নিশুতি রাতে ডাকাতেরা ঘরে ঢুকল। গৃহকর্ত্রী ঘুমোচ্ছেন। আলমারি খুলে টাকা সরাতে না সরাতেই ঘুম গেল ভেঙে। বালিশের পাশে রিভলভার ছিল। তিনি ডাকাতের দিকে গুলি ছুড়লেন। ডাকাতেরা এটা আশা করেনি। ‘যাঃ শালা’ বলে তারাও পাল্টা গুলি চালিয়ে দিল।
এই ‘যাঃ শালা’ মন্তব্যটাই পরে ভাবিয়ে তুলবে শবর দাশগুপ্তকে। পর্দায় শবরের দ্বিতীয় অ্যাডভেঞ্চার, ঈগলের চোখের মণিটি হচ্ছে ওই অমোঘ দু’টি শব্দ— যাঃ শালা!
অরিন্দম শীলের বড় গুণ হল, তিনি নানা রকম উপাদান মিলিয়েমিশিয়ে বেশ উপভোগ্য চিত্রনাট্য তৈরি করতে পারেন। ক্রাইম থ্রিলারের নিজস্ব দাবিদাওয়া মেটান — অর্থাৎ ক্রাইম এবং সাসপেন্সের উপকরণ যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। গোয়েন্দা শবরের মাথা খাটানো অর্থাৎ ডিটেকশনের মজাটা থাকে। আবার সেই সঙ্গে অপরাধ-কাহিনির অন্য কুশীলবদের ঘিরেও একটা জমাটি গল্প তৈরি হয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি থেকে বক্স অফিস-সফল সিনেমার প্রয়োজনীয় মালমশলা অরিন্দম ছড়িয়ে দিতে পারেন সাবলীল ভাবে। এবং যদি এই মালমশলার দিকটা আলাদা করে মাথায় রাখি, তা হলে ‘এ বার শবর’কে ছাপিয়ে যাবে ‘ঈগলের চোখ’।
ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে, ট্যাকি। বাংলায় বলা যেতে পারে, চটচটে। ‘এ বার শবরে’র বেশ কিছু দৃশ্য এবং রঙের ব্যবহার ‘ট্যাকি’ লেগেছিল। বেশ কিছু অতিরেক নজরে এসেছিল। ‘ঈগলের চোখ’য়েও কাহিনিবৈগুণ্যে সেই বিপদের সম্ভাবনা ছিল ষোলো আনা ছেড়ে আঠেরো আনা। কিন্তু অরিন্দম এ বার সফল ভাবে দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গিয়েছেন। এবং বেশ কিছু জায়গায় চমকেও দিয়েছেন। বিষাণ রায়ের সঙ্কটের সঙ্গে শবরের নিজের সঙ্কটকে মেলানোর যে চেষ্টা ছিল, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার ঝুঁকি হয়তো নেওয়া যায়নি। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ‘ঈগলের চোখ’ দর্শককে খুশি করে দেবে।
দু’একটা প্রশ্ন তবু নাছোড়। বিষাণকে নিয়ে তাঁর চারপাশের যাবতীয় মহিলারই যৌনলিপ্সা জাগ্রত হচ্ছে কেন, এটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। শবর একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, কোনও কোনও পুরুষ এ রকম কপাল নিয়ে আসেন! এমন একটা আকর্ষণী ক্ষমতা তাঁদের থাকে যে, তাঁদের ঘিরে অজস্র নারী ভিড় জমান। বোঝা গেল। কিন্তু বিষাণের ক্ষেত্রে সেই আকর্ষণের উৎসটি কী? সেটা দর্শকের চোখে খুব স্পষ্ট নয়। সে কারণে একের পর এক ক্ষুধার্ত রমণীর আগমন একটু একঘেয়ে আর আরোপিত বলে মনে হয়।
আসলে পৃথিবী জুড়েই ক্রাইম থ্রিলার গোত্রটির বড় অংশ নারীকে একটা বিশেষ ধরনে দেখতে পছন্দ করে। ‘এ বার শবর’ও তার বাইরে ছিল না, ‘ঈগলের চোখ’ও নয়। ছবিতে বিষাণ যেন অসহায় আত্মসমর্পণকারী! অথচ সে নিজে বলছে, নোংরামির প্রতি তার একটা আসক্তি আছে। সে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মাঝে মাঝেই ঘর ছাড়ে। নোংরামিকে নোংরামি বলে জেনেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নিয়ন্ত্রণহীনতা আর বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পণ তো এক জিনিস নয়। অতীতে যা-ই ঘটুক, বর্তমানে যে নিজেই তথাকথিত নোংরামির দিকে ধেয়ে যায়, সে তো নিজেই যায়। ‘আমি চাইনি, সবাই আমার ঘাড়ে এসে পড়ল’ জাতীয় লজিক সে ক্ষেত্রে আর কাজ করে কি? বাইরে যা ঘটবে সেটা ‘নিয়ন্ত্রণহীনতা’ আর ঘরে যা ঘটবে সেটা ‘আত্মসমর্পণ’— এতটা নিখুঁত ভাগাভাগিতে চলে কি জীবন?
পরিষ্কার হয় না বিষাণের শ্যালিকা শ্যামাঙ্গীর চরিত্রটাও। তার সঙ্গে যদি বিষাণের সম্পর্কটা সোজাসাপ্টা না-ই হবে, তা হলে শ্যামাঙ্গীকে ভরসা করে ষড়যন্ত্রের অংশী করা হল কেন? সব জানাজানির পরে শবরই বা শ্যামাঙ্গীকে পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব দেয় কেন?
এই খটকাগুলো একটা বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করছে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কুশীলবদের যে নিজস্ব গল্প, নিজস্ব অতীত— সেই বুনোটটা প্রথম শবরে আরও আঁটসাঁট ছিল। দ্বিতীয় শবরে দৃশ্যগত আবেদন বেশি। যেমন ধরা যাক, টাইটল সিন। একই স্টাইল দু’টো ছবিতেই। কিন্তু এ বারেরটা অনেক বেশি ছিপছিপে।
শবরের কথা বলার কিছু মুদ্রাদোষও এ ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে। তবে সেটা যাতে পুনরাবৃত্তি দোষ বলে মনে না হয়, সেটাও অরিন্দমকে মাথায় রাখতে হবে। তবে অরিন্দমের বড় গুণ হল সহজ সংলাপে মজা তৈরি করার ক্ষমতা। কোনও রকম ‘কেমন দিলাম’ জাতীয় হাবভাব না করেই নির্মল টিপ্পনীর ব্যবহার। আগের ছবিতে শুনেছি, শবরের ঘর থেকে ভোরবেলার আজান কানে আসে। এ বারও এল। শব্দে এই কন্টিন্যুইটির ব্যবহারটিও বড় ভাল লাগল।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাপারে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লাগে এটাই, উনি যখন তোপসে করতেন, দেখে কখনও মনে হতো না যে উনি কখনও ফেলুদা হতে চান। যখন তিনি অজিত, তাঁকে একবারের জন্যও হয়ে-না-ওঠা ব্যোমকেশ বলে মনে হয়নি। এবং শাশ্বত যখন শবর, তখন কিছুতেই যেন ভাবা যায় না এই লোকটা তোপসে আর অজিতও হতে পারে! এটাই জাত অভিনেতার অভিজ্ঞান। তেমনই চমৎকার শবরের ‘অজিত’ নন্দ! শুভ্রজিৎ দত্ত কিন্তু শবর সিরিজের অন্যতম আকর্ষণ। শাশ্বতর পাশে তিনি শুধু অপরিহার্য নন, তিনি ছাড়া শবর অসম্পূর্ণ।
জয়া এহসান সুঅভিনেত্রী। বিষাণের স্ত্রীর চরিত্রে ভাল লাগে তাঁকে। জাহ্নবীর ভূমিকায় রীতিমতো চমকে দেন নতুন মুখ রিয়া বণিক। নন্দিনীর সাজে পায়েল সরকার অবশ্য খুব বেশি অভিনয়ের সুযোগ পাননি। ছবির আসল চরিত্র বিষাণ রায়। নবীন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কাঁধে গুরু দায়িত্ব। মঞ্চে তাঁর ক্ষমতার পরিচয় অনির্বাণ বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখিয়ে আসছেন। সিনেমায় এখনও অবধি তাঁর সবচেয়ে নজর কাড়া চরিত্র এটাই। অনির্বাণ করেওছেন ভাল। ভবিষ্যৎ তারকা হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি তাঁর মধ্যে আছে। শুধু পর্দায় অভিনয়টা আর একটু লুকিয়ে রাখতে পারলে আরও ভাল হয়।
আর একটা শেষ প্রশ্ন শবরবাবুর কাছে। ডাকাতেরা যে ‘যাঃ শালা’ বলে উঠেছিল, সেটা আপনি গোড়া থেকে জানলেন কী করে?