কয়েকটি দৃশ্যে শুধু ম্যাজিক

পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ সিনেমা হলগুলোর প্রতি কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাকরণ ভাঙা ট্রিবিউট। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তীকৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সিনেমা দেখে বেরিয়ে একটা পুরনো গল্প মনে পড়ল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন তরুণ কবি, কৃত্তিবাস সম্পাদনা করেন। টাকার জন্য টিউশনি করেন, এখানে-সেখানে কাগুজে ফিচার লেখেন। কয়েকটি ফিচার পড়ার পর বুদ্ধদেব বসু নাকি একদিন অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘সুনীল, তোমার হাতে ক্ষমতা ছিল! কিন্তু গল্পের বীজটাকে ব্যবহার করে এ সব ফিচার…তুমি দেখছি, প্রায় ভ্রূণহত্যা করছ।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share:

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সিনেমা দেখে বেরিয়ে একটা পুরনো গল্প মনে পড়ল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন তরুণ কবি, কৃত্তিবাস সম্পাদনা করেন। টাকার জন্য টিউশনি করেন, এখানে-সেখানে কাগুজে ফিচার লেখেন। কয়েকটি ফিচার পড়ার পর বুদ্ধদেব বসু নাকি একদিন অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘সুনীল, তোমার হাতে ক্ষমতা ছিল! কিন্তু গল্পের বীজটাকে ব্যবহার করে এ সব ফিচার…তুমি দেখছি, প্রায় ভ্রূণহত্যা করছ।’

Advertisement

কৌশিক সুনীল নন, এই রিভিউয়ারও বুদ্ধদেব বসুর নখের যুগ্যি নন। তবু গল্পটা মনে পড়ল। যে পরিচালক সিনেমায় এত চমৎকার ম্যাজিক তৈরি করতে পারেন, তিনি ক্লিশে রূপকল্প ও ভারাক্রান্ত সংলাপে অযথা বন্দি থাকেন কেন?

প্রথমে ম্যাজিকটা বলা যাক। ছবির শুরুতে পুরনো এক জগৎ। মাথার ওপর সিলিং ফ্যান ঘোরে, সিঙ্গল-স্ক্রিন বন্ধ হয়ে থাকা কমলিনী হলে প্রোজেকশন রুমের আড়ালে অরুণ গুহঠাকুরতা ঝাড়পোছ করেন। প্রোজেক্টর আছে, কিন্তু ধূলিধূসর পর্দায় আর আছড়ে পড়ে না সিনেমা। পশ্চিমবঙ্গের বন্ধ হয়ে-যাওয়া সিনেমা হলগুলির প্রতি কৌশিকের ট্রিবিউট!

Advertisement

কিছুক্ষণ বাদে এই ট্রিবিউটে এল সিনেমার ভাষা। বাবার (পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়) বন্ধ হয়ে-যাওয়া সিনেমা হল চালাতে ইচ্ছুক নন পুত্র পরমব্রত। স্ত্রী সোহিনীর গর্ভবতী হওয়ার খবর পেয়ে পরম ঘরে ঢুকে সোহিনীকে কোলে তুলে নেয়। ঘরে রাখা সিনেমার নকল ডিভিডি ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে, সেই ডিভিডিতে জানালা দিয়ে আসা রোদ্দুর রঙিন মায়াবী আলোয় প্রতিফলিত হয়ে দু’ জনের গায়ে ঠিকরে পড়ে। একটা সময় দু’জনে সিলিং-এর দিকে তাকায়। সেখানেও আলোকরশ্মির প্রতিফলন-মায়া। ‘ওম্ মধু ওম্ মধু আই লাভ ইউ’ গোছের গান যে বাথরুমে কখনও গুনগুন করিনি এমন নয়। কিন্তু এত ভালো জাদুময় প্রেমের দৃশ্য বাংলা সিনেমায় বহু দিন দেখিনি।

আর একটি জায়গা চমৎকার। প্রোজেক্টর বেচে দিচ্ছে কমলিনী সিনেমা হল। রাস্তার ওপরে ইলেকট্রিকের তার, এগিয়ে যায় ম্যাটাডর। মেশিনের দুটো দাঁড়া সেই বিসর্জনে যাওয়ার পথে ঠায় আকাশে। সিনেমার পুরনো যন্ত্র ও প্রযুক্তির কি এ ভাবেই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটে? ভাল লেগেছে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে না-পেরে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়া পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেও। যে ভাবে নিজের জীবনের হেরে যাওয়া, স্বপ্ন সব বোঝাতে তিনি ‘সিনেমা’ বলে চিৎকার করে ওঠেন, সেটাই সিনেমা! যে ভাবে বন্ধ কমলিনী হলে আর দর্শক আসে না, কিন্তু অতিথি-অভ্যাগত কেউ এলে অরুণবাবু লবির পুরনো ঝাড়লন্ঠন জ্বালিয়ে দেন, সেটাই সিনেমা। কোনও সংজ্ঞা নয়, তত্ত্বকথা নয়, নায়ক-নায়িকার গ্ল্যামার নয়। পর্দায় আছড়ে পড়া সিনেমা আসলে জীবন। কিংবা তার চেয়েও বড় কিছু।

এই বড় কিছুকে ধরতে কৌশিক এক জায়গায় বাংলা সিনেমার চলতি ব্যাকরণ ভেঙে দিয়েছেন। পরাণ ও অরুণবাবু বন্ধ সিনেমাহলের বসে মদ খেতে খেতে গল্প করছেন, ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনও আবহ নেই। শুধু ‘নায়ক’ ছবির সংলাপ। এটাই সিনেমা!

খুব সূক্ষ্ম, সংবেদী ভঙ্গিতে আরও একটা জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছেন কৌশিক। হলমালিক পরাণ বা তাঁর পুত্র, চোরাই ডিভিডি-চালানো পরম কেউই হয়তো নন সিনেমাওয়ালা। আসল সিনেমাওয়ালা অরুণ গুহঠাকুরতা, অন্ধকার হলে বসে যিনি প্রোজেকশন চালান। প্রোজেক্টরকে এখনও ঝাড়পোছ করে সাজিয়েগুছিয়ে রাখেন। সে অন্যের কাছে চলে গেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

কৌশিকের প্রতি রাগ একটাই কারণে। জীবনের চেয়েও বড় এই সিনেমাকে ভ্রূণহত্যার মতো নষ্ট করলেন তিনি। সিঙ্গল স্ক্রিন হলের মৃত্যুতে শুরু হলেও পুরো ছবিটা শেষ অবধি পরিণত হল একটি পরিবারে বাবা-ছেলের দ্বৈরথের কাহিনিতে। কমলিনী বন্ধ হওয়ার পর ক’ জনের রুটিরুজি বন্ধ হল? কে আত্মহত্যা করল? কে-ই বা হকারিতে নামতে বাধ্য হল? এগুলি না জেনে বন্ধ কমলিনীদের কী ভাবে ট্রিবিউট দেব আমি? যে হলটা তিন-চার বছর আগেই মরে গেছে, সে হলের প্রোজেকশনিস্ট, মালিক সবাই ছোঁয়াচে রোগের মতো আত্মহত্যা করবে কেন?

পরম এক জায়গায় বাবাকে বলে, ‘আমি তোমাকে হলটাকে বাঁচাবার বুদ্ধি দিয়েছিলাম, তুমি নাওনি।’ কী ছিল সেই বুদ্ধি? আমরা আঁচ করতে পারি, পরম হয়তো হলে বক্স তৈরি করে কপোত-কপোতীদের বসানোর বুদ্ধি দিয়েছিল, নুন শোতে বাংলা ছবির দৃশ্যের মাঝে পাইরেটেড তামিল ছবির ভিডিও ক্লিপিংস গুঁজে দিতে বলেছিল। কিন্তু সিনেমাপ্রেমী পরাণ রাজি হননি।

মার্জিনের বাইরে-থাকা ভাষ্য দর্শক এ ভাবে কল্পনার চোখে পড়বে কেন? এই ছবির এক জায়গায় মাছের আড়ত থেকে বেরিয়ে পরাণ ও অরুণবাবু রিকশায় যাচ্ছেন, দু’ জনকে পাত্তা না দিয়ে পাশ দিয়ে পরমের মোটরবাইক বেরিয়ে যায়। এ যেন ‘জলসাঘর’-এর ছবি বিশ্বাস ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছেন, পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল গঙ্গাপদ বসুর মোটরগাড়ি। শেষ দৃশ্যে যেখানে পরাণ দরজা বন্ধ করে বিচ্ছিন্ন স্ত্রী অলকানন্দার (এই দম্পতি ডিভোর্সি না সেপারেটেড, সিনেমায় তা বলা হয়নি) ছবির সামনে দাঁড়ান, সেটাও আর এক জলসাঘর। মৃত্যুর আগে ছবি বিশ্বাস পূর্বপুরুষদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

কী হত জলসাঘর ছবির গঙ্গাপদ বসু যদি ছবি বিশ্বাসের পুত্র হতেন? এবং দুই যুগের দুই প্রজন্মই সিনেমার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন? এই কল্পনার সঙ্গে শেষ দৃশ্যে কয়েক ফোঁটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাররিয়াল ইমেজারি মিশিয়ে দেবেন। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট পাহাড়ি পথ, ন্যাড়া গাছ, মৃত অরুণ গুহঠাকুরতা হাতছানি দিয়ে পরাণকে ডাকছেন, ‘কর্তা আসুন’। যেটা পাবেন, সেটাই সিনেমাওয়ালা।

কৌশিকের ভ্রূণহত্যা এখানেই। যিনি ‘আরও একটি প্রেমের গল্প’ বা ‘শব্দ’ তৈরি করতে পারেন, তিনি কেন এ ভাবে পুরনো রূপকল্পে বন্দি থাকবেন? মাঠে তাঁবু ফেলে সিনেমা দেখানোর কয়েক জায়গায় কৌশিক নিজেই নিজেকে রিপিট করেছেন। মেলার মাঠ, টিনের দেওয়াল আর টিকিট কাউন্টারের পাশে ভিড়ের দৃশ্যে ‘ছোটদের ছবি’র কথা মনে পড়ে যায়। কেনই বা তাঁর ছবিতে থাকবে এত কথার পরে কথা? সংলাপ এবং সংলাপহীনতা দুই দিয়ে যিনি ম্যাজিক তৈরি করতে পারেন, সেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়কে কেন শুধু কয়েকটি দৃশ্যেই খুঁজে পাব? গোটা ছবিটায় নয়?

তাই মন ভরেনি। এই পরিচালক তথা জাদুকরের হাতে জাদুকাঠি, টুপি, খরগোশ সবই আছে বোঝা গেল। কিন্তু পুরো সিনেমাটা কবে যে দেখাবেন তিনি!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement