মৈনাক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।
রাজ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘বরবাদ’ ছবির খলনায়ক ইমরানকে মনে আছে? ২০১৪ সালে মৈনাক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে টলিউড পেয়েছিল নতুন খলনায়ক। যদিও তার অনেক আগে থেকেই ইন্ডাস্ট্রিতে পায়ের নীচের জমি শক্ত করতে লড়াই শুরু মৈনাকের। বর্তমানে ‘ইচ্ছে পুতুল’ সিরিয়ালে অভিনয় করছেন তিনি। সিরিয়াল, সিনেমা, ওয়েব সিরিজ়— তিনটি মাধ্যমে কাজ করেও ‘নায়ক’ তকমা এখনও অধরা। সম্প্রতি এক বিকেলে ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের অনবরত সংগ্রামের গল্পই আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন অভিনেতা।
প্রশ্ন: শুনেছি আপনার বাবা ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। আপনি কী ভাবে অভিনয়ে চলে এলেন?
মৈনাক: পাড়ার মঞ্চে নাটকের মাধ্যমেই হাতেখড়ি। তখন তো ছোট ছিলাম। পাড়ার সবাই মিলে বেশ মজা করেই একটা নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম। কলেজে আমি অবশ্য বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিলাম। তখন থেকেই অভিনয়ের প্রতি এক বিশেষ টান অনুভব করি। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভবিষ্যতে অভিনেতাই হব। তখনই দমদমের একটি নাটকের দলে যুক্ত হই।
প্রশ্ন: অনেকেই নাটক থেকে অভিনয় জীবন শুরু করেন, কিন্তু তার পর আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না।
মৈনাক: আমি এই বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নই। কারণ চেষ্টা করলে তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আবার শুধু থিয়েটার দিয়ে তো পকেট ভরে না। এটাও কিন্তু সত্যি।
প্রশ্ন: আর্থিক সচ্ছলতার জন্যই কি থিয়েটার ছেড়েছিলেন?
মৈনাক: ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি নিয়মিত নাটক করেছি। তখনই ‘অসম্ভব’ নামের একটা সিরিয়ালে সুযোগ পাই। কিন্তু একটা সময় সবটা একসঙ্গে সামলে উঠতে পারছিলাম না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: মা-বাবা অভিনেতা হওয়ার আপনার এই সিদ্ধান্ত সহজে মেনে নিয়েছিলেন?
মৈনাক: আমি উত্তর কলকাতার ছেলে। তা ছাড়া মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন যে, বাড়ির ছেলের পেশা অভিনয়। তাই মা-বাবাকে বোঝানোর জন্য অনেকটাই কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘‘মাথার ছাদ করে দিয়েছি। তুই ভবিষ্যতে নিজের খাবার জোগাড় করে নিস।’’ আমি বাড়ির বড় ছেলে। ফলে সংসারের হাল ধরার চাপও ছিল। কিন্তু মা আমার পাশে ছিলেন। দেখুন, চাকরি আমার দ্বারা হত না। অভিনয় না করলে আমি হয়তো পেশাদার পর্বতারোহী হতাম। কোর্সও করেছিলাম। তার পর তো অভিনয়টা ‘ক্লিক’ করে গেল।
প্রশ্ন: কবে সেই আত্মবিশ্বাস তৈরি হল?
মৈনাক: তখন আমি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজ করি। আচমকাই রবি ওঝার প্রযোজনা সংস্থা থেকে ফোন আসে। একটা সিরিয়ালে খুবই ছোট একটি চরিত্র। বলা যেতে পারে জুনিয়র আর্টিস্টেরই কাজ ছিল ওটা। পরিচালক রবিন নাম্বিয়ার আমায় সুযোগ দিয়েছিলেন। ওই কাজটির মাধ্যমেই অভিনয় যাত্রার পথ স্পষ্ট হয়। কিন্তু তার পর প্রায় এক বছর কোনও কাজ পাইনি। বাড়িতে বসে ছিলাম। সেই হতাশা খুব ভয়ঙ্কর। তার পর সেই রবিনই আমাকে ওঁর সিরিয়ালে সুযোগ দেন। সে সময়েই প্রথম ছবির সুযোগও আসে। খানিকটা দোটানায় পড়ে গিয়েছিলাম। যদিও রবিন পরে আমায় আটকাননি। ফলে সেই অর্থে আমার প্রথম ছবি হয় ‘অমরসঙ্গী’।
প্রশ্ন: ছবিটা কি হিট হয়েছিল?
মৈনাক: বক্স অফিসে সফল হয়েছিল। তবে তত দিনে ইন্ডাস্ট্রিতে দেব, রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সোহম চক্রবর্তীরা নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছেন। আর ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির প্রযোজনা সংস্থায় তখন নায়করা অনেকটাই প্রচার পেয়েছিলেন। আমার ছবি হিট হলেও প্রযোজনা সংস্থা তার কিছুই প্রচার করে উঠতে পারেনি। ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার গতি অনেকটাই ধীর হয়ে গিয়েছিল।
প্রশ্ন: ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রেও কি ভুল করেছিলেন বলে মনে হয়?
মৈনাক: হ্যাঁ, আমার তো ভুল হয়েছিলই। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। এ ছাড়াও যেখানে যেখানে পৌঁছনোর দরকার, সেখানে পৌঁছতে পারিনি। আমার উচিত ছিল সঠিক মানুষদের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়া।
মৈনাক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।
প্রশ্ন: ভাল কাজ পেতে ইন্ডাস্ট্রির প্রভাবশালী পরিচালক বা প্রযোজকদের ‘গোষ্ঠী’র সদস্য হওয়াটা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ?
মৈনাক: খুবই জরুরি। নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই গোষ্ঠীতে মাথা ঢোকাতেই হবে। যাঁরা বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের সবাই কিন্তু কোনও না কোনও বড় সংস্থার সঙ্গে যুক্ত। অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেতে বা পর পর কাজ পেতে গেলে সেটা করতেই হবে।
প্রশ্ন: এখন কি সে রকম কোনও দলে নাম লেখাতে পেরেছেন?
মৈনাক: না। (হেসে) এখনও ঢুকতে পারিনি।
প্রশ্ন: কোনও রকম আক্ষেপ হয়?
মৈনাক: হয়তো অনেক বেশি কাজ করতে পারতাম। সেটাই বার বার মনে হয়।
প্রশ্ন: এখন প্রথম সারির পরিচালকদের থেকে অভিনয়ের সুযোগ আসে?
মৈনাক: (চুপ থাকার পর) না। শেষ বার ‘বাবা বেবি ও’ সিনেমার জন্য নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনা সংস্থার তরফে ভাল সুযোগ পেয়েছিলাম।
প্রশ্ন: কী কী করলে ‘বড়’ পরিচালকেরা আগামী দিনে আপনাকে নিয়ে ভাববেন বলে মনে হয়?
মৈনাক: আসলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে দেখা হয় কে কার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে। সেই নিরিখে অভিনেতাকে বিচার করা হয়। ফলে প্রস্তাবও আসে সেই মতো।
প্রশ্ন: অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন ভাল কাজ পেতে হলে সকালবেলা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকের সঙ্গে কফি খাওয়াটা খুব জরুরি?
মৈনাক: অবশ্যই। কিন্তু সৃজিত মুখোপাধ্যায় তো সকালবেলা সকলের সঙ্গে কফি খাবেন না! মুশকিল তো এটাই (হাসি)।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে নতুনদের কী পরামর্শ দেবেন?
মৈনাক: ধৈর্য এবং কাজের প্রতি সততা। আর কোনও উপায় নেই। রাজ চক্রবর্তীর ‘বরবাদ’ ছবিতে নায়কের চরিত্রে আমার অভিনয় করার কথা ছিল। প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও আমায় সরিয়ে খলনায়ক করে দেওয়া হয়েছিল! এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে জীবনে। কিন্তু ধৈর্য আমায় টিকিয়ে রেখেছে এখনও। নতুন অভিনেতাদেরও এটাই বলতে চাই। নিজের উপরে বিশ্বাস রাখো।