প্রসেনজিৎ ও অর্পিতা। ফাইল চিত্র।
ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস তাঁর অভিজ্ঞতায় জড়িয়ে। সেই অভিজ্ঞতার সরণিতে চিরনবীন এক মানুষ বাঙালির ইতিহাস নিয়ে গল্প বলবেন। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর আগামী ছবি ‘মহালয়া’।
তাঁর ঘরের ছবি। সারা ছবি জুড়ে তিনি নেই। কিন্তু ‘মহালয়া’ আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এই মুহূর্তে মিলেমিশে একাকার।
‘‘পুরো ছবিটা জুড়ে আমার কণ্ঠস্বর। মুখ দেখা যায় না। আর ট্রেলারে সেই দৃশ্য দেখে মানুষ আমার ছবি হিসেবে ‘মহালয়া’ দেখছেন। এটা শুধুই আমার ছবি নয়,’’ কালো ছাপা ফিটেড ট্রাউজার আর কালো শার্টের প্রসেনজিৎ বিনত স্বরে বললেন। তাঁর প্রযোজনায় আগামী দিনে যে ছবি হবে তাতেও সব ছবি যে প্রসেনজিৎকে ঘিরে হবে এমন নয়।
‘মহালয়া’ ছবির শরীরে তাঁর কণ্ঠস্বর। এমার্জেন্সির কলকাতা।
আরও পড়ুন: ছবির কাজে ভাওয়াল রাজবাড়িতে অনুষ্কা
১৯৭৬ সাল। আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন, চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর বদলে উত্তমকুমারকে দিয়ে করাবেন। তাঁদের গোপন বৈঠকে বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
এই নতুন উদ্যোগ ঘুণাক্ষরেও টের পাননি বীরেনদা। পরিবর্তিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। ভদ্রলোক ছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান। নির্দিষ্ট দিনে রেডিয়োয় বাজল নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। তার পর?
মহালয়ার পুণ্য প্রভাত আলোকিত নাকি কলুষিত হল? এই ইতিহাস নিয়ে ছবি হয়নি আগে। কী বলছেন প্রসেনজিৎ?
আরও পড়ুন: ‘নগরকীর্তন’-এ তাঁর উপন্যাস নিয়েছেন কৌশিক, বলছেন স্বপ্নময়
‘‘অনেকে বলছিলেন ‘মহালয়া’, অথচ এই সময়ে ছবিটা কেন? আসলে, ইতিহাসের তো নির্দিষ্ট সময় হয় না। তা যে কোনও সময়ের। গল্প আর নস্টালজিয়ার বাঙালি এই ছবি দেখতে ফাল্গুনেও প্রেক্ষাগৃহে ভিড় করবেন বলে আমার বিশ্বাস।’’ আত্মবিশ্বাসী প্রসেনজিৎ, যাঁকে সামনে পেলেই ভিড় করে আসে অনেক প্রশ্ন।
ইন্ডাস্ট্রির নায়ক, অভিনেতা প্রযোজক হিসেবে বাংলা ছবির দর্শক আজ কী ছবি দেখতে চায়?
‘‘একটা উদাহরণ দিই। ‘বাধাই হো’ ছবিতে আয়ুষ্মান হিরো হলেও আসল হিরো তো ছবির বাবা-মা। ‘বেলাশেষে’-র হিরো কে? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। ‘ময়ূরাক্ষী’-র হিরো কে? আমি তো একা নায়ক নই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ছিলেন। ছবিতে নায়িকা তো ছিল না। আসলে গল্প মানুষকে নেটফ্লিক্স, অ্যাপ সব ছেড়ে হলে নিয়ে যাচ্ছে!’’
অভিজ্ঞতির ঝাঁপি খুলে যায়...এ বার প্রশ্ন আর উত্তর।
আজ কমার্শিয়াল সিনেমা মানে কী?
তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, অজয় কর, অসিত সেন এঁরা কমার্শিয়াল ছবি করতেন। আমি জানি না এঁদের ছবি এখন ক’জন দেখেন? এর পর অঞ্জন চৌধুরী এলেন। একটা নিজস্ব ধারা এল। কমার্শিয়াল ছবি এল। মারদাঙ্গা ছবি। এই ছবি কিন্তু চলতেই হবে।
কেন এই ধারার কমার্শিয়াল ছবি চলতেই হবে?
ইন্ডাস্ট্রিতে টাকা রোল করার একটা বিষয় আছে কিন্তু। আমি জানি, এক সময় কমার্শিয়াল ছবি থেকে টাকা তুলে তার পর প্রযোজকরা ভাবতেন এ বার একটা ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি করব। আমি ঋতুপর্ণকে দেখেছি স্বপনদা, হর— ওদের সঙ্গে আড্ডা মারতে। ও আড্ডা দিতে দিতে বলত, ‘‘আপনারা সুপারডুপার হিট ছবি করছেন বলেই আমরা ছবি করছি।’’ কি অনেস্ট স্বীকারোক্তি! এখন মানুষের কাছে প্রচুর অপশন, তাই তামিল বা অন্য ভাষার ছবি তারা বাংলা ভাষায় টিভিতে দেখে নিচ্ছেন। হলে গিয়ে দেখছেন না। কিন্তু এই ছবির বাজারও থাকতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মানুষ কোন ছবি হলে দেখছেন তা হলে?
সেই ইতিহাস ধরেই বলতে হয়, বাঙালিরা বলত, বই দেখতে যাচ্ছি। আজও সাহিত্যনির্ভর ছবির চাহিদা।এ ছাড়া মানুষ বাংলার ঐতিহ্যকে দেখতে চায়। পরিবারের গল্প চায়। যেখানে নিজেদের কানেক্ট করতে পারে। এই ধারায় দেখুন ‘হামি’র মতো ছবি হিট হয়। অন্য দিকে ‘প্রাক্তন’-এর মতো ছবি হিট হয়। আবার ইতিহাস খুঁজতে মানুষ ‘এক যে ছিল রাজা’ দেখে। এগুলো তো সব কমার্শিয়াল ছবি। আমার মনে হয়, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন যে সব ছবি তৈরি করেছেন সেগুলো আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখলে তো কমার্শিয়াল ছবিই। ইন্ডাস্ট্রিতে পর পর একসময় সৃজিতের ‘অটোগ্রাফ’, কৌশিকের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’, অনীকের ছবি, শিবুর ছবি এল। মানুষের ওই ‘কি পাচ্ছি না পাচ্ছি না’ ভাবটা কাটলো কিন্তু। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ বক্স অফিস সাফল্য তো পেয়েইছে। আবার প্রচন্ড প্রশংসা পেয়েছে। এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না। আজও গ্রামেগঞ্জে শো করতে গেলে আমাকে যেমন ‘অমরসঙ্গী’ গাইতেই হয়, তেমনই লালনের গানও গাইতে হয়। মানুষ কোথাও তো কানেক্ট করছে। এই ছবিগুলো সব আস্তে আস্তে কমার্শিয়াল ছবিতে পরিণত হয়েছে।
লড়াই নেই কোনও?
অবশ্যই আছে। এখানে সিঙ্গল স্ক্রিনকে বাঁচাতে হবে। আমার প্লাস পয়েন্ট, আমি প্রায় মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রি সঙ্গে নিয়ে বড় হয়েছি। ইন্ডাস্ট্রিও বেড়েছে, আমিও অনেক বদল দেখেছি। বদলের পথে এখন ভাল কনটেন্ট শেষ কথা।
‘উড়নচণ্ডী’ তো ভাল কনটেন্টের ছবি। সে ভাবে চলল না কেন?
ওই যে বললাম, সমস্যা আছে। আমরা মাল্টিপ্লেক্স নির্ভর। যেখানে শুধু বাংলা ছবি নয়, হিন্দি ছবিও রিলিজ হচ্ছে। ওদেরও দোষ দেওয়া যায় না। আমার ছবির ব্যবসা নির্দিষ্ট জায়গায় না পৌঁছলে ছবি নামাতেই হবে। তবে এখানে একটা কথা বলি, একটা লোক বলতে পারবে না প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ফোন করে বলেছে, ‘উড়নচণ্ডী’ ভাল ছবি, হলে থাক। অন্যের ছবির জন্য ঝগড়া করি আমি। বলি হলে রাখো। নিজের জন্য করি না। ভেবেছি নতুন ছেলেমেয়ে, হয়তো ধরে রাখতে পারেনি। তবে ভাল লাগে যখন বছরের সেরা ছবির তালিকায় ‘উড়নচণ্ডী’ থাকে। আসলে ঘণ্টাটা বাজিয়ে যেতে হবে। একটা কথা বলি, প্লিজ আপনারা ‘নগরকীর্তন’ দেখুন। এই ছবি হিট হলে বাংলা ছবি অন্য দিশা পাবে। অক্সিজেন পাবো আমরা। শুনুন, সিনেমা আসলে একটা আন্দোলন!
মানে?
আপনি যদি জানতে চান, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, আপনি সকাল থেকে রাত কী করেন? আমি বলব আন্দোলন করি। মানে সিনেমা দিয়ে রায়ট লাগিয়ে দেওয়া, প্রতিবাদের ভাষা, এটা আমি মানি না। এটা বিনোদন। তবে সিনেমার ভাষাটা আন্দোলন। রোজ নতুন কিছু তৈরি করি আমরা। ব্লক আসে। আবার ভাঙি। চলি।
রাজনৈতিক ছবি হবে না তা হলে?
সিনেমার স্বাধীনতা থাকবে। আছে। কিন্তু সেই স্বাধীনতার অন্য অর্থ যদি বেরোয়...সেটা তো সিনেমাকেই অ্যাফেক্ট করছে! মৃণাল সেন একাত্তর করেছেন তো! তফাত তখন হয় যখন আমি কোনও কিছু ছবির মধ্য দিয়ে এন্ডরস করছি। পলিটিকাল ছবি করলে ঘোষণা কর, এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক ছবি।
প্রসঙ্গ বদলাই। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় কবে ‘গানের ওপারে’ করবেন?
‘গানের ওপারে’ কালকে বললে কালকেই করব। আমি আর ঋতুপর্ণ এমন কাজ করে গেছি যা আগামী পঁচিশ বছর পরেও মানুষের মনে থাকবে।
অর্পিতার সঙ্গে মনে রাখার মতো কাজ হচ্ছে না কেন?
দেখুন, আমার ছবিতে এখন নায়িকা থাকে না। চরিত্র থাকে। ওকে শুধু চরিত্রে ফেলে দিলেই হল না তো! সেটা ছবিটাকে এফেক্ট করবে। ধরুন, জাস্ট এক জন সাংবাদিকের চরিত্র, সেটা তো অর্পিতার জন্য নয়। এটা বুঝতে হবে। অমিতাভ বচ্চন জয়া বচ্চনের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে।
সামনে নির্বাচন আসছে। আপনার নাম থাকবে তালিকায়?
পাগল! রাজনীতির কিচ্ছু বুঝি না আমি। আর এখনও তো প্রচুর কাজ বাকি। রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবি, কী করলাম! জীবনে একটা ‘জলসাঘর’ করতে পারলাম না। আগে কাজ তো করি। ওটা করতে করতেই জীবন ফুরিয়ে যাবে...
কাজের জন্য ব্যক্তিজীবন নষ্ট হয়েছে?
ছেলে বড় হয়ে গেছে। বিয়ে হল প্রায় পনেরো বছর। এখন তো আর সেই আগের মতো দু’জনে দু’জনকে চোখে চোখে রাখা যায় না। ওরও হয় না, আমারও হয় না। সব দাম্পত্যেই তাই। তবে আমি রেসপনসিবল। ছেলেকে নিয়েই আমাদের সব ভাবনা ঘিরে থাকে এখন।
উঠে পড়লেন নায়ক প্রসেনজিৎ। সিনেমা তাঁর জিম করা পেটানো শরীর ঘিরে। সিনেমার জন্য জমা রেখেছেন তাঁর সমস্ত আবেগ। প্রসেনজিৎ নয়। কখনও উজান মুখোপাধ্যায়, কখনও বা আর্যনীল, কখনও মহেন্দ্র হয়ে থেকে যেতে চান।