মধুবালা ও দিলীপ কুমার
(বিশিষ্ট শিল্প-নির্দেশক ও পরিচালক)
১৯৮৭-৮৮ সাল থেকে দিলীপ কুমারকে আমি চিনি। তার আগে থেকে মুম্বইয়ে কাজ করছি। একটা কথা তাঁর মুখে প্রায়ই শুনতাম যে, “আমি অভিনয় করতে পারি না। অভিনয় করতে জানি না।” অনেক মজার মজার কথা বলতেন। একবার একটা ঘটনা বললেন— ছবিতে শট দেওয়ার ঠিক আগে দিলীপ কুমারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না... তার পর দেখা গেল, তিনি খাটের তলায় লুকিয়ে আছেন। জিজ্ঞেস করা হল, কেন লুকিয়ে ছিলেন? উনি বললেন যে, “আমাকে এখন আবার ডায়লগ বলতে হবে, এই ভয়ে আমি লুকিয়েছি।” তো এই রকম আশ্চর্য মানুষ।
দিলীপ কুমারের নিজস্ব প্রোডাকশনের ছবি। তিন বছর ধরে কাজ চলেছিল। এই সময়ের অনেকটাই তাঁর সঙ্গে আমার কেটেছে। অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে আজ। কোনটা বলি? একদিন উনি বললেন যে, “আমি জানো তো আসলে অভিনয় করতে চাইনি। আমার বাবা কখনও চাননি যে, আমি অভিনেতা হই। কিন্তু যখন অভিনেতা হয়ে পড়লাম তখন বাড়িতে যাতে জানতে না পারে, সে জন্য আমাকে নাম লুকোতে হয়। এই 'দিলীপ কুমার' নাম নিতে হয়। তবুও বাবা যখন জানতে পেরেছিলেন, তখন এত মার মেরেছিলেন আমাকে!”
মনে পড়ে, বেঙ্গালুরুতে একটা ছবির কাজে আছি, হঠাৎ তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, “তুই চলে আয়। কাল সকাল ন'টায় আয়।” যখন গেলাম, তিনি আমাকে দেখে খুশি হলেন। বললেন, “এখানে বোস।” বসে আছি। দিলীপ কুমার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। ছোট ছেলের দল ফুটবল খেলছে, তিনি পরমানন্দে তা দেখছেন। আমাকে বললেন, “দেখ কী সুন্দর খেলছে ওরা!” আমি বললাম, “খেলা দেখছেন কেন? আপনার তো শুটিং আছে।” কিছুক্ষণ বাদে ফোন এল আমার কাছে। পরিচিত এক জন জিজ্ঞেস করছেন, “কী করছেন উনি?” আমি বললাম যে, খেলা দেখছেন। ফোনে হাহাকার ভেসে এল। “খেলা দেখছেন? আমরা ভোর চারটে থেকে সব রেডি করে বসে আছি!”
তখন দশটা বেজে গেছে। তিনি সব শুনে বললেন, “ছাড়ো তো!” এই ভাবে একটা বেজে গেল। তারপর লাঞ্চ সেরে বললেন, “আজকে আর যাব না।” এই ছবির প্রোডিউসার কিন্তু দিলীপ কুমারই। ক্ষতি তাঁরই। কিন্তু এই ধরনের খেয়ালি মানুষ ছিলেন তিনি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতেন না।
‘মুঘল-এ-আজম’ ছবির দৃশ্য
এক বার রামোজি ফিল্ম সিটিতে তিনি শুটিংয়ের কাজে এসেছেন। আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছি। আমাকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন, “আরে, শোন শোন।” আমি গিয়ে বসলাম। তার পর তিনি আমার সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিলেন। আড্ডা আর থামে না। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে ডিরেক্টর মাথা চাপড়াচ্ছেন এবং আমাকে ইঙ্গিত করছেন, ‘তুই ওখান থেকে উঠে চলে যা।' কিন্তু কী করে যাই? এত বড় একজন ব্যক্তিত্ব! তিনি আমার হাত ধরে রেখেছেন। নানা কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সে দিন আর কাজই হল না।
রামোজি ফিল্ম সিটিতে বিখ্যাত কয়েকটি ছবির সেটের মতো করে সাজানো হয়েছিল এক-একটা স্যুইট। ‘মুঘল-এ-আজম’ স্যুইটও ছিল। আমরা ভেবেছিলাম, কখনও দিলীপ কুমার এলে তাঁকে দিয়েই উদ্বোধন করানো হবে। রাতে তাঁকে বললাম, “চলুন, আপনি যেখানে থাকবেন সেই স্যুইটে নিয়ে যাই। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাঁর হাতে চাবি দেওয়া হল। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে তিনি অবাক! চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি যেন ‘মুঘল-এ-আজম’ তৈরির সেই সময়ে ঢুকে গেছেন। দু’পাতার মতো সংলাপ তিনি বলতে থাকলেন ঘুরে ঘুরে। আমাদের সকলের গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।
‘মুঘল-এ-আজম’ ছবিতে মধুবালা এবং দিলীপ কুমার
দিলীপ কুমার চলে যাওয়া মানে একটা বিশেষ শিল্পী ঘরানার অবসান। তাঁরা ঠিক আজকের মতো কঠোর পেশাদার ছিলেন না। অনেকটাই হৃদয়ের আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে বেঁচে থাকতেন, অভিনয় করতেন। দেখা গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে আছেন দিলীপ কুমার। কারওর সঙ্গে কথা বলছেন না। সবাই বুঝত, তিনি চরিত্রের ভিতরে চলে গিয়েছেন। আবার কখনও সেই চরিত্রের মতো করে কয়েক দিন হাঁটছেন, কথা বলছেন। এই রকম গভীর জায়গা থেকে অভিনয়টাকে নিয়েছিলেন বলেই বলতেন, অভিনয় পারেন না। অর্থাৎ তিনি খুঁজতেন আরও নিখুঁত ভাব। আবার যখন ইচ্ছে করছে না, তখন সিনেমা জগতের কাউকেই ঘেঁষতে দিচ্ছেন না কাছে। দেখছি, দিনের পর দিন তাঁর বাড়ির বারান্দায় বসে আছেন অনেক পরিচালক। তিনি দেখাই করছেন না। মুডই তাঁর কাছে ছিল বড় কথা।
আর একটা কথা মনে পড়ছে, প্রথম যখন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় তিনি একটা বাংলা গানের কয়েক কলি গেয়ে দিলেন দিব্যি। অবাক হয়ে যখন জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি বাংলা জানেন?”, দিলীপ কুমার আমাকে পরিষ্কার বাংলায় “এসো বসো” বলে হাসতে থাকলেন। তাঁর পরের কথাটুকু কোনওদিন ভুলব না। দিলখোলা, সরল, সুন্দর মানুষটি বলেছিলেন, “বাংলা জানে না, এমন কোনও আর্টিস্ট এই ইন্ডাস্ট্রিতে আছে? এই ইন্ডাস্ট্রি তো বাঙালিই তৈরি করেছে।”