দামিনী বসু। ছবি: সংগৃহীত
অভিনয়ে এলেন কেন?
হামাগুড়ি দিতে শিখেছি স্টেজেই। আমার বাবা অসিত বসু। মা ভদ্রা বসু। পলিটিক্যাল থিয়েটারে বড় হওয়া। বাবা বলতে গেলে উৎপল দত্তের ডান হাত ছিলেন। আমার বাবার শিক্ষাগুরু ছিলেন উৎপল দত্ত। আর মায়ের বাড়ি ছিল মধ্য কলকাতার আইপিটিআই অফিস। বুঝতেই পারছেন, আমি আক্ষরিক অর্থেই মঞ্চে বড় হয়েছি। অভিনয় ছাড়া আর কিছু ভাবিনি বা ভাবতে পারিনি কখনও।
ঋতুপর্ণ ঘোষ আপনার ফ্রেন্ড ফিলোজাফার গাইড?
ঋতুদা আমায় তৈরি করেছে। আমি ওর বাড়িতে থাকতাম। ঋতুদার চলে যাওয়া ২০১৩ থেকে ২০১৯ আমার বড় হওয়ার, ধাক্কা খাওয়ার সময়। তার মানে এই নয় আমার আগের জার্নিটা ‘আনরিয়্যাল’। কিন্তু সেটা ছিল আমার চেনা মঞ্চ। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে, বাবা-মায়ের থেকে সরে এসে ঊষা গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছি। এটা আমার কমফোর্ট জোনের মধ্যে নিজেকে মেলে ধরেছি। পরবর্তীকালে বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, বিক্রম আয়েঙ্গার, লালদাদা, সৃজিত— আমি এঁদের সঙ্গে মঞ্চে কাজ করেছি। অনেকের নাম হয়তো বলতে ভুলে যাচ্ছি।
এত লম্বা সময় ধরে এত গুণী মানুষের সঙ্গে কাজ করা, সেটা কি অসিত বসুর মেয়ে বলে?
হ্যাঁ, আমি অসিত বসুর মেয়ে আগেই বলেছি। এই মঞ্চ আমার চত্বর। তবে অসিতদা-ভদ্রাদির মেয়ে বলেই আমি সুযোগ পাইনি। আমি মনে করি আমি ‘ওয়েল ডিজার্ভিং ক্যান্ডিডেট’। তাই কাজ পেয়েছি। আর অসিত বসুর মেয়ে হলেই যদি সব হয়ে যেত তা হলে আমায় এত ঝড় সামলাতে হত না।
আরও পড়ুন: বাথটবে সুস্মিতা, ছবি দেখে কী বললেন রোহমান?
ঝড়?
ঋতুদার হাতটা ছেড়ে যাওয়া থেকে এই সময়টা, যখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি, আজ অবধি আমার ঝড়বাদলের সময়...আমার ফিনান্সিয়াল অবস্থা এমন হয়ে গিয়েছিল যে থাকার কোনও জায়গা ছিল না। আমার ডিভোর্স চলছে তখন। মেয়ের কাস্টডিটাও পাইনি ঠিকমতো। ভয়ঙ্কর সময়। আমি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি। ভাবুন, আগের দিন রাতে কথা হয়েছে ঋতুদার সঙ্গে। ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম ঋতুদার সঙ্গে থাকব বলে। দেখলাম, লোকটা নেই! মুখ থুবড়ে পড়লাম। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো। উফ! খুব শক্ত ছিল...
আরও পড়ুন: ‘কলঙ্ক’ ব্যর্থ কেন? কাকে দায়ী করলেন মাধুরী?
এর পর কি এরিক মরিসের সঙ্গে যোগাযোগ?
আজ আমি যা তা নিজেকে অর্জন করতে হয়েছে। এরিক মরিসের সঙ্গে আলাপ বেশ কিছু সময় পর। ওখানেই অভিনয় শেখার জন্য প্রচুর খেটেছি। রেগুলার যোগাযোগ রাখা। এরিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। ডিরেক্ট ট্রেনিং নেওয়া ওর কাছ থেকে। তারপর হলিউডে পৌঁছনো। ‘ক্লাস অ্যাক্ট’ আমার ওয়ার্কশপ তৈরি করা। মুম্বই, কলকাতা, বিদেশে অভিনেতাদের ট্রেন করা, গ্রুম করা— এটার মধ্যে দিয়ে আর একটা আমির জন্ম হয়েছে। আমরা বলি না ৩৬০ ডিগ্রি! এটা আমার ৩৬০ ডিগ্রি জার্নি।
কাদের ট্রেন করেছেন আপনি?
নাম খুব একটা বলতে চাই না। তাঁরা চাইবেন কি না জানি না।
কয়েক জনের নাম বলুন প্লিজ...
অঞ্জনা বসু এসছেন। হ্যাঁ, তুহিনা, বকুলকথার ঊষসী। রাহুল বসু। ঊষসী চক্রবর্তী। তনিকা বসু। সোহিনী সরকার। মিমি। নাইজেল। মুম্বইতে রোহান শাহ। পামেলা ভুতোরিয়া। আসলে একটা কথা বলি, যারা নতুন অভিনয় করছে তারা আমার ওয়ার্কশপ করেছে। আসলে নাম বলাটা বোকা বোকা লাগছে। ওদের কাজে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই। এই কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য নাম বলতে চাইনি আমি।
অভিনয়ের বিশ্ব দিগন্তে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তাও মনে হয় না, যশ, খ্যাতি দেরিতে এল? আপনাকে এত দিন পরে লোকে খুঁজছে?
না, দেরি বা তাড়াতাড়ি বলে কিছু হয় না। আমার খোঁজ নেওয়ার এটাই সময়। আগে আমার খোঁজ করলে হয়তো সে ভাবে আমি কিছু দিতে পারতাম না। আমার খোঁজ নেওয়ার এটাই সময়।
তাই বোধহয় বেশ কয়েকটা ছবিতে কাজ করলেন?
ইন্দ্রাশিসের ‘পার্সেল’ ছবিতে একটা চরিত্রে কাজ করলাম। বেশ ইন্টারেস্টিং। আর একটা ছবি করে খুব আরাম পেয়েছি। নতুন পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘আকাশ অংশত মেঘলা’। রাহুলের দিদির চরিত্র। আর একটা ছবি ‘দুধপিঠের গাছ’। একটা গ্রাম ক্রাউড ফান্ড করা। মায়ের চরিত্র করেছি। খুব ভাল লেগেছে। আড়ংহাটার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেছি। খুব শীত ছিল। এ ছাড়া আর কী করলাম?
কেন সুজিত সরকার?
হ্যাঁ। ওটা সবাই দেখেছে। সুজিত সরকারের সঙ্গে একটা অল ইন্ডিয়া ক্যাম্পেন করেছি। একশো কুড়ি মিলিয়ন ভিউ হয়েছে দেখলাম। আর রাজর্ষির ছবি আসছে ‘পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ উত্তর আসবেই’। ওখানেও একটা চরিত্র করেছি। আরও কাজ ছিল করার, কিন্তু সামারে আমি মরিসের সঙ্গে থাকতে চাই। মরিস ইন হিজ লেট এইট্টিজ। আমার শিক্ষক, চেষ্টা করি ওর থেকে শুষে নিতে। তাই সেপ্টেম্বরের আগে কিছু হবে না, তখন ফিরব আবার।
বিদেশেও নাকি কাজ করবেন?
কথা চলছে। ঠিক হোক সব আগে।
শোনা যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের আপনি বিশেষ বন্ধু। নানা ভাবে ওঁকে উৎসাহ দিয়েছেন এক সময়?
সৃজিতকে উৎসাহ দিতে হয় না। সেই কবেকার কথা। প্রথম থেকেই, যখন বেঙ্গালুরু থেকে এল, কলকাতায় নাটক করছে। নাটকের লোক দরকার। সেই সূত্রে তখন ২০০৯ থেকে আলাপ। তখন থেকেই গভীর বন্ধুত্ব। তখন থেকেই দেখেছি, ও নিজেই নিজেকে ইন্সপায়ার করতে জানে। সেল্ফ মোটিভেটেড। হ্যাঁ, অনেক সময় ওর ছবির রিসার্চে আমি হেল্প করেছি। আমরা আসলে না-পাওয়ার সময়ের বন্ধু। যখন কেউ কারও পাশে থাকে না। আমরা থেকেছি। আমরা রোজ ধিনতা ধিনা করে রোজ পার্টি করি তা-ও না। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গা থেকে গেছে। থাকবেও।
‘জ্যেষ্ঠপুত্র’ দেখার পর প্রথম ফোন তো আপনাকে সৃজিত করেছিলেন?
হ্যাঁ। প্রিমিয়ারে এত লোক, ভিড়। রাতে ও-ই প্রথম ফোনটা করে। এটাই আমাদের বন্ধুত্ব। এটাই আমাদের সম্পর্ক।
অভিনয়ের এই রকম ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে বাংলা ছবিকে কী মনে হয়?
আমি বাইরে থাকি। অন্য কাজ দেখি তো মনে হয় বাংলা ছবি খুব ধীরে বেবি স্টেপস্ এ অ্যাডাল্ট হচ্ছে। আমি খুব আশাবাদী। কালচার তো ইকলজিকাল প্রসেসের মধ্যে পড়ে না। অনেকে ভুল বলেন, ‘আমাদের কালচার প্রিজার্ভ করতে হবে’। দেখুন, কালচার কোনও অ্যামাজনের বনজঙ্গল নয় যে প্রিজার্ভ করতে হবে। কালচার ভাঙবে। পড়বে। জুড়বে। বাংলা ছবিও তাই। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখি এমন ছবি যা আগে মানুষ ভাবতে পারেনি সেটা নিয়ে কথা বলছে। এটাই তো অনেক!
নিজে কী কী কাজ করতে চান?
‘এত চাওয়া নিয়ে কোথায় যাই।’ সাঁকো নাড়িয়ে দিলেন কিন্তু। তবে ঋতুদা সাত-আট বছর আগে বলেছিল, তুই শেখাস না কেন? আগে ভাবতাম, আমার মতো ফোক্করবাজের থেকে কে শিখবে? ঋতুদা চলে যাওয়ার পর কথাটা খুব ভাবাত। ভাবলাম এত লেজেন্ডদের কাছে শিখেছি। যদি শেখানো না হোক, সেটা শেয়ার করি। এরিকের মেথডটা বিশ্বে এখন ছড়িয়ে দিই। অ্যাক্টরদের ট্রেন করি। ‘বিয়ন্ড মেথড’...এই নিয়ে আছি। আমার স্টুডিয়োতে শেখাচ্ছি।
আর পরিচালনা?
করব। এখনও এই অভিনয় শেখানো নিয়ে পূর্ণ হয়ে আছি। আমি পারফরম্যান্স করছি ২০১৫ থেকে। ‘প্রজেক্ট স্টিরিওটাইপ’ বলছি একে। অহিংসা নিয়ে কাজ করছি। আর হেলেন মিরনকে সামনে দেখতে চাই। অভিনয় করতে পারলে তো কথাই নেই। আর নাসা যেতে হবে আমায়। আমি ‘স্পেস অ্যাডিক্ট’। এটা করতেই হবে।
আর মেয়েকে একা মানুষ করেন কেমন করেন?
অনেক মানুষ বাচ্চাকে একা মানুষ করে। এটা কোনও সেলিং পয়েন্ট নয়। বলতে গেলে ও আমায় মানুষ করে!