‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
দেশ জুড়ে হল মালিকদের জুলাই মাসটা মন্দ কাটেনি। ‘মিশন ইমপসিব্ল: ডেড রেকনিং পার্ট ১’, ‘ওপেনহাইমার’, ‘বার্বি’, ‘রকি অওর রানি কি প্রেম কহানি’। পর পর অনেকগুলি ছবি ভাল ব্যবসা করেছে। কলকাতায়ও দর্শক এই ছবিগুলি দেখতে ভালই ভিড় জমিয়েছেন। তবে হলিউডের ব্লকবাস্টার এবং কর্ণ জোহরের বহুপ্রতীক্ষিত ছবির ভিড়ে বাংলা ছবিগুলি খুব একটা লড়তে পারেনি বলা যায়। ব্যতিক্রম একটিই ছবি— অরিত্র সেনের ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’। বিক্রম চট্টোপাধ্যায় এবং শোলাঙ্কি রায় অভিনীত এই প্রেমের ছবি সদ্য পঞ্চম সপ্তাহান্ত পার করল প্রেক্ষাগৃহে। ছবির নায়ক-নায়িকা এবং পরিচালক এই অপ্রত্যাশিত সাফল্যের আনন্দ ভাগ করে নিলেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে।
প্রেমের ছবির নাকি চলে না। বাংলাতে তো না-ই, বলিউডেও না। তাই হয়তো কর্ণ জোহরও রকি-রানির কাহিনিকে শুধু প্রেমের ছবি হিসাবে রাখতে পারেননি। পুরোদস্তুর পারিবারিক ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। গত কয়েক বছরে কোন বাংলা প্রেমের ছবি খুব ভাল ব্যবসা করেছে, তা চট করে মনে করতে পারবে না ইন্ডাস্ট্রি। অথচ ‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ আদ্যোপান্ত প্রেমের ছবি। সঙ্গে রয়েছে বন্ধুত্ব এবং কলকাতা। অথচ প্রথম দিন থেকেই দর্শক ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছে এই ছবিকে। প্রথম সপ্তাহের চেয়ে দ্বিতীয় সপ্তাহে হলের সংখ্যা বাড়ে, তৃতীয় সপ্তাহে আরও বাড়ে। শহরে তো বটেই, শহরতলিতেও হল ভরিয়েছেন দর্শক। কোন জাদুবলে দর্শকের মন ছুঁয়ে গেল এই ছবি?
ছবির পরিচালক অরিত্র বললেন, ‘‘যখন গল্পের কথা ভেবেছিলাম, তখনই নানা দিক থেকে নানা লোকে বলেছিল, ‘‘বাঙালি তো বাংলা ছবিতে প্রেমের গল্প দেখতে চায় না। বেকার এ ধরনের ছবি করে কী লাভ?’’ অনেকে আবার ছবির মুক্তির আগে বলেছিল ওটিটি-তে দিয়ে দিতে, তাতে যদি কিছু মানুষ দেখেন। কিন্তু আমার নিজের গল্পের উপর বিশ্বাস ছিল। সব বড় পরিচালকেরই কোনও না কোনও ‘কামিং অফ এজ’ ছবি থাকে। যেমন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ বা ‘দিল চাহতা হ্যায়’। আমারও ইচ্ছা ছিল এই ধরনের কিছু বানানোর। এই ছবিগুলো দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তা ছাড়াও আমার নিজের জীবনের কিছু মুহূর্ত বা বন্ধুদের জীবনের কিছু গল্প থেকেই আমার ছবির ভাবনা আসে। কলকাতায় এই ধরনের একটা গল্প হওয়া উচিত, তা অনেক দিন থেকেই মনে হত। এই গল্প বলার জন্য এই শহরই সেরা। কিন্তু এমন ছবি হচ্ছিল না। তাই আমি জানতাম, এমন কিছু বানালে দর্শক নিশ্চয়ই সাড়া দেবেন। যদিও বুঝিনি, এত ভালবাসা পাব!’’
পরিচালক অরিত্র সেনের সঙ্গে বিক্রম চট্টোপাধ্যায়এবং শোলাঙ্কি রায়।
ছবির অভিনেত্রী শোলাঙ্কি যদিও জানালেন, তাঁর প্রথম থেকেই গল্পের উপর পূর্ণ আস্থা ছিল।তিনি বুঝেছিলেন যে, দর্শক যদি একবার ছবিটি দেখেন, তা হলে নিশ্চয়ই ভালবাসবেন। তিনি বললেন, ‘‘আমরা অনেক সময় অনেক বড় কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েও সেগুলোর উপর খুব ভরসা রাখতে পারি না। কিন্তু এই ছবির ক্ষেত্রে তেমন হয়নি। আমাদের প্রত্যেকের শুরু থেকেই গল্পটার উপর খুব বিশ্বাস ছিল। একটাই চিন্তা ছিল, দর্শককে হল পর্যন্ত আনা। কারণ, অতিমারির পর দর্শক আর খুব একটা হলমুখী নন। কিন্তু জানতাম, একবার হলে দর্শক এলে ছবিটা চলবেই। গত কয়েক বছরে কলকাতা কিন্তু অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। সেই দলিলটা এখনও পর্যন্ত কোনও ছবি সে ভাবে ধরতে পারেনি। এই ছবিটা সেখানেই আলাদা।’’
ছবির গল্প খুবই চেনা। ক্যাম্পাসে প্রেম। সময়ের নিয়মে সম্পর্কে দূরত্ব, বন্ধুত্বের বন্ধন আলগা হওয়া। কেরিয়ার বনাম প্যাশন। জীবনের দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়া— গল্পের প্রত্যেকটা প্লট পয়েন্টই কোনও না কোনও রোম্যান্টিক কমেডিতে আগে দেখা হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও ছবিতে একটা টাটকা বাতাস খুঁজে পেয়েছেন দর্শক। গল্পও পরিচালকের। তিনি কি জেনেবুঝেই চেনা গল্পের বাইরে বেরোননি? অরিত্র বললেন, ‘‘আমি সব সময় যে মিলিউতে কাজ করি, চেষ্টা করি সেই মতো গল্প সাজাতে। যাতে সকলের মনে হয়, পর্দায় যা হচ্ছে, সবটাই অর্গ্যানিক। কারও হয়তো মনে হল, তার বন্ধুর বাবাও এ ভাবেই কথা বলে, কারও মনে হল, তার বন্ধুর সঙ্গেও এ ভাবেই ঝগড়া হয়েছিল। যা আমাদের চারপাশে ঘটে, তা-ই দেখানোর চেষ্টা করেছি।’’ গল্প বলার গুণে পুরনো গল্প নতুন ভাবে বলতে পেরেছেন অরিত্র। এ বিষয়ে একমত ছবির নায়ক বিক্রমও। তিনি জানালেন, বিভিন্ন জায়গায় প্রেক্ষাগ়ৃহে গিয়ে তিনি দেখেছেন, শুধু কমবয়সিরাই নন, সব বয়সের দর্শকই এই ছবি ভালবাসছেন। বিক্রমের কথায়, ‘‘আমায় এক বয়স্ক দম্পতি বলেছিলেন, ছবিটা দেখে তাঁদের কলেজের কথা মনে পড়ে যায়। এটা যে একটা ছবির জন্য কত বড় পাওনা!’’ বিক্রমও আরও বললেন, বাঙালি বাদে দর্শকাসনে অবাঙালির সংখ্যাও কম নয়। হয়তো চেনা গল্প বলেই এত বেশি সংখ্যায় দর্শক ছবির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পেরেছেন।
‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।
‘শহরের উষ্ণতম দিনে’ মিষ্টি প্রেমের গল্প। অথচ শেষটা অপ্রত্যাশিত। ক্লাইম্যাক্সে চেনা ছকের প্রেমের গল্প থেকে বেরিয়ে একদম অন্য জায়গা করে নেয় ছবিটি। পরিচালক চেয়েছিলেন, বাস্তবে যেমন হয় তেমন ভাবেই গল্পটি শেষ করতে। কিন্তু সন্দিহান ছিলেন বিক্রম। শোলাঙ্কি জানালেন, বিক্রম আর অরিত্রের রীতিমতো ঝগড় হত রোজ। হাসিমুখে সে কথা মেনেও নিলেন বিক্রম,‘‘আমি অনেক বার বলেছি যে, প্রেমের গল্পে এই ধরনের শেষ ঠিক হবে না। অরিত্র অবশ্য বার বার বলেছে, এই শেষটাই এখনকার সময়কে সবচেয়ে ভাল ভাবে ধরতে পারবে। এই নিয়ে আমাদের প্রচুর আলোচনা হত। ছবিটা দেখার পর যে দর্শকের মধ্যেও এই আলোচনা হচ্ছে, সেটাই সবচেয়ে ভাল লাগছে।’’
ছবি জুড়ে একটি বড় চরিত্র শহর কলকাতাও। শহরের অলিগলি জুড়ে প্রেম ছাড়াও পরিচালক ছবিতে কলকাতাকে অনেক ভাবে ব্যবহার করেছেন। রাতের কলকাতা, ডেকার্স লেন, নিউ মার্কেট, শহরের অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে শুটিং হয়েছে ছবির। পরিচালক রিয়্যাল লোকেশনে শুট করতে ভালবাসেন। সেই মতোই চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন। তিনি বদলে যাওয়া শহরের দলিল যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই আবার গোটাটাই নস্ট্যালজিয়ায় মুড়ে দেননি। বরং দেখিয়েছেন শহরের সঙ্গে শহরবাসীর একটি অম্লমধুর সম্পর্ক। শোলাঙ্কি মনে করেন, যে কোনও ভালবাসার মানুষের সঙ্গে এমনই তো ‘লাভ-হেট’ সম্পর্ক হয়। তিনি বললেন, ‘‘শহরটা এমনই। জ্যাম, ভিড়, গরম— মাঝেমাঝেই মাথাগরম হয়ে যায়। কিন্তু একবার বৃষ্টি পড়লে ফের শহরটার প্রেমে পড়ে যাবে যে কেউ। সেই দিকটা ছবিতে ধরা পড়েছে।’’ বিক্রম সেই কৃতিত্ব দিলেন পরিচালককেই। অরিত্র দীর্ঘ দিন বিদেশে পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করেছেন এবং পরবর্তী কালে দীর্ঘ সময় শুটিংয়ের জন্যেও থেকেছেন। বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন অনেকেই প্রবাসী। অরিত্র বললেন, ‘‘আমি এই ডায়াসপোরাটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তারা বিদেশে থাকে বটে, কিন্তু কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে পরের বার কবে আসবে, তার টিকিট কেটে ফেলে। এই শহরের সঙ্গে শহরবাসীর যেমন টান, তা অন্য কোনও শহরে কিন্তু খুব একটা দেখা যায় না।’’
বিক্রম-শোলাঙ্কি ছোট পর্দার বিপুল জনপ্রিয় জুটি। বড় পর্দায় তাঁদের একসঙ্গে দেখার উৎসাহও কম ছিল না। অনেকেই মনে করছেন, ছবির সাফল্যের পিছনে বিক্রম-শোলাঙ্কির রসায়নের অবদান অনেকটাই। সে কথা মাথায় রেখে কি অরিত্র প্রথম থেকেই এই জুটির কথা ভেবেছিলেন? পরিচালক জানালেন, বিক্রমকে প্রথমে গল্পটি শুনিয়েছিলেন। পরে শোলাঙ্কিকে। কিন্তু তখনও তিনি জানতেন না, বিক্রম-শোলাঙ্কি জুটি হিসাবে কতটা জনপ্রিয়। বিক্রম এ প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘আমি জানতাম না যে অরিত্র শোলাঙ্কিকে ছবির প্রস্তাব দেবে। এমনকি, এটাও জানতাম না যে, শোলাঙ্কি ছবিতে কাজ করতে পারবে কি না। কারণ, তখন ও পুরোদস্তুর টেলিভিশনে কাজ করছে। ওর ডেট আছে কি না, তা-ও জানতাম না।’’ শোলাঙ্কির কথায়, ‘‘আমি তো গল্পটা অর্ধেক শোনার পর জেনেছিলাম, বিক্রম ছবিটা করছে। খুব এক্সাইটেড হয়ে আমি ওকে টেক্সট করেছিলাম।’’ চেনা জুটিকে পর্দায় দেখতে কতটা উৎসাহী হবেন, আগে থেকে কি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন দু’জনে? বিক্রম বললেন, ‘‘যে হেতু গল্পটা অনেকটাই আমাদের চরিত্রগুলোর রসায়নের উপর দাঁড়িয়েছিল, আমি আশা করেছিলাম যে, যদি সৎ ভাবে নিজেদের কাজটা করতে পারি, চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারি, তা হলে হয়তো দর্শকের ভাল লাগবে।’’ শোলাঙ্কি বললেন, ‘‘আমি একটু ভয়ে ভয়েই ছিলাম। অনেক বার আমায় শুনতে হয়েছে ছোট পর্দার অভিনেতারা বড় পর্দায় সফল হয় না। যদিও এই ধারণা বার বার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তা-ও অনেক সময় দেখেছি, টেলিভিশিনে হিট জুটি বড় পর্দায় সে ভাবে ভালবাসা পায় না। তবে মনে মনে একটু আশা ছিল যে, আমরা পারব কাজটা ভাল করে করতে।’’
ছবির সাফল্যে আশাবাদী নায়ক-নায়িকা-পরিচালক— সকলেই। প্রেমের ছবির চলে না, সেই অপবাদ অবশেষে ঘুচবে বলে মনে করছেন তাঁরা। পরিচালক মনে করেন, সৎ ভাবে যে কোনও কাজ করলে, তার ফল পাওয়া যাবে। আড্ডাশেষে শোলাঙ্কি যোগ করলেন, ‘‘বাঙালি তো প্রেমেরই জাত। প্রেমের ছবি না চলার কোনও কারণ নেই।’’