চৈতালি, সুতপা ও শাশ্বতী
দূরদর্শনের পর্দায় তাঁদের দেখে বড় হয়েছে কয়েক প্রজন্ম। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হিসেবে তাঁরা সুপরিচিত। শাশ্বতী গুহঠাকুরতা, চৈতালি দাশগুপ্ত এবং সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা করে পরিচয়ের দরকার হয় না। সংবাদপাঠিকা হিসেবে তাঁদের পরিচিতির শুরু। তবে এই তিন শিল্পীর বহুমুখী প্রতিভার এটি একটি দিক মাত্র। অভিনয়ের সঙ্গে এই শিল্পীদের যোগসূত্র দীর্ঘ দিনের।
বাংলা ধারাবাহিকের বদলে যাওয়া মানচিত্রেও তাঁরা এক ভাবে অভিনয় করে চলেছেন। দেখেছেন পালাবদলের একাল-সেকাল। শুধুমাত্র আর্থিক নিশ্চয়তার জন্যই কি তাঁরা কাজ করে চলেছেন? টিআরপির দৌড়ে ছুটতে থাকা দুই প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যানেলের ধারাবাহিকে কাজ করে তাঁরা কি আদৌ খুঁজে পান মনের রসদ? বদলে যাওয়া কাজের ধারার সঙ্গে কতটা মানিয়ে নেন তাঁরা?
১৯৯৬ সাল থেকে ধারাবাহিকে কাজ করছেন শাশ্বতী গুহঠাকুরতা। এই মুহূর্তে তিনি রয়েছেন ‘মন ফাগুন’ ধারাবাহিকে। এর আগে ‘এখানে আকাশ নীল’, ‘ইষ্টিকুটুম’, ‘কুসুমদোলা’, ‘কেয়ার করি না’র মতো ধারাবাহিকে কাজ করেছেন তিনি। ২০১৭ থেকে মেগায় কাজ করছেন না চৈতালি দাশগুপ্ত। তাঁর অভিনীত শেষ দু’টি ধারাবাহিক ছিল ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ এবং ‘ঝাঁঝ লবঙ্গ ফুল’। তার আগে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’, ‘টাপুর টুপুর’-এর মতো সিরিয়ালে ছিলেন তিনি। প্রথম মেগা ধারাবাহিক ‘বরণ’-এ কাজ করছেন সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে অনিন্দ্য সরকারের ‘এক মাসের গল্প’-এ কাজ করেছিলেন তিনি।
দূরদর্শন বা তার পরেও একাধিক বেসরকারি চ্যানেলের শুরুর লগ্নে কাজের ধারা ছিল এক রকম। শাশ্বতী বলছিলেন, ‘‘আগে দু’তিন-দিন ধরে একটা এপিসোডের শুটিং হত। কিন্তু এখন দিনে তেইশ মিনিটের কনটেন্ট তুলতেই হবে। এখনকার পরিস্থিতি হল, রানিং এগেনস্ট দ্য টাইম।’’
নিজের সৃষ্টিশীল কাজে সময় দেওয়ার জন্য বিরতি নিয়েছেন চৈতালি। ‘‘সারা জীবন তো ছুটলাম। এখন নিজের জন্য খানিকটা সময় বার করি। তবে এখনও প্রত্যেক দিন ধারাবাহিকের প্রস্তাব আসে। ‘একদিন প্রতিদিন’-এর মতো ধারাবাহিকও করেছি। সেই যুগটাই আলাদা ছিল। রাজাদের সময়েও (দাশগুপ্ত, পরিচালক) যে ধরনের ধারাবাহিক হত, তার চেয়ে কাজের ধারা এখন অনেক আলাদা। এখনকার কাজের ধারায় যে স্বস্তি পাই, তা ঠিক নয়,’’ বলছিলেন চৈতালি। সুতপার কাছে পুরো অভিজ্ঞতাটাই নতুন। হয়তো প্রথম মেগা বলেই, তিনি এখনও এর একঘেয়েমি অনুভব করেননি। ‘‘রবিবার ছুটির দিন। বাকি ছ’দিনের কাজ। অনেকটা চাকরির মতোই,’’ বলছেন তিনি।
মনের খোরাক?
শাশ্বতী এবং চৈতালি মুক্তকণ্ঠে বলছেন যে, এখনকার কাজে তাঁরা মনের খোরাক খানিক কমই পান। শাশ্বতীর কথায়, ‘‘অনেক সময়ে চিত্রনাট্যকারদের কাঠগড়ায় তোলা হয়। তবে আসল কর্তা চ্যানেল। টিআরপি হল ‘রক্তকরবী’র রাজার মতো। সে আছে, কিন্তু তাকে দেখা যায় না! সাত দিন টিভির পর্দায় থাকতে হবে। ঘন ঘন চমক দিতে হবে। সেটাই নাকি মানুষ পছন্দ করছেন।’’ সুতপার মতে, ‘‘খ্যাতি বা যশ অর্জন করতে আমাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা সেটা খুব অনায়াসে পায়। এটা একটা খারাপ লাগার দিক। বাংলা ভাষা নিয়েও অনেকে তেমন সড়গড় নয়। অভিনয়ের মতো পেশায় ভাষার দক্ষতা না থাকলে কি কাজ করা যায়?’’ প্রশ্ন তাঁর।
আর্থিক নিশ্চয়তা
একই সঙ্গে একাধিক ধারাবাহিকে কাজ করেন না শাশ্বতী। ‘‘রোজগারের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তাই করি। তবে শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা, সারা জীবনের সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে যেটুকু অর্জন করেছি, একাধিক ধারাবাহিক করলে সে সব আর থাকবে না,’’ হালকা হাসি প্রবীণ শিল্পীর কণ্ঠে। চৈতালি বললেন, ‘‘এক দিনে কিন্তু ধারাবাহিক ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিইনি। কারণ উপার্জনের নিরিখে টাকার অঙ্কটা নেহাত কম নয়। অভিনয় এখনও আমি করতে চাই, তবে মান বজায় রেখে।’’ সুতপার ধারাবাহিকে যাত্রা শুরু অতিমারি পরবর্তী সময়ে। তাঁর মতে, অতিমারি যে ভাবে শিল্পীদের রুজি রোজগারে থাবা বসিয়েছে, তাতে ধারাবাহিক খানিকটা হলেও নিশ্চয়তার জায়গা তৈরি করেছে।
টেলিভিশনে কাজের মান নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। তবে যাঁদের জীবনের সিংহভাগ কেটেছে ছোট পর্দায়, ধারাবাহিকেও তাঁদের দেখতে পছন্দ করেন দর্শক।