মান্নাদা বললেন, ‘দ্যাখো কবিতা, লতা যতই তোমাকে ডাকুক, আমার মনে হয় ওর বাড়িতে তোমার যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি যেও না।’
ঘটনাটা এ রকম। তখন কবিতা কৃষ্ণমূর্তির পর পর সব গান হিট। সবাই বলছে দুর্দান্ত সিঙ্গার, গানের মধ্যে একটা শিক্ষার ছাপও আছে। সঙ্গীত পরিচালকদের খুবই পছন্দের গায়িকা হয়ে উঠেছে কবিতা। তখন লতাজিও গাইছেন। এমন সময় একদিন কবিতার কাছে লতাজির ফোন এল, ‘‘একদিন বাড়িতে চলে এস।’’ মান্নাদা ছিলেন কবিতার যথার্থ গুরু। গানেও যেমন, ব্যক্তিগত জীবনে বাবার মতো। সব ব্যাপারে কবিতা মান্নাদার পরামর্শ নিত। এ ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটল না। মান্নাদা তো অভিজ্ঞতার অনেক সিঁড়ি পার হয়ে এসেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই কবিতাকে বারণ করলেন তখনই লতাজির বাড়ি যেতে। বারণ করার যুক্তিও ব্যাখ্যা করলেন কবিতার কাছে—‘‘তুমি দারুণ গাইছ, ভাল কাজ করছ, গান হিট হচ্ছে, তোমার কি ধারণা লতা তোমাকে শুধু প্রশংসা করার জন্যই ডাকছে? এমনও তো হতে পারে, তুমি গেলে, আর এমন কিছু শুনলে যে তোমার মনটাই ভেঙে গেল। গান গাওয়ার ইচ্ছেটাই তোমার রইল না।’’
মান্নাদার এ এক অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট। মানুষের দুটো সত্তাকে তিনি সহজেই আলাদা করে নিতে পারতেন। গায়িকা হিসেবে লতাজিকে তিনি ঈশ্বরের কাছাকাছি রাখতেন। সব সময় বলতেন, ‘‘ওর মতো গ্রেট সিঙ্গার আর কেউ নেই।’’ এ বিষয়ে সবিস্তারে আগে লিখেছি। মান্নাদার কাছে গায়িকা লতাজি এবং মানুষ লতাজি— একেবারে আলাদা দু’টি ব্যক্তিত্ব ছিল। অবাক হয়ে বলতেন—‘‘আশ্চর্য হয়ে যাই, একই মানুষের আলাদা দুটো রূপ হয় কী করে?’’ যদিও ব্যক্তিগত ভাবে মান্নাদার সঙ্গে লতাজির এবং তার পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু প্রফেশনাল ক্ষেত্রে লতাজির ভূমিকা মান্নাদা খুবই অপছন্দ করতেন। দেখে-শুনে মান্নাদা খুবই দুঃখ পেতেন। দুঃখ পেতেন আরও অনেকে। এমনও হল একবার মান্নাদা এবং গীতিকার পুলকবাবু এমন দুঃখ পেলেন লতাজির কাছ থেকে, সেই দুঃখ নিয়ে পুলকবাবু আস্ত একখানা গানই লিখে ফেললেন। আর নিজের সুরে সে গান গাইলেন মান্নাদা—‘তোমার নিঃশ্বাসে বিষ ছিল, আমি বিশ্বাস করিনি।’
একবার মান্নাদা আর লতাজির বিদেশে অনুষ্ঠান। অভিজাত হল। হলের বাইরে সেই অনুষ্ঠানের বিশাল পোস্টার। মান্নাদা তখন খ্যাতির মধ্য গগনে। তাঁর নামে সকলের মাথা নুয়ে আসে। মান্নাদা অবাক হয়ে দেখলেন সেই পোস্টারে বিরাট করে জ্বল জ্বল করছে একটাই নাম—লতা মঙ্গেশকর। সে সময় একজন আয়োজককে দেখতে পেয়ে মান্নাদা জিজ্ঞেস করলেন—‘‘আজকের অনুষ্ঠানের শিল্পী কারা?’’ তিনি সহাস্যে বললেন, ‘‘কেন, আপনি আর লতাজি।’’ মান্নাদা আরও একবার পোস্টারটার দিকে তাকালেন। ভাল ভাবে লক্ষ করে দেখলেন ওই বিশাল ‘লতা মঙ্গেশকর’ নামের নীচে অতি ক্ষুদ্র অক্ষরে লেখা আছে ‘মান্না দে’। মান্নাদার থমথমে মুখ দেখে সেই ভদ্রলোক খুব বিব্রত ভাবে বললেন, ‘‘খুব ভুল হয়ে গেছে স্যার, কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না।’’ যা বোঝার মান্নাদা তা বুঝে নিলেন। বহু দিন পরে এই ঘটনাটা বলতে বলতে মান্নাদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন— ‘‘ও তো আগে থেকেই খ্যাতির চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। ওর ধারে-কাছে কেউ ছিলও না, থাকবেও না। তবু কি যেন একটা ইনসিকিউরিটিতে ভুগত। এমন অনেক কাজ করত আমার একদম ভাল লাগত না।’’
এ প্রসঙ্গে মান্নাদার কাছে শোনা আরেকটা ঘটনার কথা বলি। আশা ভোঁসলে মান্নাদার কাছে এলেন রাহুল দেববর্মনের সঙ্গে তাঁর বিয়ের ব্যাপারে পরামর্শ চাইতে। মান্নাদা জিজ্ঞাসা করলেন— ‘‘লতাকে বলেছ?’’ আশাজি কী উত্তর দিয়েছিলেন জানেন? খুব ঝাঁঝিয়ে উঠে আশাজি বললেন, ‘‘আমার বিয়ের ব্যাপারে ওই ডাইনিকে কিছু বলব না।’’
গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও এমন দুটো সত্তা আবিষ্কার করেছিলেন মান্নাদা। গীতিকার হিসেবে মান্নাদা পুলকবাবুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার আসনে রাখতেন। হঠাৎ করে পুলকবাবু ও ভাবে চলে যাওয়াতে মান্নাদা খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। সব সময় বলতেন—‘‘পুলক তো চলে গেল। আমাকেও শেষ করে দিয়ে গেল। আমার জন্য এমন সুন্দর গান আর কে লিখবে, আমাকে ও দারুণ বুঝত।’’ যথাযথ ভাবে শ্রদ্ধাও জানিয়েছিলেন তরুণ সিংহের লেখা শ্রদ্ধার্ঘে সুর করে এবং গেয়ে— ‘পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছে বন্ধু আমার।’
কিন্তু মানুষ পুলকবাবু সম্পর্কে মান্নাদার ধারণাটা একেবারেই অন্য রকম ছিল। বারাসতের জহর মজুমদারের লেখা একটা গান মান্নাদার খুবই পছন্দ হল। মনস্থির করলেন, অত সুন্দর কথা, নিজের সুরে গাইবেন সে গান। প্রবল ভাবে বাধা দিলেন পুলকবাবু। যত রকম ভাবে সম্ভব বাধা দিতে লাগলেন যাতে মান্নাদা সে গান না করেন। এমনকী গানের কথা বিকৃত করে বলতে লাগলেন— ‘‘এই সব কথায় গান করলে আপনার দুর্নাম হয়ে যাবে মান্নাদা। কী সব কথা— কেউ খায়, কেউ খায় না, কারও ঘুম পায়, কারও ঘুম পায় না।’’ কিন্তু মান্নাদা অনড়। আগেও লিখেছি গানের কথা পছন্দ হলে সে গান মান্নাদা গাইবেনই, কেউ তাঁকে আটকাতে পারবে না। পুলকবাবুর কথায় মান্নাদা যদি কর্ণপাত করতেন, তবে আমরা পেতাম না সেই অবিস্মরণীয় গান— ‘সবাই তো সুখী হতে চায়, তবু কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না।’
মানুষ গৌরীপ্রসন্নর ব্যাপারে মান্নাদা কিন্তু দরাজ সার্টিফিকেট দিতেন। পুলকবাবু যখন লিখলেন—‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে, নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে,’ গৌরীপ্রসন্ন পঞ্চমুখে প্রশংসা করেছিলেন সেই গানের মান্নাদার কাছে—‘‘এমন গান পুলকবাবুই লিখতে পারেন।’’ মান্নাদা বলতেন— ‘‘গৌরীর কোনও সংকীর্ণতা ছিল না। কারও লেখা ভাল লাগলে মুক্ত কণ্ঠে বলত। কিন্তু পুলক ছিল একদম উল্টো। অন্য কাউকে সহ্যই করতে পারত না। সব সময় চাইত ও ছাড়া আমি যেন অন্য কারও গান গাইতে না পারি।’’ একবার মান্নাদা খুব দুঃখের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘এমনিতেই পুলকের এত নাম ছিল, অথচ নামের জন্য কি কাঙালপানা করত। আমারই লজ্জা লাগত।’’
বয়সে অনেক ছোট হলেও মান্নাদা খুব শ্রদ্ধা করতেন বলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে ডাকতেন ‘সন্ধ্যাদি’ বলে। সন্ধ্যাদি কেন মুম্বইতে কেরিয়ার তৈরি করতে পারলেন না, একদিন এই প্রসঙ্গে আলোচনা চলছিল। মান্নাদা বললেন— ‘‘সমস্যাটা কি জানেন, অনেকে সিম্পলিফাই করে বলেন, মান্না দাদা নেই বলে ও দাঁড়াতে পারল না। এটা একেবারেই ঠিক নয়। একটু লক্ষ করে দেখবেন যাদের স্ট্রং ব্যাকিং আছে, তারাই দাঁড়াতে পারেনি। যাঁরা নাম করেছেন, বলতে গেলে তাদের পিছনে প্রথমে কেউই ছিল না। হিরো-হিরোইনদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমনই। বলুন না আমাদের কোন ফুটিংস ছিল? হ্যাঁ, আমার মনে হয় সন্ধ্যাদির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্য রকম। খুবই বড় সিঙ্গার। কিন্তু মুম্বইতে হিরোইনদের লিপে প্লে-ব্যাকের জন্য যে নর্ম্যাল, ন্যাচারাল, অ্যাক্টিং সিঙ্গিং দরকার, সেটা সন্ধ্যাদির ছিল না। সন্ধ্যাদির গায়িকার মধ্যে একটা আর্টিফিসিয়াল অ্যাপ্রোচ আছে, যেটা ঠিক মুম্বইতে চলে না।’’