Celebrity Interview

লোকে বলে আমায় নাকি ঠিক ‘মুসলমান-মুসলমান’ মনে হয় না: মীর

রেডিয়ো ছাড়া থেকে ‘গপ্পো মীরের ঠেক’ এবং রাজনীতিতে ডাক না পাওয়া নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের সামনে মীর।

Advertisement

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:১১
Share:

মীর আফসর আলি। ছবি: সংগৃহীত।

ইদের দিনে মীরের বাড়িতে আনন্দবাজার অনলাইন। আনওয়ার শাহ রোডের ওই বাড়ির চারপাশে তখন উৎসবের আমেজ। আড্ডায় এসে মিশছে বাইরে থেকে ভেসে আসা সলমন বা শাহরুখের ছবির গানের সুর। মীরের মায়ের হাতে তৈরি সেমাইয়ের পায়েস খেতে খেতে শুরু হল আড্ডা।

Advertisement

প্রশ্ন: মীর ধর্ম মানেন?

মীর: ধর্ম মানেই মন্দিরে গিয়েই পুজো করতে হবে বা মসজিদে গিয়েই নমাজ পড়তে হবে, এমনটা আমি মানি না। আমি প্রকৃতির মাঝে গিয়েও মানসিক ভাবে অন্য জায়গায় পৌঁছে যেতে পারি। মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবের পিছনে বসে যখন নমাজ পড়ি, সেই সময় মুখে কোরান থেকে কী বলছি, তার চেয়ে বেশি জরুরি মনে হয় এত ভাইয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, সময় বার করে ‘সাজদা’ করছেন— এই গোটা দৃশ্য দেখতে পাওয়া। এটা দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। এটাই আমার অধ্যাত্মবাদ। অনেকে আমায় বলেন যে, আমাকে নাকি ‘মুসলমান-মুসলমান’ মনে হয় না।

Advertisement

প্রশ্ন: সেটা আবার কী?

মীর: সে রকম ভাবে আমি নমাজ পড়ি না। নিয়মিত মসজিদে যাই না। আমার মনে আছে একটা ঘটনা। আমাদের বাড়িতে ডোকরার দুর্গাপ্রতিমা আছে, সেটা কোনও কারণে ভিডিয়োর মাধ্যমে অনুরাগীদের নজরে আসে। ব্যস! ট্রোলিং শুরু। মুসলমানের বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমা কেন থাকবে? মানুষ সব ক্ষেত্রেই কথা বলবে। এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যেই শান্তি। এ সব দেখা এখন ছেড়ে দিয়েছি।

প্রশ্ন: আর কী ছাড়লেন?

মীর: রেডিয়ো ছেড়ে দিলাম।

প্রশ্ন: কেন? হাজার হোক স্থায়ী চাকরি

মীর: রেডিয়োতে পরিবর্তন। কোথাও মনে হচ্ছিল, একই পঞ্জাবি গান ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাজছে। বাংলা গান বাজবে না। ভিডিয়ো আর রিল করতে করতেও আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। বিষয়টা এমন নয় যে, আমি নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে চাই না। আমি সারা ক্ষণ নতুন কিছুকেই গ্রহণ করে চলেছি। বাড়িতে একুশ বছরের মেয়ে আছে। সে বলে দেয়, কী করব, কী করব না। কিন্তু ভাবনার দিক থেকেই সমস্যা হল। দু’দিকেরই মন্তব্য আছে। যাঁরা গানবাজনা করেন তাঁরা বলেন, রেডিয়ো গান বাজাতে চাইছে না। আর যাঁরা রেডিয়োর দেখভালের দায়িত্বে, তাঁরা বলেন, তেমন গানই তৈরি হচ্ছে না। এ সবের মধ্যে আমার নিজস্ব মান-অভিমান তৈরি হল। খারাপ লাগল। ছেড়ে দিলাম।

প্রশ্ন: কান্না পেয়েছিল?

মীর: রেডিয়ো যে দিন ছাড়লাম, খুব কান্না পেয়েছিল। বুঝেছিলাম, এটা আমার সিদ্ধান্ত। তার পরিণামের যে অভিঘাত বা চাবুক, তা সবচেয়ে বেশি নিজেকে আঘাত দেবে। সহ্য করতে হবে। কেউ কিছু করতে পারে না। কাঁধে কাঁধ রেখে লোকে ‘আছি’ বললেও, আঘাত শুধু আমার।

প্রশ্ন: কান্না সামলেছেন কেমন করে?

মীর: চাকরি ছাড়ার পরের ছ’মাস ভয়ঙ্কর ছিল। এক দিন খেয়াল করলাম, মোবাইলে শুধু রিল দেখে যাচ্ছি দীর্ঘ সময় ধরে! মনে হল, কী করছি এ সব? ছ’মাস পরে নিজেই নিজেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম জলে। একা সাঁতার কাটতে হবে।

প্রশ্ন: পরিবারের সাহায্য ছিল নিশ্চয়ই...

মীর: পরিবার না থাকলে হত না। প্রত্যেক দিন যদি ভাবতে বসতাম, মাস গেলে সংসারে কত টাকা দিলে সংসার চলবে, আগে কী রোজগার করেছি, এখন কী রোজগার হচ্ছে… তা হলে কাজ করতে পারতাম না। মুশকিল হত।

প্রশ্ন: তার পর?

মীর: নিজেকে খুঁজলাম। মানুষ কী ভাবে আমায় দেখেছে? এক জন সংবাদপাঠক। রেডিয়োর মানুষ। ১০টা সিজ়ন ধরে চলা কমেডি শোয়ের সঞ্চালক। বুঝলাম, মানুষ আমায় গল্পকার হিসেবেই পেতে চাইবে।

প্রশ্ন: মীর নিজেই ব্র্যান্ড। তাই কি এই গল্প বলার সিদ্ধান্ত?

মীর: একেবারেই নয়। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি যখন ‘গপ্পো মীরের ঠেক’ অনলাইনে শুরু করলাম… ভাবিনি তো ১০ লক্ষ হবে! আরও বলতে চাই। এখন ‘গপ্পো মীরের ঠেক’-এ শ্রোতার সংখ্যা ১০ লক্ষ হলেও আমি সেটা একেবারেই ভাবছি না। আমি জানি, আবার শূন্য থেকে আমায় শুরু করতে হবে। যদি ভাবি, ‘বাহ্‌! ১০ লক্ষ হয়ে গেল!’ তা হলে আর এগোতে পারব না। আমায় কিন্তু প্রত্যেক শনিবার রাতে একটা গল্প শ্রোতাদের শোনাতেই হবে। নতুন বছর আসছে।

প্রশ্ন: বাংলা গান, ভাষা এ সবের তেমন গুরুত্ব নেই। মানেন?

মীর: না, মানি না। আমার ভয় ছিল, মানুষ বাংলা ভাষায় গল্প শুনবে তো? আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষায় লিখলে বাংলা বলা আরও উন্নত হয়। সেটা এখন নেই। মানুষ বাংলা লিখতে চায় না। শুনতে কিন্তু ভালবাসে। মানুষ এক ঘণ্টার বেশিই গল্প শুনতে চাইছেন। বাঙালি বাড়িতে যে অডিয়ো নাটক শোনার রীতি ছিল, তা আজও বহমান। তবে, প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বাংলা ভাষা চর্চা নিয়ে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে আগ্রহই তৈরি করতে পারছি না আমরা। তা হলে আর পয়লা বৈশাখ বা দুর্গাপুজো নিয়ে আদিখ্যেতা করে কী লাভ?

প্রশ্ন: চাইলে আপনি অনেক ধরনের কাজ করতে পারেন।

মীর: হ্যাঁ। যখন সময় ছিল, অনেক কাজ করেছি। কিন্তু পরবর্তী কালে দেখছি, মানুষ ওই কাজের নিরিখেই আমাকে চিনে রাখেন। একটা কমেডি শো করেছিলাম দীর্ঘ দিন ধরে। সেই সঞ্চালকের বাইরে অধিকাংশ লোক আমায় ভাবতেই পারছে না! হাত থেকে সেই মাছের গন্ধ এখনও গেল না। যা-ই করি না কেন, লোকে ওই কমেডি শোয়ের সঞ্চালক ভাবে। ওই কাজই করতে বলে। কিন্তু, আমি করতে চাই না। আত্মাভিমান সবচেয়ে বড় বিষয়। তা খুইয়ে কাজ পেতেই চাই না। আমি যা করছি, তাতে সন্তুষ্ট। ছোটাছুটি ভাল লাগে না। আমি নিজেকে নিয়ে বেশ আছি।

প্রশ্ন: কিন্তু আফসার আলি কোথায় গেল?

মীর: আমার নাম তো আফসার আলি। মীর বাড়ির নাম।

প্রশ্ন: দুজন কি আলাদা?

মীর: আফসার আলি মুর্শিদাবাদের মাহিনগরের বাসিন্দা। তার আমবাগান আছে। খিড়কি পুকুর আছে। মৌচাকে ঢিল মারা রয়েছে। মীর এই মুহূর্তে যেমন দেখছেন তেমন। আমার পরিবার নিয়ে খুব বেশি বলি না। মা তো জানেই না, ঠিক কী কী করি আমি। ওই টেলিভিশনে দেখত যখন, তখন কিছুটা বুঝত। এখন বললাম, ‘গপ্পো মীরের ঠেক-এর ১০ লক্ষ অনুরাগী হয়েছে।” তা শুনে বলল, “আমায় রুটি এনে দে।”
প্রশ্ন: টেলিভিশনের মুখ এখন রাজনীতিতে, ভোটে দাঁড়াবার প্রস্তাব পেয়েছেন?

মীর: না। আমায় কেউ বলেনি, জানেন। আমি কিন্তু খুব চাই, কেউ প্রস্তাব দিক।

প্রশ্ন: আপনি ভাল প্রশ্ন করতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করতে হলে কী বলতেন?

মীর: আমি জানতে চাইব, ‘‘মুড়ির সঙ্গে যে চানাচুর খান, তাতে বাদাম আছে কি? বাদামের খোসা আছে কি? নেই?’’ খুব সাধারণ প্রশ্ন করব।

প্রশ্ন: আপনি দুষ্টু ছেলে। মোদী হলে কী প্রশ্ন করবেন?

মীর: ‘বাদাম’ থেকে ‘বা’ বাদ দিয়ে দেব, শুধু দামের কথা জানতে চাইব। এটার কেন এত দাম? এই সব…। তবে, দিদিকে খুব ভাল লাগে। আমার এক কমেডি শোয়ে মদন মিত্রের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, ওই অনুষ্ঠানে যাতে দিদি আসেন। আমার মনে হয়, দিদি আমায় পছন্দ করেন না।

প্রশ্ন: কপিল শর্মাকে কেমন লাগে?

মীর: ভাল লাগে। তবে কপিলের শো কপিলের জন্য ক’জন দেখে আর সুনীল গ্রোভারের জন্য ক’জন দেখে, এই প্রশ্ন রাখলাম। তবে এই শোয়ে ঘিওয়ালা পরোটা আর রাজমা চাওলের গন্ধ বড় বেশি। অন্য প্রদেশের হাস্যরসকেও প্রকাশ্যে আনা উচিত।

প্রশ্ন: কার সঞ্চালনা পছন্দ?

মীর: শাহরুখ খান। বাংলায় পরম আর যিশুর সঞ্চালনা ভাল লাগে।

প্রশ্ন: ভয় পান কাউকে?

মীর: আমার ইগোকে। ওটা বুকপকেটে রাখি। বাইরে এলে নিজেকে ছোট মনে করব।

প্রশ্ন: সেই মীর যিনি একদা ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হয়েছিলেন! আজ যদি আবার সেই পরিস্থিতির সামনে আসেন, কী পরিবর্তন নিজের মধ্যে দেখবেন?

মীর: তখন আমার কোনও ইগো ছিল না। কান লাল হয়ে গিয়েছিল, ও রকম বকা তো আগে খাইনি! তবে ঋতুদাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, যা বলেছি মজার ছলে। ঋতুদা আঘাত পেয়েছিলেন। ওঁর সঙ্গে কোনও লড়াই তো ছিল না! কিন্তু তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আমি এ ভাবেই ওঁকে দেখতাম। কিন্তু ওই দিন কী যেন হল, আর ক্যামেরাও রোল করল! আজও এই নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করেন। আগে অস্বস্তি হত। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মানসিক ভারসাম্য অনায়াসে চলে আসে।

প্রশ্ন: এই প্রসঙ্গে আর এক গুঞ্জন সম্পর্কে জানতে চাই। স্বস্তিকা আর মীরের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা বলা হত

মীর: স্বস্তিকা আর আমার বহু দিনের বন্ধুত্ব। যা-ই হয়ে যাক, আমরা বন্ধু আছি, থাকবও। আরে এক ইন্ডাস্ট্রিতেই তো কাজ করি! কিন্তু এই স্বাভাবিক সম্পর্ক নিয়ে লোকজনের প্রচুর মাথাব্যথা হয়ে গেল। আমার পরিবার আছে। ওরও আছে। এই নিয়ে আমরা একটাও কথা বলিনি। কারণ, কিছু বললেও সেটা বোঝার মানসিকতা মানুষের নেই। লোকজন অন্য মানুষের সম্পর্ককে যে ভাবে চাটনির মতো ব্যবহার করে, তাতে কথা না বলাই ভাল।

প্রশ্ন: কাদের সঙ্গে কথা বলতে চান?

মীর: বৃদ্ধাশ্রমের মানুষকে গিয়ে গল্প শোনাব। দৃষ্টিহীন বাচ্চাদের গল্প শোনাব। মানুষ বড্ড একা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement