মিঠুন চক্রবর্তী। —ফাইল ছবি।
তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গেলে বরাবর কলকাতার বিলাসবহুল হোটেলে পৌঁছতে হয়। রাতের শহরকে উপর থেকে যেমন ঝলমলে দেখায়, ৭৪ বছরে এসে মিঠুন চক্রবর্তীও তা-ই। সেই ‘মৃগয়া’ থেকে প্রায় ৫ দশক পাবলিক লাইফের অঘোষিত ‘মনার্ক ! ঠিক যেমন উটিতে বড় সব হোটেলের চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে মিঠুন চক্রবর্তীর হোটেলের সাম্রাজ্য। যার রয়েছে নিজস্ব হেলিপ্যাডও।
দিন কয়েক হাসপাতালে ছিলেন। সুস্থ হয়েই ফিরেছিলেন শুটিংয়ে। বর্তমানে হাতে প্লাস্টার নিয়ে আরও একটি ছবির কাজ করছেন তিনি। এর মাঝেই আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কথা বললেন অভিনেতা মিঠুন ও ‘শাস্ত্রী’ ছবির প্রযোজক সোহম চক্রবর্তী। (নিষেধ ছিল আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করা)
প্রশ্ন: অসুস্থতার মধ্যেই কাজ করছেন। এতটা মনের জোর পান কী ভাবে?
মিঠুন: হায়দরাবাদ থেকে ওরা চলে এসেছিল লুক টেস্টের জন্য। তখন লিফ্ট চলছিল না। পরিচালক আসার আগেই বেকায়দায় আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে যাই। চিকিৎসক বললেন, হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। পরের দিন অস্ত্রোপচার হল। বেশ কষ্টকর ছিল সবটাই। তবে তার পরে সেলাই কাটা হল, আমি মুম্বই ফিরে গেলাম। ঠিকই ছিলাম। আবার একদিন শৌচালয় থেকে বেরিয়ে হাত নিয়ে ভোগান্তি। বুঝলাম, আমার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। আবার পড়ে গেলাম। অস্ত্রোপচার হওয়া জায়গাতেই ফের আঘাত লাগল। খুবই কষ্ট হয়েছে। যন্ত্রণা কমানোর ওষুধ নিয়ে কাজ করছি। আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি।
প্রশ্ন: পুজোয় মুক্তি পাচ্ছে ‘শাস্ত্রী’। পাশাপাশি রাজ্য জুড়ে একটা আন্দোলন চলছে। কী মনে হচ্ছে?
মিঠুন: আন্দোলন সাধারণ মানুষের। এক সাধারণ মানুষের গল্প রয়েছে এই ছবিতেও। ছেলে-বৌ নিয়ে তার সংসার। কিন্তু সাধারণ মানুষ থেকে ‘শাস্ত্রী’হয়ে ওঠার সফর দেখানো হয়েছে ছবিতে। গরিব মানুষেরা সবাই স্বপ্ন দেখে, পরের দিন সকালে উঠে যেন সব ঠিক হয়ে যায়। একটা অদ্ভুত জাদুর অপেক্ষায় থাকে তারা। হঠাৎ একদিন সেটাই ঘটে যায় বাস্তবে। এমন জাদু পৃথিবীতে ঘটতেই থাকে। কিন্তু একটা সময়ে সেই জাদুর রেশ চলে যায় এবং সেই মানুষটা বুঝতে পারে, সে নিতান্তই সাধারণ মানুষ। জাদু থেকে বাস্তবে এসে দাঁড়াবে এই ছবি। আমাদের এখন বিচার করতে হবে, আমরা কী চাই। জাদু স্থায়ী নয়। জীবনের সংঘর্ষে কিছু পেতে গিয়ে সততার পথ যেন ভুলে না যাই আমরা। মানুষই পারবে সেই পথে নিয়ে যেতে। সময় এসে গিয়েছে।
প্রশ্ন: বাংলায় এখন যা হচ্ছে, সেটা মানুষের রাজনীতি ?
মিঠুন: এই নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। এই আন্দোলনটা সত্যিই খুব শ্রদ্ধার।
(ওষুধ খেতে উঠলেন মিঠুন। পাশেই বসে আছেন অভিনেতা, প্রযোজক সোহম চক্রবর্তী)
প্রশ্ন: কোথায় কোথায় মনে হল মিঠুন চক্রবর্তী একেবারে আলাদা?
সোহম: অভিনয় অনেকেই করেন। আমরা সৌভাগ্যবান যে, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো একজন অভিনেতাকে পেয়েছি। তবে তারও ঊর্ধ্বে মানুষ মিঠুন চক্রবর্তী। এত সাফল্য পাওয়ার পরেও মানুষটা এত বিনয়ী। কোনও ভেদাভেদ ছাড়াই সকলের সঙ্গে মেশেন। নিজের শুরুর দিনগুলো ভুলে যাননি তিনি।
আমার ছোটবেলা এই মানুষগুলোর ছত্রছায়ায় কেটেছে। কিন্তু এখনকার মানুষ লিফ্টে চড়ে দ্রুত উঠে পড়েন। তাঁরা কিন্তু সিঁড়ির মর্ম বোঝেন না। এঁরা অতীত ভুলে যান। কিন্তু মিঠুন আঙ্কল ভোলেননি। ‘ভাগ্যদেবতা’থেকে ‘লে হালুয়া লে’— কত ভাল সময় কাটিয়েছি। অন্যদের কী ভাবে সম্মান করতে হয় সেটাও শিখেছি ওঁর থেকে। আমি তো নতুন প্রযোজনা করছি। তিনি চাইলেই না বলতে পারতেন। কিন্তু প্রথম দিনই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
প্রশ্ন: এই চরিত্রের জন্য মিঠুনের প্রস্তুতি দেখে কী মনে হল?
সোহম: এই চরিত্রের জন্য প্রথম থেকেই মিঠুন আঙ্কলের কথা ভাবা হয়েছে। চরিত্রটির কথা ভাবতে গিয়ে প্রথমেই ওঁর উপস্থিতিটা চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তার পরে ওঁর সঙ্গে কথা বলে চরিত্রটি তৈরি হয়েছে। চরিত্রটি কী ভাবে মিঠুন আঙ্কল ফুটিয়ে তুলেছেন, তা পুজোয় ছবি মুক্তি পেলেই দেখতে পাবেন।
সোহম চক্রবর্তী। ফাইল ছবি
প্রশ্ন: ১৬ বছর পরে দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে অভিনয় করলেন। কেমন অভিজ্ঞতা?
মিঠুন: সময়ের এই ব্যবধানের কোনও প্রভাব পড়েনি। ও তো আমার ঘরের লোক। আগে তো ওঁদের বাড়িতেই থাকতাম আমি। চুমকি তো ছোট থেকেই বড় হয়েছে আমার কাছে। চরিত্র পছন্দ না হলে ও অবশ্য এখন আর কাজ করে না। তবে এত বছর পরে ওর সঙ্গে কাজ করছি বলে আলাদা করে কোনও উত্তেজনা নেই আমার।
প্রশ্ন: কেন উত্তেজনা নেই?
মিঠুন: আসলে একটা সময় এত কাজ করেছি একসঙ্গে। আলাদা করে কোনও উত্তেজনা তৈরি হয় না আর।
প্রশ্ন: অনেকেই বলছেন, এ বার পুজোয় ছবি দেখবেন না…
মিঠুন: যাঁরা দেখবেন না, সেটা তাঁদের ব্যাপার। এখন তো ছবি দেখার এতগুলো মঞ্চ, আগের মতো ছবি দেখার মেজাজটাই নেই। আগে যেমন পরিবার নিয়ে ছবি দেখতে যেতেন মানুষ। তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এখনও প্রেক্ষাগৃহে ছবি দেখতে ভালবাসেন। পুজোই তো ছবি দেখার সময়!
প্রশ্ন: প্রযোজক হিসাবে কী মনে হয়?
সোহম: ব্যবসার নিরিখে দেখলে পুজোই ছবিমুক্তির উপযুক্ত সময়। আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম, ছবিটাকে এমন মাত্রায় নিয়ে যেতে হবে, যাতে পুজোয় ছবিমুক্তি হয়। ফ্লোরে যাওয়ার আগেই ২০২৩-এ আমরা ঘোষণা করেছিলাম, ২০২৪-এর সবচেয়ে বড় ছবি ‘শাস্ত্রী’। এই ছবিতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁরা প্রত্যেকে দক্ষ অভিনেতা। সব মিলিয়ে নিজেদের পরিশ্রম নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী। বাকিটা তো ভাগ্য।
প্রশ্ন: জ্যোতিষচর্চায় বিশ্বাস করেন?
মিঠুন: আমি বিশ্বাস করি। অনেকেই বিশ্বাস করেন না যদিও। আমি কিন্তু বিজ্ঞানকেও উপেক্ষা করি না। আসলে জ্যোতিষও একটা বিজ্ঞান। তবে আমি কোনও আংটি পরি না।
প্রশ্ন: বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রির আরও বড় ক্ষেত্র পাওয়া উচিত?
মিঠুন: অবশ্যই। আমিও তো বার বার ফিরে আসি বাংলায় অভিনয় করার টানে। যদিও আমার এই ফিরে আসা পরিকল্পিত নয়। ‘কাশ্মীর ফাইল্স’-এর পরে একের পর এক হিন্দি ছবির প্রস্তাবও আসছে আমার কাছে। এ দিকে ‘প্রজাপতি’ছবিটি সফল হওয়ার পরে বাংলাতেও একের পর এক কাজ আসছে। তাই পুরোপুরি হিন্দি ছবিতে সেই ভাবে কাজ করতে পারছি না। এখন একটা হিন্দি ছবি করছি।
প্রশ্ন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে কিছু বলতে চান?
মিঠুন: বাংলা ইন্ডাস্ট্রি ক্রমশ ছোট হচ্ছে। ছোট করে নিচ্ছি আমরাই। নিজেদের স্বার্থেই করছি। এর প্রভাব তো ব্যবসাতেও পড়বে।
প্রশ্ন: সামনে এসে কথা বললেই আজ অভিনেতারা ট্রোলড হচ্ছেন। ইন্ডাস্ট্রির মধ্যেই কিছু দিন আগে পরিচালক বনাম টেকনিশিয়ানদের কোন্দল হল…
সোহম: সকলের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে। কিছু অপছন্দ হলে বলার জায়গা আছে। কিন্তু কী ভাবে বলছি, তার তো একটা সীমা আছে। যাঁরা সীমা অতিক্রম করছেন, নিজেদের অশিক্ষার পরিচয় দিচ্ছেন। ভাষার দিকটা তো মাথায় রাখতে হবে। আমরা মানুষের জন্যই আজ খ্যাতনামী হয়েছি। কিন্তু তার মানে এই নয়, সকালে উঠে চায়ের কাপের ছবিটাও পোস্ট করতে হবে। ব্যক্তিগত জীবন বলেও তো কিছু রয়েছে। নিজের শয়নকক্ষে যদি মানুষকে প্রবেশ করতে দিই, তা হলে তো আর কিছু বলার থাকে না। নিজেকেও একটু আটকাতে হবে।
প্রশ্ন: আরজি কর-কাণ্ডের আবহাওয়ায় সকলেই ভাবছেন ছবির প্রচার করবেন কী ভাবে। আপনি কী ভাবে দেখছেন?
সোহম: সবার মধ্যেই মানসিক দ্বন্দ্ব কাজ করছে। এমন পৈশাচিক ঘটনা যেন পৃথিবীর আর কোথাও না ঘটে। এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার, যাতে পরবর্তী কালে এমন ঘটনা ঘটাতে ভয় পায় মানুষ। একজন রাজনীতিবিদ ও অভিনেতা হিসাবে আমাকে ভেবে কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু একজন মানুষ হিসাবে আমার মনে হচ্ছে, এই অপরাধীদের মানুষের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। হাত-পা কেটে দেওয়া উচিত। কিন্তু গণতান্ত্রিক ভাবে এটা আমি বলতে পারি না। আমরা কে কী করব, খাব— সেগুলো তো আমরা পরস্পরের উপরে চাপিয়ে দিতে পারি না। বার বার বলছি, অপরাধীরা শাস্তি পাক। কিন্তু আমাদের তো কাজটাও করতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার ও মিঠুন চক্রবর্তীর ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ এই ছবির কাজে বাধা হয়েছে কখনও?
সোহম: না, কখনওই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমাদের সম্পর্কটা রাজনৈতিক রঙের অনেক ঊর্ধ্বে। প্রথমে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আমরা পরস্পরের মতাদর্শকে শ্রদ্ধা করি।