মধ্যমণি চিন, মমতার বাংলায় ‘অচিন’ ছবি

‘সোশ্যালিস্ট’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে ‘সোশ্যালিস্ট’ চিনের জন্য লাল কার্পেট। লাল, নাকি সাদা-নীল? রঙে কী আসে যায়! উন্মুক্ত চিন তো বিশ্বাস করে, বেড়ালের রঙ দেখো না। ইঁদুর মারলেই হল!

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৪০
Share:

আজ শুরু কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। প্রস্তুত নন্দন। বৃহস্পতিবার। — রণজিৎ নন্দী

‘সোশ্যালিস্ট’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে ‘সোশ্যালিস্ট’ চিনের জন্য লাল কার্পেট।

Advertisement

লাল, নাকি সাদা-নীল? রঙে কী আসে যায়! উন্মুক্ত চিন তো বিশ্বাস করে, বেড়ালের রঙ দেখো না। ইঁদুর মারলেই হল! এ রাজ্যের মসনদ থেকে বামেদের উৎখাত করা মমতাও কমিউনিস্টের লাল রং দিয়ে চিনকে বিচার করছেন না।

কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে তাই এই প্রথম বার ফোকাল কান্ট্রি চিন। বাম শাসনেও যা ঘটেনি, মমতার আমলে সেটা ঘটল? উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম ঘোষ হেসে বললেন, ‘‘এক অর্থে তাই বটে! এর আগে চিনা ছবি অনেক দেখানো হয়েছে। কিন্তু ফোকাল কান্ট্রি এই প্রথম।’’ একগোছা ছবি নিয়ে চিনের প্রতিনিধিদল আর ক’দিনের মধ্যেই শহরে এসে পড়বেন। শহরের চিনা কনস্যুলেট তাই নিয়ে বেশ উত্তেজিত। মমতার কমিউনিস্ট-বিরোধী রাজনীতির কথা মনে করাতেই কনসাল জেনারেল মা ঝাংউ বলে উঠলেন, ‘‘চিন কিন্তু নিজেকে সোশ্যালিস্ট বলে, কমিউনিস্ট নয়। তৃণমূল নেত্রীও তো সোশ্যালিস্ট!’’

Advertisement

মুহূর্তটা মোক্ষম। রাজনীতির অন্দরমহলে অনেকেই মনে করছেন, রাজ্য সরকার কার্যত এক ঢিলে দু’পাখি মারল। চিনকে ডেকে এনে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান এবং রাজ্যের বিকাশের প্রশ্নে যে রং দেখা হয় না, সেটা বোঝানো গেল। আবার একই সঙ্গে দেশ জুড়ে কট্টর জাতীয়তাবাদের যে ঢেউ উঠেছে, তার থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যও বজায় রাখা গেল। গত বছর যখন দেশের নানা প্রান্তে পাক গজল শিল্পী গুলাম আলির অনুষ্ঠান বাতিল করা হচ্ছিল, মমতা তখন কলকাতায় গুলামের অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন। এ বারেও চিনকে আমন্ত্রণ করে বুঝিয়ে দেওয়া গেল, চিন বয়কটের লাইন মমতার নয়।

পরিকল্পনাটা অবশ্য হঠাৎ নয়। চিনের সঙ্গে একটা মজবুত সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজটা বেশ কিছু দিন ধরেই শুরু হয়েছে। বস্তুত, গত বছর নরেন্দ্র মোদী নিজেই চিনে গিয়ে প্রক্রিয়াটার সূচনা করে এসেছিলেন। এবং সেখানে পূর্ব ভারতের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে কলকাতার গুরুত্ব অনেকটাই রয়েছে। সিকিমের মধ্য দিয়ে নাথু লা-র রাস্তা খুলেছে। নজর পড়েছে সিনেমাতেও।

পঞ্চাশের দশকে যে চিন রাজ কপূরে মজেছিল, ১৯৬২-র যুদ্ধের পরে সেই দ্বিপাক্ষিক সিনেমা চর্চায় অনেকটাই ভাটা পড়ে যায়। বর্তমানে চিন এবং ভারত, ফিল্ম বাণিজ্যের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম সারিতে থাকলেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ায়নি। গত বছরই মোদীর সফরে ঘোষণা হয়, ভারত-চিন যৌথ ভাবে তিনটি ছবি তৈরি করবে। তার প্রথমটি, ‘হিউ-এন-সাং’ এ বছর এপ্রিলে মুক্তি পেয়েছিল। এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবেও ছবিটি থাকছে। এ ছাড়া জুলাই মাসে নন্দনে চিনা ছবির একটি উৎসব আগেই হয়েছে। সেপ্টেম্বরে রাজ্যের তথ্য-সংস্কৃতি সচিব অত্রি ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে টলিউডের প্রতিনিধিদল চিন ঘুরেও এসেছে। চিনা কনসাল জেনারেল নিজেও বাংলা ছবি নিয়ে বেশ উৎসাহী। ক’দিন আগেই জুলফিকার দেখে এসেছেন। বললেন, ‘‘আসছে বছর বেজিং আর সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ কিছু বাংলা ছবি রাখা যায় কি না, তাই নিয়ে কথাবার্তা চলছে।’’

কিন্তু কূটনৈতিক স্তরে ভারত-চিন সম্পর্ক এই মুহূর্তে খুব ভাল জায়গায় রয়েছে কি? ঝাংউ মুখে অন্তত এমনটা মানতে চাইলেন না। বয়কট-হুমকিকেও গুরুত্ব দিতে চাইলেন না। কলকাতায় দিওয়ালির বাজার তাঁকে কোনও ভাবেই হতাশ করেনি, সে কথাও বললেন। সেই সঙ্গে বারবারই তাঁর মুখে শোনা গেল ভারতের সঙ্গে চিনের সুপ্রাচীন সম্পর্কের কথা। কলকাতার চিনা বাসিন্দাদের কথা। একই ভাবে গৌতমও বললেন, ‘‘কূটনীতির ওঠাপড়া থাকবেই। তার জন্য সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান বন্ধ হোক, এটা কাম্য নয়। মুখ্যমন্ত্রীও তা চান না।’’ ঝাংউ জানালেন, কলকাতা সংস্কৃতির রাজধানী। এখান থেকে ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য চিনে যাক, সেটা তাঁরা চাইছেন।

আর একটা জিনিসও চাইছেন ঝাংউ। বললেন, মমতাকে চিনে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। ঝাংউ-র দাবি, মমতা প্রাথমিক ভাবে মৌখিক সম্মতিও জানিয়েছেন।

সমাজবাদী চিনে সমাজবাদী মমতার জন্য দরজা খোলা। কার্পেটের রং লাল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement