ধৃতিমান। ছবি: নিরুপম দত্ত
প্র: কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে ছবি দেখলেন?
উ: উৎসবের একটি অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করলাম। আসলে কয়েক দিন আগেই মামিতে (মুম্বই অ্যাকাডেমি অব মুভিং ইমেজ) অনেক ছবি দেখেছি। সামনে গোয়ায় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এত সিনেমা দেখলে ওভারডোজ় হয়ে যাবে!
প্র: প্রফেসর শঙ্কু এত জনপ্রিয় একটি চরিত্র যে, প্রত্যাশার চাপও বিরাট। এটা কখনও ভাবিয়েছে?
উ: সিনেমা নিজের মতো আচরণ করবে না কি সাহিত্যকেই পর্দায় দর্শাবে? আমার মতে, সিনেমার যদি নিজস্বতা না থাকে, তা হলে সেটা অনুবাদই রয়ে গেল। মৌলিক সৃষ্টি হল না। শার্লক হোমসের কত রকমের অ্যাডাপটেশন হয়েছে। স্টেজ, সিনেমা, ওয়েব— সবটাই তো মূল টেক্সট থেকে আলাদা। সত্যজিৎ রায়ের ভিশনের সঙ্গে সন্দীপ রায়ের ভিশন এক হবে, এমন তো নয়। কিছু দিন আগে ‘মাদারলেস ব্রুকলিন’ ছবির রিভিউ পড়ছিলাম। ছবিটা একটা উপন্যাস থেকে নেওয়া। সমালোচক বলেছেন, ‘যে কোনও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন পরিচালকের উচিত, সাহিত্য থেকে সিনেমা করার সময়ে, বইয়ের কথা মাথা থেকে বার করে সিনেমাতেই মনোনিবেশ করা।’
প্র: ‘শঙ্কু ও এল ডোরাডো’র টিজ়ার রিলিজ়ের পরে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু নেতিবাচক মন্তব্যও উঠে এসেছে।
উ: সোশ্যাল মিডিয়া, ইউটিউবের দৌলতে এখন সবাই সমালোচক। একটা ছবির টিজ়ার বেরোনোর পরেই নানা জায়গায় লেখালিখি শুরু হয়ে যায়। এর ভাল-খারাপ মন্তব্যের একটা প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সেগুলো পড়ে অনেক মানুষ ঠিক করে নেন, ছবিটা দেখবেন কি না। তবে আমার প্রথম দায়বদ্ধতা পরিচালক এবং চিত্রনাট্যের কাছে। এই দুটোর ভিত্তিতেই ছবি বাছি।
প্র: কোনও দিন ভেবেছিলেন শঙ্কু করবেন?
উ: আসলে শঙ্কু করার মতো বয়সটা তখন ছিল না। তার উপর শঙ্কুর কার্যকলাপ, নর্থ পোল, ব্রাজ়িল... এমন সব জায়গায় যে, ইচ্ছে থাকলেও বাংলায় শঙ্কু করা যাবে কি না, সেই প্রশ্নটা মাথায় ঘুরত। আবার অর্থ, পরিকাঠামো সামলাতে পারলে শঙ্কু দারুণ একটা আন্তর্জাতিক প্রজেক্ট হবে, এটাও মনে হত।
প্র: এখনকার বাংলা ছবি দেখেন?
উ: চেষ্টা করি। হলে গিয়ে না পারলে টিভি, স্ট্রিমিংয়ে মোটামুটি দেখি।
প্র: কখনও মনে হয়েছে, কেন বাংলা ছবি প্রথম সারির আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালগুলোয় সমাদৃত হচ্ছে না এখন?
উ: আসলে অনেক দিক বিবেচনা করতে হবে। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির ক্রমাগত বিবর্তন হয়েছে। আশির দশকে আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। তখন একটু চড়া দাগের ছবি হত। তার পর এল সিরিয়ালের যুগ। তাতে আর্থিক দুরবস্থা খানিক কাটল। নব্বইয়ের দশকে তৈরি হল একটা অল্টারনেটিভ মেনস্ট্রিম। ঋতুপর্ণ ঘোষ এলেন। দুর্বোধ্য নয় অথচ রুচিপূর্ণ ছবি তৈরি হতে লাগল। দর্শক-সিনেমার যোগসূত্র তৈরি হল। সেই পর্যায়টা এখনও চলছে। এর বিরূপ সমালোচনা করার কোনও কারণ নেই। এতে লোকে কাজ পাচ্ছে। কিছু ব্যতিক্রমী ছবিও হচ্ছে। প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য, আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত-সহ কেউ কেউ ভালই কাজ করছে। তাই গেল গেল রব তোলার কোনও মানে নেই।
প্র: আপনি তো সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ অ্যাক্টিভ।
উ: হ্যাঁ। তবে আজ কী দিয়ে ভাত খেলাম গোছের চর্চা করি না (হাসি)! ছবির প্রচার, সেলফি এ সবে নেই। আর্টস, সিনেমা এবং রাজনীতি নিয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে, সেটুকুই সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরি। এখন পলিটিক্যাল বিষয় সবচেয়ে বেশি অ্যাড্রেস করি। রাজনৈতিক ভাবে আমরা খুব খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তথাকথিত জাতীয়তাবাদ বিপজ্জনক একটা জায়গায় যাচ্ছে। অনেকে আমার সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু মত প্রকাশ করাটা জরুরি। আমি পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট নই। কিন্তু বিকল্প মত, বিকল্প ধারাও প্রকাশিত হওয়া দরকার।
প্র: বিকল্প মত প্রকাশ করলে হেনস্থা হওয়ারও ভয় রয়ে যায়।
উ: এটা আরও ভয়ঙ্কর একটা দিক। তবে এখনও পর্যন্ত আমার সেই ভয়টা নেই।
প্র: বাংলা ছবিতে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ছাপ নেই...
উ: আমরা যাঁরা ষাট-সত্তরের দশকের লোক, তাঁরা দেখেছি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, অপর্ণা সেন, উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর ছবিতে কী ভাবে রাজনীতি উঠে এসেছে। এখন আর কেউ সেটা করে না। এটা আমার কাছে হতাশাজনক। বহু নামী পরিচালককে দেখি, সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব অথচ ছবি বানানোর সময়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আর সাহস করে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ছবি বানাতে পারছেন না। যদি মৃণাল সেনের কলকাতা সিরিজ়ের কথা বলি, তা হলে এখনকার যা পরিস্থিতি, তাতে পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট নয়, ছবিও দারুণ হত।
প্র: এত কম ছবি করেন কেন?
উ: জুন মাসে শেষ হিন্দি ছবি ‘চেহরে’ করেছি। একটি ওয়েব সিরিজ় করতে চলেছি। ওই জগৎটায় কাজ করে দেখার ইচ্ছে আছে। কাজ করতে গিয়ে চরিত্র, পরিচালক, প্রযোজক, সহ-অভিনেতা সব মিলিয়ে একটা পজিটিভ ভাইব প্রয়োজন। কাজ করতে গিয়ে ভাল লাগবে তো? এনার্জি পাব তো? এত কিছু ভেবে ছবি বাছাই করি। যেহেতু গোয়াতে একটা বাসস্থান আছে তাই মুশকিলে পড়লে আমার রেডিমেড অজুহাত হল, ‘ওই সময়ে তো শহরে নেই’ (হাসি)।