Anathbandhu Ghosh

ঘর ছেড়ে রাঙা মাটির পথে বহু বছর, অজয়ের বাঁকে সেই অনাথবন্ধুর সঙ্গে দেখা

বাউল জানালেন, ঘর বাঁধার প্রস্তাব যে আসেনি, তা নয়। কিন্তু সখীদের কুসুমকোমল হৃদয় তাঁরই অনাদরে ঝরে গিয়েছে। তিনি নিজের কঠিন জীবনের সঙ্গে আর কারও জীবন জড়াতে চাননি। বলেছেন, ‘‘আমি আলেয়া। আলেয়াকে আলো হিসেবে নিয়ো না।’’

Advertisement

অর্পিতা রায়চৌধুরী

দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ১৩:৩০
Share:

আখড়ায় সুরে মগ্ন অনাথবন্ধু ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

চোখের বাতি নেভানোর পরেও মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল দুরারোগ্য ব্যাধি। যদি আঁতুড়েই মাতৃহীন শিশুর খেলাও থামিয়ে দেওয়া যায় ছ’ মাস বয়সে। কিন্তু এ বার হার মানতে হল অসুখকে। খাঁচার ভিতর অচিনপাখি রয়ে গেল ধুলোখেলার জন্য। সে অসম্ভব নাকি সম্ভব হয়েছিল কপালে মায়ের এঁকে দেওয়া রাজতিলকের জন্য। এক মুখ হেসে বললেন অনাথবন্ধু ঘোষ। পৌষের রোদের মতোই অমলিন তাঁর হাসি। স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘মা বোধহয় টের পেয়েছিলেন একমাত্র সন্তানের সঙ্গে একদিন-ই সময় কাটাতে পারবেন। তাই দিকশূন্যপুরে চলে যাওয়ার আগে সদ্যোজাত ছেলের কপালে রাজতিলক এঁকে যান। ওর জোরেই তো সারাজীবন রইলাম রাজার হালেই। ভিখিরি হতে চেয়েও পারলাম কই!’’

Advertisement

ঐশ্বর্যের ভাঁড়ার ছিল বাড়িতেই। মাতৃস্নেহ না পেলেও আদরের অভাব হয়নি বিমাতার কোলে। ছিলেন যৌথ পরিবারের বাকিরাও। তবুও বাড়িতে থাকতে ভাল লাগত না। চোখের আলোয় চোখের বাইরে দেখার জন্য তাঁকে হাতছানি দিত চৌকাঠের ওপার।

সেই চৌকাঠ ছিল বীরভূমের জয়দেব থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে বিল্বমঙ্গল গ্রামে। আজও আছে। কিন্তু জন্মস্থানের পরিবর্তে গীতগোবিন্দের পদে বরাবর নিজের শিকড় খুঁজে পান জন্ম-বাউল অনাথবন্ধু। সন্ধান-পর্ব শুরু হয়েছিল শৈশবেই। যখন ভাইবোনদের সঙ্গে পা রেখেছিলেন গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে। সব থেকে ভাল লাগত মাস্টারমশাইদের মুখে ইতিহাসের গল্প শুনতে। উত্তর দেওয়ার সময় সবার আগে উপরে উঠত তাঁর হাত। কিন্তু সে হাত নামিয়ে নিতে হল প্রাথমিকের পাঠ শেষ হতেই। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে সে সময় দৃষ্টিপ্রদীপ ছাড়া শিক্ষার অলিন্দে বেশি দূর এগোনো যেত না। তাই অনাথবন্ধুর নিজের কথায়, তিনি থেকে গেলেন ‘নিরক্ষর শিক্ষিত’ হয়ে।

Advertisement

বাদ্যযন্ত্রেও তাঁর অনায়াস গতি। নিজস্ব চিত্র।

তাঁর নিকষ দুনিয়ায় সাদা-কালো অক্ষরের বদলে আলো প্রবেশ করেছিল সঙ্গীতের আলপথে। মাতৃহীন শিশুর একমাত্র সঙ্গী ছিল আকাশবাণী। শীতের রাতে রেডিয়ো সেটকে লেপমুড়ি দিয়ে রাখতেন তিনি। যাতে তার ঠান্ডা না লেগে যায়! নিশুত রাতে, সারা গ্রাম যখন ঘুমের দেশে, বালক অনাথবন্ধু পাড়ি দিতেন সুরলোকে। বিমলভূষণ এবং সুপ্রভা সরকারের নজরুলগীতির সঙ্গে। অনেক পরে, এক অনুষ্ঠানে, সে দিনের বালক তখন নামী গাইয়ে, গেয়েছিলেন নজরুলগীতি। টের পাননি, সে জলসায় তিনি গুরুদক্ষিণা দিয়ে ফেলেছিলেন নিজের অজান্তেই। কারণ তাঁর এক দ্রোণাচার্য নিজেই সেখানে বসে তাঁর গান শুনছেন! বুঝতে পারলেন যখন স্বয়ং বিমলভূষণ এসে তাঁকে জি়জ্ঞাসা করলেন, এ গায়কি তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন? সলজ্জ অনাথবন্ধু জানিয়েছিলেন, তিনি নিজে বিমলভূষণের একলব্য।

গুরুদক্ষিণা দেওয়ার পর্ব এখনও বহমান। দোতারার সুরে উড়ে গিয়েছে জীবন-পদাবলীর ঊনষাটখানি পৃষ্ঠা। মঞ্চে বা ইউটিউবে, অনাথবন্ধু ঘোষ একজন সফল শিল্পী। এখনও তাঁর প্রতিটি গান এক একটি গুরুপ্রণাম। গুরুসঙ্গ তিনি করছেন চার বছর বয়স থেকে। জয়দেব-কেঁদুলির তমালতলা আশ্রমে, বাউল সুধীরবাবার কাছে সঙ্গীতপরিচয় শুরু হয়েছিল বটে, কিন্তু ছোট্টবেলাতেই শুরু হয়ে যায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম। টিকড়বেতা গ্রামের সুধীর মণ্ডলের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের হাতেখড়ি। গানের পাশাপাশি তবলায় সঙ্গত শিখেছিলেন শ্রীধরচন্দ্র ঘোষের পাশে বসে। সেখানেই আশ মিটল না। ধ্রুপদী সঙ্গীতের পরিধিকে আরও গভীর করতে এর পর নাড়া-বন্ধন বারাণসী ঘরানার শিল্পী পণ্ডিত গৌরীশঙ্কর জয়সওয়ালের কাছে। দীর্ঘ ৩৮ বছর চলেছিল তাঁর কাছে শিক্ষা।

এখনও তাঁর প্রতিটি গান এক একটি গুরুপ্রণাম।

হৃদমাঝারে গানের সুর যত নিজের বসত গভীর করেছে, তত বাড়ির সঙ্গে বন্ধন আলগা হতে শুরু করেছে। বাড়ির লোকের অনাদর নয়, বরং, ঘরছাড়ার কারণ ছিল আপন থেকে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানোর তাগিদ। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছিল। তাই আটের দশকের গোড়ায় গৃহত্যাগী হলেন সদ্য যুবক অনাথবন্ধু। তত দিনে তাঁর মন মজেছে ফণীভূষণ দাসের মেঠো সুরে। তাঁর হাত ধরেই প্রবেশ জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-র জগতে।

দ্বাদশ শতকের শেষে রাজকবি জয়দেবের পদাবলী রচিত হয়েছিল রাজভাষায়। মহাভারত বা শ্রীমদ্ভাগবতের কাহিনিসীমা ছাড়িয়ে যে রাধেগোবিন্দ প্রেমলীলা, তার কবিত্বময় রূপ সৃষ্টির জন্য জয়দেবের সন্ত হওয়ার প্রয়োজন হয়নি। রাজ পৃষ্ঠপোষকতাতেই তাঁর কলমে ধরা দিয়েছিল দেবীর পদপল্লবম্। তেমনই, সংসারের গণ্ডি হারাতে আচারে-বিচারে বাউল হওয়ার দরকার পড়েনি অনাথবন্ধুর। তিনি গেরুয়া বসনধারী নন। তাঁর সাধনসঙ্গিনী নেই। তাঁর মাধুকরী নিষ্ঠাবান বৈষ্ণবের মতো মধুময়।

সেই মধুর আস্বাদন পাওয়া যায় তাঁর প্রতি শব্দে। পাওয়া যায় প্রতি একাদশীতে জয়দেব-কেন্দুবিল্বতে মাধবের মন্দিরে। সেই তিথিতে রাতভর তিনি নিরবচ্ছিন্ন গান গেয়ে যান। একাদশীর চাঁদের ঘোরে, ভক্তদের চোখের জলে সান্দ্র হয় মনের ভক্তিরস। অনাথবন্ধুর গলায় ধ্রুপদী ঘরানায় ধরা দেয় গীতগোবিন্দ—

‘‘চন্দনচর্চিত-নীলকলেবর

পীতবসন বনমালী

কিবা চেলি চঞ্চল মণি কুন্তল দু’লে

হসিত গণ্ডে বিভা ঢালি…’’

আবার পরমুহূর্তেই গ্রামবাংলার বৈষ্ণবের নিকোনো আঙিনার তুলসিমঞ্চের পবিত্রতা ভেসে আসে তখন, যখন পরের লাইনগুলিই তিনি গাইতে থাকেন মেঠো সুরে—

‘‘হের সখি, হোথা হরি রঙ্গে

বিহার করিছে কিবা কেলিরসে ডগমগ

সুন্দরী বধূগণ সঙ্গে।।’’

গীতগোবিন্দের পদে নিজের শিকড় খুঁজে পান জন্ম-বাউল অনাথবন্ধু। নিজস্ব চিত্র।

মাধবের মন্দিরে এই গান করার রীতি শুরু করেছিলেন ফণীভূষণ দাস। গুরুর সেই ধারাকেই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন শিষ্য অনাথবন্ধু। চেষ্টা করেন এই রীতিতে ছেদ না ফেলতে। তাই তাঁর অনুষ্ঠানের তারিখ স্থির করা হয় পঞ্জিকা দেখে, একাদশী বাঁচিয়ে।

সারা বছরই কি অনুষ্ঠানের স্রোত থাকে? মৃদু হাসির সঙ্গে উত্তর এল, ‘‘মাধব যেমন চান, সে রকমই আসে। তাঁর সঙ্গে আমার নিত্য কথা হয়। যখনই সংসারে টানাটানি দেখি, বলি, মাধব কিছু একটা করো। বলতে নেই, মাধব কোনও বারই বিমুখ করেন না। ঠিক কিছু না কিছু একটা উপায় হয়।’’

কিন্তু যিনি সংসার ছেড়েছেন, তাঁর আবার সংসার কী? গৌরবাজার গ্রামের আখড়ার নাবালক তমাল গাছের পাতার মতোই উত্তুরে হাওয়ায় উড়তে থাকে চিরসবুজ বাউলের সাদা লম্বা দাড়ি। হয়তো সংসার ছেড়ে এলেও সংসার পিছু ছাড়ে না। সন্ন্যাসীর লোটাকম্বলের মতোই বাউলেরও পিছুটান থেকেই যায়। ভক্তদের কথায়, ‘‘অনাথদার সংসার এখন বিস্তৃত। উপার্জনের প্রায় সবই চলে যায় দশের সেবায়। সেই দানের ধারা চলছে ঘরছাড়ার সময় থেকেই। তখন থেকেই তিনি গান শিখছেন এবং শেখাচ্ছেন। পাশাপাশি দান করে চলেছেন।’’

ঘরছাড়ার পরে দীর্ঘ দিন দুর্গাপুর স্টিল টাউনশিপে গান শিখিয়েছেন অনাথবন্ধু। আজ তাঁর নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানাই নেই। পূর্ণ এই ভবঘুরে জীবনের নিগড়ও গুরু শিষ্য পরম্পরায় বাঁধা। বেশির ভাগ সময়েই আশ্রয় জুটে যায় কোনও না কোনও শিষ্য-শিষ্যার কাছে।

পূর্ব বর্ধমানে গৌরবাজারের আরশিনগর আখড়ায় পুণের শিল্পী শ্রুতি বিশ্বনাথের সঙ্গে অনাথবন্ধু। নিজস্ব চিত্র

কিন্তু সুখের লাগি প্রেম কি শুধু বহেই গেল?

প্রশ্ন শুনে প্রথমে অট্টহাসি। তারপর বাউল জানালেন, ঘর বাঁধার প্রস্তাব যে আসেনি, তা নয়। কিন্তু সখীদের কুসুমকোমল হৃদয় তাঁরই অনাদরে ঝরে গিয়েছে। তিনি নিজের কঠিন জীবনের সঙ্গে আর কারও জীবন জড়াতে চাননি। বলেছেন, ‘‘আমি আলেয়া। আলেয়াকে আলো হিসেবে নিয়ো না।’’ তাঁর মনে হয়েছে, দেখেও না দেখা, বুঝেও না বোঝা-ই ভাল। তবেই সবাইকে সুখে রেখে সুখের বসন্ত সুখে সারা হয়।

তাঁর মনে অবশ্য চিরবসন্ত। সেখানে গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে সব সময়ই মৃদুল মধুর বংশী বাজে। সেই সুর কেটে যায় পৈতৃক বাড়িতে গেলে। বাড়ির আপ্যায়নে, সুস্বাদু খাবারে কেন যেন মনে হয় হৃদয়ে প্রণয়কুসুমরাশে ভাটা পড়ে গেল। আবার পথে বেরিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনেই তিনি অনুভব করেন কুঞ্জে কুঞ্জে অযুত কুসুমের সুগন্ধ।

খোল-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ হাতে এখনও ওঠেনি মোবাইল। নিজস্ব চিত্র।

মাধবের কাছে তাঁর প্রার্থনা, হৃদয় আকাশে মোহমেঘ এসে তাঁর দৃষ্টিপথ যেন ব্যাহত না হয়। আরও একটা আর্জি, তিনি যেন জীবনের শেষ দিন অবধি শিখে যেতে পারেন। আরও ভাল করে ধ্রুপদী সঙ্গীত পরিবেশন করতে পারেন। চর্চায় যাতে মরচে না ধরে, নিরন্তর চলে অনুশীলন।

আর চলে গান শোনা। সব রকমের গান শোনেন তিনি। কোনও গানই তাঁর কাছে অস্পৃশ্য নয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর কাছে সোনার গৌর হলেন পণ্ডিত যশরাজ, পণ্ডিত ভীমসেন যোশি এবং উস্তাদ আমির খাঁ। তাঁদের মতোই বাউলমনে বসত করেন মান্না দে, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্ল এবং তালাত মামুদ। ভালবাসেন কিশোর কুমার, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মহ আজিজ, মুকেশ, অনুরাধা পড়ওয়াল, উদিত নারায়ণের গানও। বর্তমান প্রজন্মের লোপামুদ্রা মিত্র, শ্রেয়া ঘোষালেও মুগ্ধ তার পরিযায়ী মন। সুরকার হিসেবে সবথেকে প্রিয় সলিল চৌধুরী।

মনের খেয়ালে হঠাৎ গেয়ে ওঠা বাউল অনাথবন্ধু ঘোষের।

দোতারা, তবলা-সহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ হাতে এখনও ওঠেনি মোবাইল। কিন্তু রাণু মণ্ডলের গান তাঁর শোনা হয়ে গিয়েছে। এবং সে গান তাঁর ভাল লেগেছে। শুধু তাঁর সংযোজন, সোশ্যাল মিডিয়ায় খ্যাতি পেলেও শিল্পীকে নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। নইলে যে সোশ্যাল মিডিয়া তাঁকে মাথায় তুলেছে, তারাই একদিন ছুড়ে ফেলে দেবে। বুঝলাম, রাণু মণ্ডলকে নিয়ে ইন্টারনেট জুড়ে চলা ব্যঙ্গ আর তীব্র কটাক্ষ পৌঁছয়নি তাঁর কাছে।

সে খবর বলতেও ইচ্ছে করল না। বরং জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার এত রকমের গান ইউটিউবে জনপ্রিয়। অনেকেই জানেন না, রাণু মণ্ডলের বহু আগে ইউটিউবে ভাইরাল হয়েছিল আপনার গান। এত রকম গানের মধ্যে আপনি নিজে কোন গান গাইতে সবথেকে বেশি পছন্দ করেন? এই প্রথম উত্তর দিতে একটু থমকালেন। তিলেক ভেবে বললেন, ‘‘নীলকণ্ঠ গোঁসাই, লালন ফকির, বৈষ্ণব পদাবলীর বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস... সবার গান গাই। মনের খেয়ালে নিজেও গান বাঁধি। কিন্তু আমার সবথেকে প্রিয় নজরুলগীতি। অনুষ্ঠানে সুযোগ না পেলে নিজের মনেই গাইতে থাকি তাঁর গান।’’

শুনে মনের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটছিল, তাহলে কি বৈরাগী মনে লুকিয়ে আছে বিদ্রোহী সত্তা? সে প্রশ্ন রইল বুদ্বুদ হয়েই। উত্তর এল বিনা প্রশ্নে। বললেন, ‘‘আসলে দুখু মিয়াঁর সঙ্গে নিজের জীবনের বড় মিল পাই যে। খুব অল্প বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন তিনি-ও। মাকে হারিয়েছিলেন অল্প বয়সে। তাঁর গানকে আমার নিজের অন্তরের কথা বলে মনে হয়।’’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তো বড় তাড়াতাড়ি বঞ্চিত হয়েছিলেন মায়ের আদর থেকে। তাঁর গান?

‘‘তাঁর চিরশাশ্বত গান তো রয়েছে মনের মণিকোঠায়। কিন্তু সেখানে এত বিধির বাঁধন ছিল, গাইতে খুব ভয় লাগত। কী জানি, কোন বিধিনিষেধের কোপে পড়ে যাই! এখন তো বিধির বাঁধন অনেকটাই আলগা হয়েছে। ইচ্ছে করে, তাঁর ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ সম্পূর্ণ গেয়ে উঠি। কিন্তু অন্তরঙ্গ আড্ডা একরকম, আর মঞ্চ অন্যরকম। কঠোর অনুশীন করে তবেই একদিন প্রকাশ্যে গাইব ব্রজবুলি অনুসরণে লেখা তাঁর অসামান্য পদাবলী।’’

অনাথবন্ধুর কণ্ঠ আর জীবনযাপনে মিলেমিশে যায় সহজিয়ার সঙ্গে পদাবলী। হাতে ধরা থাকে নাগরিকত্ব আইন হিসেবের পেন্সিল। শীতের চিলতে বেলা পাততাড়ি গুটোতে থাকে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় অনাথবন্ধু বলেন, ‘‘আমার নাম কে রেখেছিলেন, জানি না। তবে তাঁকে বেশি ভাবতে হয়নি। মাতৃহীন শিশুর আর কী নামকরণই বা হতে পারে? জানেন তো,‘বন্ধু’ চলে গিয়ে আমি এখন বেশি পরিচিত ‘অনাথ’ নামেই।’’ তাঁর হাসির শব্দ একঝাঁক পাখিকে মনে করিয়ে দিল এ বার তাদের বাড়ি ফেরার পথ ধরতে হবে।

অন্য আখড়ার পথ ধরলেন বাউলও। যাওয়ার আগে বললেন, তাঁর নাকি অন্নপ্রাশন হয়নি। বাড়ির সবাই ধরেই নিয়েছিল, এত রুগ্ন শিশু বেশিদিন বাঁচবে না। তাই মুখে ভাত দেওয়ার তোড়জোড় হয়নি। কিন্তু আশঙ্কা উড়িয়ে সবাইকে বিস্মিত করেছিল সেই শিশু। পরে এক তুতো ভাইয়ের অন্নপ্রাশনে তাঁকেও ভাত খাওয়ানো হয়। সেই ধারাই চলে আসছে। বাড়ির বদলে বহু হেঁসেলে আজ তাঁর অন্ন বাঁধা। তাই তাঁর মন খেজুরগাছে হাঁড়ি বেঁধেছে রসের খোঁজে। বাউলের নিজের সকল রসের ধারা বহুদিন পথহারা হয়ে একাত্ম হয়ে গিয়েছে তাঁর মধ্যে, যাঁর মহাসন হৃদয়ে আলোয় ঢাকা। সেই বন্ধুর হাত-ই নিশীথ রাতের মতো জীবনের বিজনঘরে তাঁর একমাত্র যষ্ঠি। জীবনমরণের সীমানা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পরম বন্ধুকে গান শোনাবেন বলেই তিনি জেগে থাকেন।

বর্ধমান-বীরভূম সীমানায় প্রত্যন্ত গ্রাম গৌরবাজারের লালমাটিতে ধুলো তুলে বাউল অনাথবন্ধুকে নিয়ে ভক্তের মোটরবাইক মিলিয়ে যায়। যেখানে হৃদি ভেসে যায় অজয় নদ আর হিংলো নদীর সঙ্গমের জলে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement