Debojyoti Mishra

‘শরৎ-সুনীল-শক্তি দিনের শেষে রবীন্দ্রনাথে ফিরেছেন’

বললেন দেবজ্যোতি মিশ্র। তাঁর নতুন ছবির প্রদর্শনী থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যৌক্তিকতা নিয়ে বিস্ফোরক তিনি। মুখ খুললেন আনন্দবাজার ডিজিটালের কাছে।

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৯ ১২:০৪
Share:

দেবজ্যোতি মিশ্র।

কম্পোজার দেবজ্যোতি মিশ্র ছবি আঁকছেন কেন?

Advertisement

ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকি আমি। কেমন যেন এসে যায়। ‘চোখের বালি’আর ‘রেনকোট’-এর মিউজিক স্কোরে অনেক ছবি আঁকা আছে আমার। বেখেয়ালে সেই কবে ‘বিনোদিনী’-কে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। জীবন বদলায়, আমার ছবি আঁকাও বদলায়। সেই বদলের নানা ইমেজ নিয়ে হ্যারিংটন স্ট্রিটে ৩০ অগস্ট, শুক্রবার থেকে আমার ছবির প্রদর্শনী। আমার ছবির প্রদর্শনীতে দেবজ্যোতি বসু আর তরুণ ভট্টাচার্য পারফর্মও করবেন। ৩০ অগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর এই প্রদর্শনী চলবে।

Advertisement

যোগেন চৌধুরী থেকে লালুপ্রসাদ সাউ আপনার ছবির ভক্ত। কেমন লাগে?

আসলে গানে যা বলতে পারি না। তা ছবি দিয়ে বলতে চেষ্টা করি শুধু।

কী বিষয় আঁকছেন আপনি?

আমার ছবিতে যেমন মিউজিক একটা বিষয়, তেমনই নানা মুখ ও অন্য বিষয়। বাবা-মায়ের কাছে শোনা দেশভাগের নানা বিষাদের মুখ। খুশির মুখ।

আরও পড়ুন- টলিউডের মেন্টররা

সৌমিত্র এবং দেবজ্যোতি

২০১২-তেও আপনার ছবির প্রদর্শনী হয়েছিল?

হ্যাঁ। সৌভাগ্যবশত সেই প্রদর্শনীর সব ছবি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। চেষ্টা করি মানুষকে স্পর্শ করে এমন কিছু করতে।

সেই স্পর্শের তাগিদেই কি আপনি গানের জায়গায় সব সময় এক্সপেরিমেন্ট করেন? দেবজ্যোতি মিশ্র মানেই কি এক্সপেরিমেন্ট?

দেখুন অতীতকে নস্যাৎ করতে মুহূর্তকে নিয়ে জেগে থাকতে চাই আমি। আমাদের একটা দিনের সঙ্গে পরের আর একটা দিনের কিন্তু কোনও মিল থাকেনা। আমরা, আমি বদলে যাই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। একরকম কাজ করছি। ভাল কাজ করছি। এমন হয় না কখনও। জীবনকে জীবন্তভাবে পেতে গেলে বদলে যাওয়া জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে নিজের কাজ। সেই জন্য নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কেউ তাকে কমপ্লিমেন্ট দিতে পারে, কেউ না-ও দিতে পারে। যাঁরা দেবেন না তাঁদের মতামতকেও সম্মান করি।

আপনি তো সম্প্রতি গানও গাইলেন...

হাসিনা আ ডটার্স টেল।এক কন্যার বিলাপ গাঁথা।মুজিবুর রহমানের জীবনকে কেন্দ্র করে একটা ছবি হল। এই ছবিতে আমি প্রথম ‘সাধ না মিটিল’গেয়েছিনিজের মতো করে। বাংলাদেশের মানুষের ভাল লেগেছে।

ছবির কাজও তো করছেন।

অতনু ঘোষের ‘বিনি সুতো’-য় জয়া আহসান আমার পরিচালনায় খুব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন। হরি বিশ্বনাথের ছবি করছি। ‘বাঁশুরি’। অনুরাগ কাশ্যপ আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত কাজ করেছে। অন্বেষা গান গেয়েছে। পাপন গাইবে।আর একটি হিন্দি ছবি করলাম অমিত জৈনের। এই ছবিতে ছ’টা গান সৌরিমা ঘোষ গেয়েছে। ছবির নাম ‘বাওরি’।আমি আর আমার পরিচালক চাইলে নাম করা মানুষকে দিয়ে গাওয়াতে পারতাম। গাওয়াইনি কিন্তু। রাজর্ষির পূর্ব পশ্চিম করছি। এনামেল করিম নির্ঝরের ছবি করছি। অর্ক মুখোপাধ্যায় গান গেয়েছেন।

অন্বেষা এবং দেবজ্যোতি

আপনি নতুনদের সুযোগ দেন?

আমার কাজের গ্রাফ যদি দেখেন দেখবেন শ্রীকান্ত আচার্য, রাঘবকে আমি সুযোগ দিই। নচি পাঠিয়েছিল শুভমিতাকে। আমি ওকে প্রথম সুযোগ দিয়েছি। প্রতীক চৌধুরী, শ্রাবণী সেনকে দিয়ে গাইয়েছি। প্রথম ও ঋতুর ছবিতে গায়।যারা যখন নতুন সকলের জন্যই আমার জায়গা ছিল, আছে।যাদের কথা বললাম তাদের তখন নাম ছিল না। দুর্নিবার, শোভন গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়েও গাইয়েছি। আমার পরিচালনায় টেলিভিশন সিরিয়ালে সব নতুনরা গাইছে। ‘গানের ওপারে’র শর্মিষ্ঠা আর সমন্তক একদম নতুন ছিল। কলকাতা শহরে এত নতুনদের নিয়ে কেউ কাজ করেনি বোধহয়। প্রত্যেক দিন আমিও তো নতুন। ওরাও আমায় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যাচাই করে নেয়।

রবীন্দ্রনাথের গানের যে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বপক্ষের যুক্তিতে আপনাকে দাঁড় করানো হয়েছে। কেন?

খুব ভাল পর্যবেক্ষণ। আমি চেয়েছিলাম তারুণ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়ে দিতে। তাই এই পক্ষ সমর্থন। সব পরীক্ষাই যে আমার ভাল লেগেছে তা নয়। রবীন্দ্রনাথ আমার বয়স কালের ধর্ম। তরুণ বয়সে রবীন্দ্রনাথ টানেনি আমায়।টেনেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস! পরবর্তীকালে বুঝি আমার যে কোনও দুঃখ, বেদনা, পরিতাপে রবীন্দ্রনাথের গান আমায় টেনে নেয়। আসলে মানুষের নিজের মধ্যে অনেক দোটানা থাকে।

আপনার কি দোটানা ছিল?

আমার একটা মন বলত বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথের গান রক্ষা করেছে ভাল করে এটা যেমন ঠিক, তেমনই দেবব্রত বিশ্বাসের উপর চলা স্বৈরতান্ত্রিকব্যাপার সম্পূর্ণ অন্যায়। আমি সমর্থন করিনি। আমার ভেতরে বিদ্রোহ তখন জেগেছিল! মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ কম্পোজার। আমি বিশ্ব সঙ্গীতের অতি উৎসাহী ছাত্র। আমি শুনেছি সেই সঙ্গীত, তাই হলফ করে এটা বলতে পারি।আমি যখন তাঁর গান ব্যবহার করেছি পরবর্তীকালে, তখন মনে রাখতে হবে আমি ভিস্যুয়াল মাধ্যমে কাজ করেছি। সে ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি হোক, মৃণাল সেন হোক বা গোবিন্দ নিহালনি হোক। রবীন্দ্রনাথ একজন কম্পোজার, তাঁর গান স্বরলিপিচ্যুত হতে পারে না। শ্রাবণী সেন আমার স্বরবিতান। আগে স্বরলিপি থেকে ওর কাছে গান তুলেছি তারপর প্রয়োজনে ভিস্যুয়ালের তাগিদে অর্কেস্ট্রেশন করেছি। বেথোফেন, মোৎজার্ট কি কখনও পুরনো হয়? শেকসপিয়ার চারশো বছর রইলেন, তাঁর ওপর অনেক প্রলেপ পড়েছে। সেখান থেকেই মকবুল তৈরি হল তো।

আরও পড়ুন- অক্ষয় কুমারের ‘হামসকল’-এর দেখা মিলল কাশ্মীরে

মহড়া চলছে

এখন রবীন্দ্রনাথের গান কীভাবে শুনতে চান?

খালি গলায়।এটা আমার হৃদয়ের বাসনা। বা একটা এস্রাজের সঙ্গে শুনব।গুনগুন করে ঘরের মধ্যে গাইলেও রবীন্দ্রনাথের গানের তুলনা নেই। যা কিছু ফেলে এলাম তার মধ্যেও আধুনিকতা আছে। ট্র্যাডিশন মেনে শিক্ষা নিয়ে যাঁরা গান গাইছেন তাঁরা আমার শ্রদ্ধেয়। সেই সাবেকি রবীন্দ্রনাথের গান আমার ভাল লাগার জায়গা। রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে তা যেন যথেষ্ট ভাবে রবীন্দ্রনাথের গান মনে হয়! ভাল করে গান শিখে জীবনের নিরিখে তাকে ফেলতে হবে। ‘লাইক’ বা ‘ভিউ’ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান বা শিল্পীর নির্বাচন হবে না কিন্তু। আমার তো মনে হয় পুরনো শিল্পীর গানই থাকবে।

আর নতুনরা?

নতুনরা নিশ্চয়ই বিপ্লব বিদ্রোহ করবে। কিন্তু তারাও দিবা অবসানে ফিরবে পুরনো শিক্ষায়। যেমন শরৎ-সুনীল-শক্তি রবীন্দ্রনাথে ফিরেছেন, এই নবীন গানের দল রবীন্দ্রনাথের ট্র্যাডিশনে ফিরবে। কবিতায় যেমন রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-জয় গোস্বামী বলি, এর মাঝেও অনেক ভাল কবি আছেন। কিন্তু জয় যেভাবে ঘরে ঢুকছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে, তার তর্ক তৈরি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সেটা একটা আলাদা জায়গা। গানেও তাই। ট্র্যাডিশনের মধ্যে যে আধুনিক মুহূর্ত তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, আমি এই শাশ্বত সৃষ্টিধারার মধ্যে ঘুরছি। খুঁজছি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement