রাজ দরবার
পুজো শেষ। তবে দক্ষিণ কলকাতার স্টুডিয়ো পাড়ায় এখনও বড় পুজোর প্রস্তুতি চলছে। কর্মকাণ্ডের বহর দেখে তেমনটাই মনে হতে পারে। ‘আমি সিরাজের বেগম’-এর সেটের বাইরে তাঁবুতে ডাঁই করা পুরনো কাঠের আসবাবপত্র, সিন্দুক। আর গঙ্গামাটি দিয়ে বিভিন্ন আকারের চালা তৈরি করছেন শিল্পীরা।
ছোট পর্দায় পিরিয়ড ধারাবাহিকের ট্রেন্ড জোরালো। সেই ধারাতেই স্বকীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করছেন ‘আমি সিরাজের বেগম’-এর নেপথ্য শিল্পীরা। পিরিয়ড ড্রামায় সেট ও কস্টিউমের গুরুত্ব চরিত্রের সমতুল্য। তবে নবাবিয়ানাতে যেন বাংলা ও বাঙালির ছোঁয়া স্পষ্ট প্রতিভাত হয়, সেটাই উদ্দেশ্য ধারাবাহিক নির্মাতাদের।
এই ধারাবাহিকের সেট বানানোর দায়িত্বে রয়েছেন ধনঞ্জয় মণ্ডল, যিনি পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়ার অনেক ছবির সেট তৈরি করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা কোনও সেটকে অনুকরণ করতে চাইনি। মুর্শিদাবাদের গোলাপবাগে গিয়েছিলাম ওখানকার অ্যাম্বিয়েন্স দেখতে। আর কোন কোন জিনিস তখন বেশি ব্যবহার হত, তা দেখার জন্য।’’ প্রযোজনা সংস্থার দাবি, সেট নির্মাণের খরচ প্রায় এক কোটি টাকা। গড়ে ৭৫ জন শিল্পী সেট নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চার মাস ধরে চলেছে সেট তৈরির এই কর্মযজ্ঞ। তবে এখনও দিন কয়েকের কাজ বাকি।
দু’টি ফ্লোরে সেট বানানো হয়েছে। একটি ফ্লোরে সেটের উচ্চতা অন্যটির তুলনায় বেশি। মহিলামহলের জন্যই ওই ভাবে সেট ডিজ়াইন করা হয়েছে, যাতে দরবার চলাকালীন পর্দার আড়াল থেকে চরিত্রদের দেখা যায়।
সেটের দেওয়ালের রং বেশ উজ্জ্বল। গাঢ় সবুজ, গোলাপি ও নীল রঙের আধিক্য নজর কাড়ে। ভারী পর্দার বদলে সোনালি রঙের টিস্যু ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে সেটের ডায়মেনশনে আরও একটি পরত যোগ হয়। নবাবের সিংহাসনে মণি-মুক্তো, সেটের মিরর ওয়র্ক সিরাজের বাংলাকে তুলে ধরতেই সাহায্য করেছে। সেট ডিজ়াইনিংয়ে পরিমিতি বোধ শৈল্পিক উৎকর্ষকে আরও বাড়িয়েছে।
একই পরিমিতিবোধ নজর কাড়ে চরিত্রের কস্টিউম ডিজ়াইনিংয়ে। মুঘল বা নবাবি পিরিয়ড বললেই যে রং বা ফ্যাব্রিকের ছবি মনে আসে, সেই ক্যানভাস একেবারে নেই এই শোয়ে। ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর অদিতি রায়ের কথায়, ‘‘সেলিম-আনারকলি বা ‘জোধা আকবর’-এর চেয়ে একটা আলাদা লুক সেট করতে চাইছিলাম, যেখানে বাঙালিয়ানা অক্ষুণ্ণ থাকে।’’ পোশাকের দায়িত্বে অদিতি ছাড়াও রয়েছেন কৃষ্ণেন্দু কারার ও নন্দিনী সেনগুপ্ত।
বাংলা ও ওড়িশার নিজস্ব হ্যান্ডলুম কাঁথা, তাঁত, খেস, জামদানি দিয়ে পোশাক তৈরি হয়েছে। রঙের ক্ষেত্রে টোন মূলত হালকা। যেমন পিঙ্ক, পিচ, বেজ, লাইট ব্রাউন, সাদা, কালো। তবে নেগেটিভ চরিত্রের জন্য ডার্ক রং ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন ঘসেটি বেগমের পোশাকে রয়্যাল ব্লু নজর কাড়ে। সিনিয়র চরিত্রদের (আলিবর্দি, সরফুন্নিসা) পোশাক ঢাকাই জামদানি শাড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। লুৎফুন্নেসার বেগম লুকের জন্য বরাদ্দ ঢাকাই জামদানি। সিরাজের কুর্তা সিল্ক কাপড়ের, সঙ্গে ব্রাউন রঙের জ্যাকেট, তসরের উপরে কাজ করা কাঁথার স্টিচের চাদর। মীরজাফরের জন্য সিল্কের উপরে সম্বলপুরী বা ইক্কত প্রিন্ট ব্যবহার করা হয়েছে। আর রাজদরবারের কর্মচারীদের জন্য সুতির কাপড়ে ইক্কতের প্রিন্ট। দাসীদের জন্য খেসের সালোয়ার-জ্যাকেট।
গয়নার ক্ষেত্রেও ভাবনা সুস্পষ্ট। জৈবুন্নিসার চরিত্রটি সাজগোজ করতে ভালবাসে, তার জন্য পান্নার ভারী গয়না। ঘসেটির জন্য সোনার গয়না, ছেলে চরিত্রদের মুক্তোর গয়না পরানো হয়েছে।
রং-রূপ ও বৈচিত্রে একটা যুগকে তুলে ধরা সহজ নয়। ছোট পর্দায় কাজের সীমাবদ্ধতাও অনেক। তবে এই ধারাবাহিককে অনন্য করে তুলতে খামতি রাখছেন না শিল্পীরা।