‘দুধপিঠের গাছ’ সিনেমার একটি দৃশ্য।
মনে আছে, ছোটবেলায় টিভিতে ইন্ডিয়া ওয়ান ডে টূর্নামেন্ট বা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের কোনও খেলা থাকলে নিজের মধ্যে একটা প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত আগের দিন থেকেই। মন বসত না কিছুতে। নিজের মধ্যেই একটা বিশাল খেলার মাঠ, দর্শকদের চিৎকার, জয়ধ্বনি। কী ভাবে যেন তৈরি হয়ে যেত আসন্ন খেলার কাল্পনিক একটা স্ক্রিপ্ট। ঠিক সেই অনুভূতিটাই ফিরে পেলাম অনলাইনে ‘দুধপিঠের গাছ’ ছবিটির টিকিট কেটে ফেলার পর থেকে। অসম্ভব একটা উন্মাদনা। তীব্র প্রত্যাশার পারদ। ইউটিউবে, ফেসবুকে এতো ভাল ট্রেলার। অসাধারণ গান, প্রেক্ষাপট সবটা মিলিয়েই আর কি।
বুক মাই শো-তে দেখলাম অনেকগুলো অপশন থাকলেও সময় এবং দূরত্ব অনুযায়ী লেক মলের সিনেপলিসটাই আমার জন্য সুবিধাজনক। পুজোর জন্যেই হোক বা করোনার আতঙ্ক, দর্শকদের গড় বয়েস তিরিশ-পঁয়ত্রিশের মধ্যে। জাতীয় সঙ্গীতের জন্য উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলাম দূরত্ববিধি মেনেও প্রায় চল্লিশ শতাংশ আসন ভরা। ছবির সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। আর পাঁচজনের মত নিছকই দর্শক। তবুও আনন্দ হল। কার জন্য কিসের জন্য, বুঝিনি। ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে আড়ংঘাটার ওই এক গ্রাম মানুষের জন্য। যাঁরা এই ‘দুধপিঠের গাছ’ ছবিটির প্রযোজনার ভার নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। আনন্দ হল আড়ংঘাটা গ্রামের শিক্ষক উজ্জ্বল বসুর জন্য, যিনি এই ছবির গল্পকার, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক।
এই ছবিটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে এইটুকু ভূমিকা করতেই হত। সত্যি কথা বলতে কি, কবি কেন কবিতাটি লিখেছেন– কোন বিশ্বাস, কোন চেতনা, কোন গভীর বিশ্বাস থেকে সেটা হয়ত একমাত্র কবিই জানেন বা হয়তো তিনিও জানেন না! তবে তার কাছে বিস্ফোরণের মুহূর্তটা থাকে প্রসব মুহূর্তের মতোই সুখের। ‘দুধপিঠের গাছ’ নিয়ে আপনাদের কিছু বলতে যাওয়ার আগে তাই গুছিয়ে নিতে হচ্ছে অনেকটাই। আসলে এ তো একটা কবিতার মতো একটা সিনেমা।
দামিনী বেণী বসু আপনভোলা গৌরের জন্য চিন্তায় আকুল।
আরও পড়ুন: মৃত্যুর পর তাঁর সব সৃষ্টি যেন ধ্বংস করা হয়, ইচ্ছাপত্রে ইচ্ছাপ্রকাশ সুমনের
বলা যায়, রূপকথার অমনিবাস। অনেকগুলো ছোট ছোট রূপকথার মেলবন্ধন। দুই দিদির পরে বাবা মা’র তৃতীয় সন্তান গৌর। পুত্রসন্তানের সাধ মিটলেও গৌর স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে দুই দিদির থেকে তার প্রতিই বাবা মায়ের স্নেহের প্রকাশ বেশি। অভাবী পরিবারের সন্তান ছোট্ট গৌরের ধারণা, দুধপিঠেরও গাছ হয়। এই বিশ্বাসকে আপন করে নিয়ে সে মাটিতে পিঠে পোঁতে। জল দেয় নিয়মমাফিক। অপেক্ষা করে, পিঠে গাছের চারার জন্মের। মূলত এই নিয়েই গল্পের নদী বয়ে যায়। গল্প এবং ছবির বুনট একেবারেই ভিন্ন স্বাদের। পরিণতিতে পৌঁছনোর তাড়া নেই তার। বরং সে পালিয়ে বেড়ায় দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। সব কিছুই বলে দেয় না। সে প্রশ্রয় দেয় দর্শকের অনুভূতির স্বাধীনতাকে। অনেক সময়ই বলেও বলে না, হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। সংলাপে নয়, চরিত্রের শারীরিক ভাষায় লুকিয়ে থাকে তার মনস্তত্ত্ব। সেই অর্থে ‘দুধপিঠের গাছ’-এর বিনোদন প্রথাগত রীতি থেকে একটু আলাদা।
নদীয়ার আড়ংঘাটা গ্রামের নাম কিছুদিন আগেও অচেনা ছিল বহু মানুষের কাছেই। সেই গ্রামে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকায় সুপরিচিত ছিলেন পরিচালক। নিজের সিনেমার গল্পে রূপকথার ছোঁয়াচ দিতে গিয়ে তিনি সমগ্র গ্রামের কাছে হয়ে উঠলেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। নবজন্ম হল এক গ্রামের। সিনেমা তৈরির আর্থিক বিষয়টি গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, দোকানিরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। ক্রাউড ফান্ডিংয়ে, পরিশ্রমে, আন্তরিকতায় বাস্তবায়িত হলো এক অসাধারণ উদ্যোগ। এসবও তো রূপকথাই।
‘দুধপিঠের গাছ’ ছবি জুড়ে রয়েছে দুরন্ত সব ল্যান্ডস্কেপ। দিগন্তজোড়া সবুজ। মাটির গন্ধ আর অবশ্যই নিটোল সারল্য। সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে ছিলেন শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। দৃশ্যগুলিকে আরও জীবন্ত করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে জয় সরকারের সঙ্গীত এবং আবহ। ছোট ছোট আশা, চাওয়া পাওয়া, খুব অল্প কিছুতেই তৃপ্ত হতে পারা, দারিদ্রের আড়ালে উঁকি মারা শখ আহ্লাদ, অবসর, দৈনন্দিনের একঘেয়েমি ইত্যাদি নানা কিছু একটা গ্রামের আত্মকথার মতোই। আরোপিত বলে মনে হয় না।
পায়েল চক্রবর্তী ভট্টাচার্য নিবেদিত ও শ্যামসখা পরিবেশিত 'দুধপিঠের গাছ' এখন খবরের শিরোনামে। এটা তাদের প্রাপ্য। কোনো বড় ব্যানার নেই। বড় স্টারকাস্ট নেই। আড়ংঘাটার সাধারণ গ্রামবাসীদের অর্থসাহায্যেই নির্মিত ছবিটিতে গৌরের চরিত্রে হর্ষিল দাসের অভিনয় মুগ্ধ করে। আর দামিনী বেণী বসু এমনই একজন অভিনেত্রী, যিনি বার বার নিজের অজান্তেই নিজের উচ্চতাকে ছাড়িয়ে চলে যান। কৌশিক রায় হয়তো তেমন চেনামুখ নয়, কিন্তু গৌরের বাবার চরিত্রে তাঁর বাৎসল্যবোধ এবং পরিবারের কর্তা হিসেবে নিজের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে তাঁর অসহায়ত্বে কতখানি সঠিক নির্বাচন তার প্রমাণ রেখে গেছেন ছবিতে। এঁদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন গ্রামের বহু মানুষও। মোট চল্লিশ জন বাচ্চা কাজ করেছে এই ছবিতে। একজন বাদে সবাই গ্রামেরই বিভিন্ন পরিবারের। তাদের কাজ দেখলে বোঝা যায়, কত আন্তরিকতা উজাড় করে দেওয়া হয়েছে সেখানে। ছবিটি সম্পাদনা করেছেন অনির্বাণ মাইতি। ‘দুধপিঠের গাছ’ নামটির পিছনে যে অভিনবত্ব এবং কাব্যবোধ, তার জন্য কৃতিত্বের দাবিদার শিল্পী হিরণ মিত্র। তিনি এ ছবির আঙ্গিক বিন্যাসও তাঁর।
দুধপিঠে গাছের স্বপ্নে বিভোর গৌর।
আরও পড়ুন: ‘মা’ শুভশ্রীর কোলে চেপে শারদীয় শুভেচ্ছায় ছোট্ট ইউভান
অতিমারির কলুষিত সময়ের মধ্যে এই ছবির উদ্যোগ, কাহিনির ইতিবাচক দিক মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে নতুন করে। ভালবাসা দিয়ে তৈরি এই ছবি ফিরিয়ে দেবে হারিয়ে যাওয়া শৈশব, ভুলতে বসা সারল্য, নতুন কিছু ভাবতে পারার স্পর্ধা।
এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের। নামজাদা পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতাদের ছবির জন্য অপেক্ষা করার অভ্যেস বদলানোর এটাই কিন্তু সেরা সুযোগ।