাচোর। আওয়াজ। আর অনর্গল সংযোগ। তাদের গড়পড়তা অংশ পজ বোঝে না। নীরবতা বোঝে না। টিভি প্রোডিউসরের এরাই হল বেতাজ বাদশা। এরা খুশি তো টিআরপি খুশি। টিআরপি খুশি তো স্পনসর খুশি।
সচিন তেন্ডুলকর যখন তাঁর বিদায়ী টেস্ট ম্যাচে দিনের শেষ ওভার ব্যাট করছেন, টিভি ক্যামেরা সোজা ধরল ভিআইপি বক্সে বসা তাঁর মাকে। মায়ের ছবি বড় করে সামনের ভিডিয়ো স্ক্রিনে দেখাচ্ছে। গ্যালারিতে বসা অজিত তেন্ডুলকর তীব্র অসন্তুষ্ট, ‘‘এটা হচ্ছেটা কী?’’ ক্ষুব্ধ হন সচিনও। পরে আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি বল দেখব কী! মাকে ও ভাবে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম।’’
তাতে কারও কিছু এসে যায়নি। প্রযোজক পরের তেন্ডুলকরের জন্য আবার একই জিনিস গুছিয়ে রাখবে। ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিকেট সম্প্রচার মানে বিবিসি ভদ্রতা নয়, চ্যানেল নাইনও নয়। টিপিক্যাল ‘সাস ভি কভি বহু থি’। লক্ষ্য— সব সময় গরিষ্ঠ অংশকে আকর্ষণ করা। সে গো বলয়, ঝুমরি তলাইয়া বা গুজরাতের প্রত্যন্ত গ্রাম যেখানেই লুকিয়ে থাক! মাকে পর্দায় দেখানোর সময় ভাষ্যকার নির্বাক থাকলে সেখানে প্রোডিউসর তাকে টকব্যাকে বারবার বলবে, ‘‘স্পিক আপ। স্পিক।’’ এই মার্কেটের ঈশ্বর হলেন নভোজ্যোত সিংহ সিধু। অভিজাত বাঙালির ড্রইং
রুমে তাঁর অনর্গল কথা বলা, বিশেষণের অতিকথন আর রসবোধের স্তর যত অসহ্যই মনে হোক সিধুর সঙ্গে রয়েছে টিভি প্রযোজক। কারণ তার সঙ্গে যে রয়েছে সংখ্যা। সিধু পর্দায় থাকলে যে লোকে বেশি আমোদিত হয়, সেই আনুপাতিক হিসেব।
সেই ছিয়ানব্বইয়ের বিশ্বকাপ বাদ দিলে বেনো কখনও ভারতে ধারাভাষ্যই দেননি। কী হত যদি এই আইপিএল-এই সিধুর পাশে বসে তাঁকে কমেন্ট্রি করতে হত? ছবিকে বেশি উজ্জ্বল না করতে পারলে শব্দ ব্যবহার কোরো না— ঘরানাটাই তো এখানে চলত না। এখন তো উল্টো নিয়ম। কমেন্টেটর্স ব্রিফিংয়েই আপনাকে বলে দেওয়া হবে ক্রমাগত কথা বলবেন। এটা কানেক্টিভিটির যুগ, ফেসবুকের যুগ। দর্শককে টানা এনগেজ করে রাখতে হবে। রান্নাঘর থেকে বাড়ির কর্ত্রী হয়তো টিভির পুরোটা দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু আপনার গলা তো শুনতে পাচ্ছেন। তাঁর বা তাঁদের জন্য আপনাকে বলে যেতে হবে।
কিন্তু বলে গেলে আর বেনো হিস্টিরিয়া তৈরি হয় কী করে? শব্দের মিতব্যয়িতাই তো তাঁর জনপ্রিয়তার সবচেয়ে জয়ঢাক। শব্দের ঢাক কী করে তাঁর জনপ্রিয়তা তৈরি করতে পারে?
সে দিন প্রসঙ্গটা আলোচনা হতে হতে হর্ষ ভোগলে বলছিলেন, ‘‘আমার কাছে এর একটা সহজ উত্তর আছে। এটা খুব সত্যি কথা বেনোর ম্যাজিক রসায়ন আইপিএল-এ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। কিন্তু একবার ভেবে দেখবেন আইপিএল শুরুর সময় আমরা বলতাম, দ্রাবিড় আর ক্যালিস টি২০তে কী করবে? উত্তরটা কি আমরা পেয়ে যাইনি?’’
শুনে মনে হল, বহু বছর আগে টাইগার পটৌডির মন্তব্যটাই যেন ভেসে এল। রঞ্জির লেগ গ্লান্স রক্ষণাত্মক ফিল্ডিংয়ের এমন যুগে চলত না বলায় পটৌডি বলেছিলেন, ‘‘ঠিকই। কিন্তু রঞ্জির যা প্রতিভা ছিল অন্য কোনও স্ট্রোক উনি বার করে নিতেন।’’
বেনো সভ্যতা তাই জেনারেশন ওয়াইয়ের দাঁতখিচুনিতে আক্রান্ত হতে হতেও সম্ভবত রাজমুকুট অক্ষুণ্ণ রেখে যাবে। যাবতীয় সংশয়ের মধ্যেও প্রতিরক্ষার একটা দূর্গ তার অক্ষুণ্ণ থাকবে। এই পর্যায়ের যে প্রতিভাবান সে আইপিএল কমেন্ট্রিও ঠিক করে দিত। এমনকী ওই সিধুর পাশে বসেও!
সেঞ্চুরি হতে বাকি মাত্র আটানব্বই রান
(গ্লেন ম্যাকগ্রা মাত্র দু’রানে আউট হওয়ার পর)
অ্যাথলেটিক্সের জন্য ছোট্ট
একটা বিরতি
(মাঠে একজন দৌড়ে যাওয়ার পর)
ও বলটা ঠিক মারতে
পারেনি। পারলে ন’রান
পেয়ে যেত
(জাস্টিন ল্যাঙ্গার ছয় মারার পর)
গ্যাটিং জানেই না কী ভাবে হল... ও এখনও জানে না!
(১৯৯৩-এ শেন ওয়ার্ন-এর বলে মাইক গ্যাটিং
আউট হওয়ার পর)