ব্যতিক্রমী ফ্যামিলি ড্রামা

অনবদ্য অভিনয় রজত কপূর ও রত্না পাঠক শাহ-র। ভাল লাগল না ঋষি কপূরকে। লিখছেন জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়বুড়ো দাদু সবাইকে তাড়া দিচ্ছেন, কই গো তোমাদের হল? মেঘ করছে কিন্তু! বাড়ির লনে পরিবারের সকলকে নিয়ে একটা ছবি তোলানোর শখ দাদুর। আয়োজন সম্পূর্ণ। অনেক ডাকাডাকি করে সকলকে জড়ো করা গেল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৬ ০০:৪১
Share:

বুড়ো দাদু সবাইকে তাড়া দিচ্ছেন, কই গো তোমাদের হল? মেঘ করছে কিন্তু! বাড়ির লনে পরিবারের সকলকে নিয়ে একটা ছবি তোলানোর শখ দাদুর। আয়োজন সম্পূর্ণ। অনেক ডাকাডাকি করে সকলকে জড়ো করা গেল। কিন্তু ফটোগ্রাফার বড় ছেলেকে যেই বলেছে, স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে একটূ কাছাকাছি দাঁড়ান, ছিটকে বেরিয়ে গেলেন রত্না পাঠক--- এই সব নাটকে আমি নেই। রজত কপূর তাঁকে খানিকটা শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু রত্না আর কিছু শোনা বা বোঝার জায়গায় নেই। কারণ তাঁর জানা হয়ে গেছে, আগের রাতে খানিকটা মিটমাটের পরেই সকালে উঠে রজত গ্যারেজে যাওয়ার নাম করে প্রেমিকার বাড়ি ছুটে গিয়েছিলেন।

Advertisement

স্বামী-স্ত্রীর বাদানুবাদের মধ্যে বৃষ্টি আসে ঝেঁপে। সুখী পরিবারের ফ্রেম ধুয়ে সাফ। বলিউডের ফ্যামিলি ড্রামায় বৃষ্টিকে এমন ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় আগে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শকুন বাত্রার আদ্যন্ত উপভোগ্য ছবি ‘কপূর অ্যান্ড সন্স’ সে দিক থেকে ব্যতিক্রমী বটে। অথচ ‘দেখুন ভাই আমি কী ব্যতিক্রমী’ বলে হাঁকাহাঁকিটা এ ছবি অনেকাংশে এড়াতে পেরেছে। অনেকাংশে, পুরোটা নয়। সে প্রসঙ্গ পরে। আপাতত ব্যতিক্রমের গুণগানই চলুক।

ধরা যাক ফাওয়াদ খানের চরিত্রটা। মা-বাবার চোখে সে পারফেক্ট বাচ্চা। ধীর-স্থির। লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিষয়বুদ্ধি আছে। যেমন সন্তান পেলে বাবা-মা চিন্তামুক্ত হন আর কী! কিন্তু ভগবান তাকে একটা জিনিস দেননি। সেটা কল্পনাশক্তি। ফাওয়াদ লেখক হতে চায়, হয়েওছে। কিন্তু কল্পনা ছাড়া গল্প ফাঁদবে কী করে? তার যে বইটা বাজারে কেটেছে, তার প্লটটা তার নিজের নয়। গোছানো, পরিশ্রমী ছেলে। প্লট পেয়ে যাওয়ার পরে একটা কাঠামো সে তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু পরের বইটা কী হবে? ফাওয়াদ আবার হাতড়ে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে মনে হয়, ফাওয়াদ যেন আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। এক টুকরো অনুপ্রেরণা চামচে করে এগিয়ে দিতে হয়! বাকিটা সে সামলে নেয়!

Advertisement

কিন্তু এ হেন পারফেক্ট সন্তান যদি সমকামী হয়? তাকে ঘিরে যাবতীয় গর্ব-আশা-আকাঙ্খা তবে এক পশলা বৃষ্টিতেই শেষ। ‘পারফেক্ট’ পরিবারে সমকামিতার কোনও স্থান নেই। শকুন সবচেয়ে বড় বিপ্লবটা ঘটিয়েছেন এইখানে। কোনও রকম বাড়তি মেলোড্রামা, কোনও রকম ক্যারিকেচার, কোনও রকম মশলাদারি বিষয়টার গায়ে লাগতে দেননি। ‘কপূর অ্যান্ড সন্স’ তো ‘মাই ব্রাদার নিখিল’ বা ‘আলিগড়’-এর মতো ইস্যুভিত্তিক ছবি নয়। কিন্তু এর আগে কর্ণ জোহরের কারখানায় ‘কাল হো না হো’, ‘দোস্তানা’ বা ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’য়ে সমকামিতা নিয়ে যে ধরনের মশকরা দেখেছি, শকুনের ছবি তার চেয়ে একেবারে আলাদা। খুব বেশি করেই ‘স্টুডেন্ট…’-এর সঙ্গে তুলনাটা মনে আসছিল। সেখান থেকেই তো আলিয়া-সিদ্ধার্থদের যাত্রা শুরু। সে ছবিতে ঋষি কপূরকে দিয়ে যে ধরনের ভাঁড়ামি করানো হয়েছিল, শকুনের ছবিতে ফাওয়াদ যেন তার শাপমুক্তি ঘটালেন। ফাওয়াদকে দেখতে বড়ই ভাল, সঙ্গে অভিনয়টাও বেশ ভাল করেন--- তাঁর জন্য অনেকে মেয়েই (হয়তো অনেক ছেলেও) জান কুরবান করতে চাইবেন নিশ্চয়। তাদের সকলকে দেশদ্রোহী বলে জেলে পুরবেন কি না, মহামান্য সরকার বাহাদুর ভেবে দেখুন!

তবে একটা কথা। ত্রিকোণ সম্পর্কের নিষ্পত্তি ঘটনোর ব্যাপারে এত দিন কিছু চালু ফরমুলা ছিল। হয় কেউ মরে যাবে, নয় ভিলেন হয়ে যাবে। সমকামী বানিয়ে দেওয়াটা আবার নয়া ফরমুলা হয়ে না দাঁড়ায়! এই আশঙ্কাটা চুলবুলে নায়িকাকে ঘিরে ইতিমধ্যেই তৈরি হতে শুরু করেছে। উচ্ছল জীবনযাপনে অভ্যস্ত, ছুঁইমুই বাতিক বর্জিত, জেন-ওয়াই মেয়েদের একটা প্রতিমা আজকাল ঘন ঘনই পর্দায় দেখছি। দীপিকা-আলিয়া-কঙ্গনা-অনুষ্কা-পরিণীতিরা তার পুরোভাগে। খুবই ভাল। কিন্তু এটাও একটা স্টিরিওটাইপ হচ্ছে না তো? এই নতুন ছকেই অবশ্য আলিয়াকে দিয়ে একটা ভাল কাজ করিয়েছেন পরিচালক। ছবিতে দু’দুজন নায়ক থাকা সত্ত্বেও বুড়ো দাদু ছাড়া যাবতীয় হাসির সংলাপ আলিয়ার। এবং সে হাসি নির্ভেজাল উইট-এর।
সিদ্ধার্থ মলহোত্রর সঙ্গে আলিয়ার একটা রসায়ন এমনিতেই আছে। ছবিতেও তার অভাব হয়নি। সিদ্ধার্থ খুব বড় মাপের অভিনেতা হয়তো নন। কিন্তু বড় ভাইয়ের ছায়ায় ঢাকা, পরিবারের প্রতি এক গাদা অভিমান পুষে রাখা স্ট্রাগলিং লেখকের চরিত্রে তাঁকে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য লেগেছে।

ছবির সেরা পারফর্মার অবশ্য রজত আর রত্না। কী অভিনয়টাই না করলেন দুজনে! রজতকে তাও মাঝে মাঝে কিছু ছবিতে দেখতে পাই। রত্নার অভিনয় দেখার সুযোগ খুব কমই মেলে। বেশ খানিকটা হাইপার, গজগজে একটা চরিত্র। কখনও খিটখিট করছেন, কখনও পরিবেশ-পরিস্থিতির তোয়াক্কা না করে কৌটো ভর্তি তিক্ততা উপুড় করে দিচ্ছেন, আবার কখনও ভাঙি তো মচকাই না ভাব দেখিয়ে কান্না গিলতে গিলতে বলছেন, ঠিক হুঁ। তাঁর পাশে রজত খানিক অসহায়, খানিক নিষ্প্রভ একটা মানুষ। প্রতিনিয়ত স্ত্রীর নালিশের মুখে কখনও খেপে ওঠা, কখনও সইয়ে নেওয়া, কখনও ভুল করা মানুষ। তবু সেই সব ভুল আর নালিশের পাহাড় মাথায় নিয়ে ক্বচিৎ কখনও ‘চাঁদ সি মেহবুবা’ গেয়ে ওঠার মতো মুহূর্ত তৈরি হয়, একটা মোলায়েম মায়া চারিয়ে যায় কোথাও। অসুখী পরিবারের গল্প এর আগে বলিউড দেখিয়েছে কি দেখায়নি, ‘হম সাথ সাথ হ্যায়’ বা ‘কভি খুশি কভি গম’ গোত্রের পরিবার-রাজ ক্রমে পিছু হটবে কি না, এ সব তর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু বুড়ো দাদুর স্বপ্নের ফটোগ্রাফ যে মানুষের বদলে কাট আউট দিয়ে সম্পূর্ণ করতে হল, এই ধাক্কাটা বলিউড আজ দিতে পারছে, এটাই আশার কথা।

দাঁড়ান, বুড়ো দাদুর কথা ভুলিনি। তবে চরিত্রটাকে নিয়ে যত হইচই হচ্ছে, ততটা ভাল কিন্তু লাগেনি। তার একটা বড় কারণ প্রস্থেটিক মেকআপ। ঋষি কপূরকে পুরো অভিনয়টাই প্রায় করতে হয়েছে গলা দিয়ে।
মুখের পেশিকে ব্যবহার করার সুযোগই ছিল না। ফলে ‘লুক’ এখানে অভিনেতাকে ঢেকে দিয়েছে। তা ছাড়া প্রায় প্রতিটি দৃশ্যেই তাঁকে দিয়ে কোনও একটা সারপ্রাইজ দেওয়াতে হবে, এ রকম একটা চক্করে পড়ে গিয়েছেন পরিচালক। সেটা এড়াতে পারলে ভাল ছিল। ছক-ভাঙা দাদুর চরিত্রে আমি বরং ‘মাছ মিষ্টি অ্যান্ড মোর’-এর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই এগিয়ে রাখলাম!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement