শান্তিনিকেতনের হোটেল থেকে বেরোচ্ছেন অমিতাভ ছবি: নীলাঞ্জন বসু
ভুবনডাঙার মাঠ থেকেই সারি সারি পুলিশ।
প্রান্তিকের দিকে প্রত্যেকটা চায়ের দোকানে সকাল থেকে একটাই আলোচনা।
যে হোটেলে অমিতাভ উঠবেন, তার সামনে প্রত্যেকটা বাস গতি কমিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভিতরে কী হচ্ছে। সামনে পাঁচিলে লোকে দাঁড়িয়ে সমানে মোবাইল তাক করে রেখেছে হোটেলের রিসেপশনের দিকে।
হ্যাঁ, এই সপ্তাহ শান্তিনিকেতন পুরোপুরি বচ্চনময়।
হাজার হোক কবির দেশে কবিপুত্র।
কিন্তু সবাইকে এক রকম নিরাশ করে শ্যুটিং সেরে সকালে এসে বিকেলেই কলকাতা ফিরে গেলেন তিনি। শান্তিনিকেতনে এলেন অমিতাভ, কিন্তু রাত্রিবাস এখনও হল না। তাতে আর কী! এর মধ্যেই আউশগ্রামে শ্যুটিং করলেন। দিনের শেষে কলকাতা ফেরার আগে প্রান্তিকের ক্যামেলিয়া হোটেলে ঘুরে সবার সঙ্গে ছবি তুললেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন আবার ফেরার। গীতাঞ্জলির ইংরেজি সংস্করণ উপহার হিসেবে পেয়ে চোখ চিকচিক করে উঠল। দিনের শেষে সবার আক্ষেপ একটাই, ‘‘ইস্, আর কিছুক্ষণ কেন থাকলেন না মিস্টার বচ্চন?’’
সকালটা কিন্তু অন্য ভাবেই শুরু হয়েছিল। তখনও সবাই জানত, অমিতাভ বচ্চন থাকবেন রাতে শান্তিনিকেতনে। ন’টার মধ্যে পুলিশ খবর পাঠিয়ে দিল কলকাতা থেকে তিনি রওনা হয়ে গিয়েছেন। শোনার পরেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে তড়িঘড়ি ব্রেকফাস্ট সারলেন ‘তিন’ ছবির প্রযোজক সুজয় ঘোষ এবং পরিচালক ঋভু দাশগুপ্ত। ঋভুর আর একটা পরিচয়, তিনি পরিচালক রাজা দাশগুপ্তের পুত্র ও বিরসা দাশগুপ্তের ভাই।
হোটেলে ততক্ষণে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। যে কোনও হোটেলের কাছেই ভারতের সবচেয়ে বড় স্টারকে ‘হোস্ট’ করা অত্যন্ত গর্বের। এ ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
কিন্তু আজকেও তিয়াত্তর বছরের মেগাস্টার যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁর জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা করতেই হয়।
কী সেগুলো? পড়তে থাকুন...
আগের দিন রাত দু’টোর সময় হঠাৎ ক্যামেলিয়া হোটেলের দরজায় টোকা। ‘‘এতক্ষণে সব ফাঁকা হয়েছে, চলুন আপনাকে অমিতাভ বচ্চনের ঘরটা দেখাই,’’ বলেন ক্যামেলিয়া হোটেলের কর্ণধার নীলরতন দত্ত। যিনি একই সঙ্গে বাংলা ছবির প্রযোজকও।
এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, অমিতাভ বচ্চনের টিম দু’মাস আগে এসেই সুপারস্টারের কী কী চাই, তার একটা লিস্ট দিয়ে গিয়েছিল হোটেল কর্তৃপক্ষকে।
প্রথম চাহিদা, সাড়ে ছ’ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের একটা খাট। তার থেকে এক ইঞ্চিও কম করা যাবে না।
যেমন কথা তেমন কাজ। ঢুকেই দেখলাম, তিন তলার প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের বেডরুমে একদম মেপে মেপে এমনই অর্ডার দেওয়া খাট রাখা হয়েছে। ইন্টারনেটের স্পিড যে বাড়াতেই হবে মিস্টার বচ্চনের জন্য, এটা সবাই জানে। যেটা অনেকেই জানে না, ওই সুইটে সর্বক্ষণ রাখতে হবে কোক জিরো এবং একটি বিশেষ কোম্পানির মিনারেল ওয়াটারের বোতল। কলকাতা থেকে সেগুলো আনানো হয়েছে।
সঙ্গে রয়েছে দেওয়াল জুড়ে নানা পেইন্টিং। রবীন্দ্রনাথের একটা বিরাট ছবি। এবং অবশ্যই একটা মিনি লাইব্রেরি। এ ছাড়া ওঁর বিশেষ অনুরোধ, ঘরের লাগোয়া রাখতে হবে কনফারেন্স রুম। যেখানে উনি মিটিং করবেন, দেখা করবেন লোকজনের সঙ্গে।
শোনা যায়, কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলেও যখনই উনি থাকেন, তখনও ওঁর জন্য এ রকমই একটা লাগোয়া কনফারেন্স রুমের ব্যবস্থা করতে হয়।
শান্তিনিকেতনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
‘‘যেহেতু উনি চেয়েছেন, আমরা সেই মতো ঘরের সঙ্গে একটা মিটিং রুমও করে দিয়েছি। সঙ্গে ইটালিয়ান মার্বেলের ডাইনিং টেবিল,’’ ঘর দেখাতে দেখাতে বলছিলেন হোটেল মালিক।
একে অমিতাভ বচ্চন, তার উপর শান্তিনিকেতনে উনি। এ রকম যুগলবন্দি তো সহজে ঘটে না। শুধু শান্তিনিকেতন-বোলপুর নয়, ‘তিন’ ছবির প্রযোজক সুজয়ও একই রকম উত্তেজিত এই যুগলবন্দির নেশায়।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অমিতাভ বচ্চনের বিস্তর পড়াশোনার কথা বলছিলেন সুজয় ঘোষও। ‘‘আমি যখন ওঁকে প্রথম বলি ‘কহানি’তে ‘একলা চলো রে’ গানটা গাইতে হবে, কিছুতেই উনি রাজি হচ্ছিলেন না। ইনফ্যাক্ট আমাকে উনি এটাও বলেছিলেন, ‘সুজয়, আমি এটা করলে লোকে যা তা বলবে। প্রথমে জয়া মারবে, তার পরে পাবলিক।’ ওঁর বিরাট পড়াশোনা আছে গুরুদেবকে নিয়ে। আফটার অল কার ছেলে দেখতে হবে তো,’’ বলছিলেন সুজয়। শ্যুটিংয়ের সময় তাঁর ঘর কেমন হবে যদি গল্পের প্রথম চ্যাপ্টার হয়, তা হলে দ্বিতীয় চ্যাপ্টার অবশ্যই নিজের খাওয়া দাওয়া নিয়ে ওঁর নির্দেশাবলি।
এমনিতেই উনি কম খান। কিন্তু সেখানেও রয়েছে কড়া নিয়মকানুন। শান্তিনিকেতনের হোটেলের শেফকে যেমন টিম অমিতাভ বচ্চনের তরফে আগেই বলে দেওয়া হয়েছে প্রত্যেকটা রান্না করতে হবে অলিভ অয়েলে।
‘‘মিস্টার বচ্চন কোনও কিছু নিয়ে খুব একটা বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না। ভীষণ চিলড আউট। কিন্তু একটা ডিসিপ্লিনে থাকা পছন্দ করেন। তাই উনি যেটা চাইছেন, সেটা ওঁকে দেওয়াটাই আমাদের কাজ,’’ বলছিলেন সুজয়।
শুধু শান্তিনিকেতন কেন, অমিতাভ বচ্চনের এ রকম কড়া নির্দেশাবলি ভারতের যে হোটেলই তিনি থাকুন না কেন, সেখানেই পাঠানো হয়। কলকাতায় ‘তিন’ ছবির শ্যুটিং চলাকালীন উনি গ্র্যান্ডে উঠেছেন। ‘পিকু’র সময়ও উনি ওখানেই ছিলেন।
যদিও গ্র্যান্ড হোটেলের তরফ থেকে কেউই মুখ খুলতে চাননি। কিন্তু ওঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানালেন, গত বছরের মতো এ বারও তিনি ৩০১ নম্বর ঘরেই রয়েছেন। শুধু তাই নয়, সন্ধে হলেই পপকর্ন খেতে খেতে আইএসএলের খেলা দেখা ওঁর প্রিয় পাসটাইম।
যদিও আগের বারে ওবেরয়ের শেফদের উনি ফুচকা বানানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ বার কিন্তু এখনও অবধি সেই রকম কোনও নির্দেশ আসেনি। গত বছর উনি ওঁর প্রথম চাকরির সময়কার কলকাতার বিশেষ বন্ধুদেরও ডেকেছিলেন আড্ডা মারতে ওঁর ঘরের লাগোয়া মিটিং রুমে। কিন্তু এ বার এখনও অবধি সেই আড্ডা দেওয়া হয়নি তাঁর।
কিন্তু উনি অমিতাভ বচ্চন। আড্ডা হোক কী না হোক, শান্তিনিকেতন হোক কী কলকাতা, সব চোখ যেন সর্বদা তাঁর দিকেই তাক করা।
মিস্টার বচ্চনকে নিয়ে আজও এই তুমুল হইচই দেখে একটুও বিস্মিত নন পরিচালক ঋভু দাশগুপ্ত। ‘‘উনি অমিতাভ বচ্চন। ওঁর জন্য এই পাগলামি হবে না তো কার জন্য হবে! ইন্ডিয়ার সবচেয়ে বড় স্টার উনি। তবে স্যর কোনও কিছু নিয়ে কমপ্লেন করেন না। রাত তিনটে অবধি শ্যুটিং করলেও, সকাল সাতটায় কলটাইম থাকলে উনি ঠিক হাজির,’’ আড্ডা মারতে মারতে বলছিলেন ঋভু।
এ দিকে গোটা শান্তিনিকেতনও যে এ সপ্তাহ বচ্চন-জ্বরে আক্রান্ত থাকবে, তা এখনই বলে দেওয়া যায়। ‘‘আমি ভাবতেই পারছি না উনি শান্তিনিকেতনে আসছেন। ওঁকে একটু বলুন না, ছাতিমতলার দিকে আসতে। আমরা ওঁকে একটু চোখের দেখা দেখতে চাই,’’ করুণ আর্তি বাইশ বছরের ছাত্রী সুদর্শনা চক্রবর্তীর।
শান্তিনিকেতনের শ্যুটিং: কিছু দূরের আউশগ্রামে
এমনকী বোলপুর স্টেশনের রিকশাওয়ালা, টোটোওয়ালাদের আলোচনাতেও তিনি। ‘‘অনেক বড় বড় মানুষ দেখেছে এখানকার মানুষ, কিন্তু অমিতাভ বচ্চন এখানে এসে প্রান্তিকে থাকবেন, এটা আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি,’’ বলেন এক টোটোচালক।
এর মধ্যেই সকালে শোনা গেল ওঁর কনভয় বর্ধমান ক্রস করছে। হোটেলে সাজো সাজো রব, কিন্তু কোথায় কী! উনি হোটেলে না এসে সোজা পৌঁছে গেলেন শ্যুটিংয়ে।
‘‘আমাদের শিডিউলটা এমন, উনি দুপুরে শ্যুটিং করবেন। তার পর রাতে শুধু নওয়াজউদ্দিনের শ্যুটিং। পরের দিন রাতে আবার মিস্টার বচ্চনের শ্যুটিং জঙ্গলে,’’ বলছিলেন ‘তিন’ ছবির পরিচালক। এমনিতে শান্তিনিকেতনে শ্যুটিং লেগেই থাকে। কিন্তু কোনও বারেই এই মাত্রাছাড়া উত্তেজনা থাকে না শহরজুড়ে।
এ সব দেখে শুনেই শেষ কথাটা সুজয়ই বললেন। ‘‘সুপারস্টারডম কাকে বলে, দেখলেন তো! একটা লোকের জন্য ক্যামেলিয়া হোটেল কর্তৃপক্ষ দেওয়াল ভেঙে দিয়েছে। পুরো শহরে শুধু ওঁর নাম জপছে মানুষ। মাঝে মধ্যে মনে হয়, একদিনের জন্যও যদি অমিতাভ বচ্চন হতে পারতাম,’’ হাসতে হাসতে বলেন ‘কহানি’র পরিচালক।