ভূতেরা কোথায়! কুলুপ এঁটেছেন ‘ঘনিষ্ঠেরা’

দশচক্রে, ভূতই কি এখন ভগবান? অনীক দত্তের ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ‘ভ্যানিশ’ হওয়ার তিন দিন বাদে প্রশ্নটা রীতিমতো জোরালো।  

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৪৯
Share:

মুখর: অ্যাকাডেমি চত্বরে প্রতিবাদ সভায় সব্যসাচী চক্রবর্তী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনীক দত্ত প্রমুখ। মঙ্গলবার। ছবি: রণজিৎ।

দশচক্রে, ভূতই কি এখন ভগবান? অনীক দত্তের ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ‘ভ্যানিশ’ হওয়ার তিন দিন বাদে প্রশ্নটা রীতিমতো জোরালো।

Advertisement

দু’দিন আগে চিঠি লিখে ছবিটি হল থেকে অপসারণের কড়া নিন্দা করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মঙ্গলবার তিনি নিজে অ্যাকাডেমি-চত্বরে প্রতিবাদ-সভায় শামিল হয়েছেন। নাগরিক সমাজকে কার্যত সচেতন করার ভঙ্গিতে বর্ষীয়ান অভিনেতা বলেন, ‘‘এটা শকিং, গর্হিত অপরাধ! ফ্যাসিস্ট প্রবণতা। এখনই এর প্রতিবাদ না-করলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। আপনারা বাধা দিন, দেশটাকে কলুষিত হতে দেবেন না।’’

শাসকের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে চিহ্নিত টালিগঞ্জের প্রযোজক বা কলাকুশলীদের সংগঠন এখনও এই সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে মুখ খোলেনি। কিন্তু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রবীণ থেকে নবীন প্রজন্মের অনেককেই কার্যত এক সূত্রে মিলিয়ে দিয়েছে অনীকের ছবির ‘ভূত’কুল। তাতে আপ্লুত অনীকও। তিনি বলেন, ‘‘কাউকে একটা ফোন করতে হয়নি। অনেকে নিজে এসেছেন, অনেকে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন।’’ তবে হল থেকে ছবিটি সরে যাওয়া অনেকের কাছেই ‘অদ্ভুতুড়ে’। সন্ধ্যায় আনন্দবাজারের কাছে মুখ খোলেন ইন্ডাস্ট্রির অভিভাবকপ্রতিম প্রসেনজিৎ।

Advertisement

অনীক দত্তের সিনেমা যদি দেখে থাকেন, তবে এই কুইজ আপনার জন্য

প্রসেনজিতের কথায়, ‘‘আমি কোনও ছবির প্রচারের শরিক নই! কিন্তু সেন্সরের ছাড়পত্র পেয়েও একটা ছবির আটকে যাওয়ার ঘটনা, অভাবনীয়! বিষয়টা দর্শকদের উপরে ছাড়লেই বোধহয় ভাল হত।’’ অশীতিপর চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার নিজে ধর্মতলায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘এটা শুধু অনীকের ছবি না দেখানোর বিষয় নয়। কোনও শিল্পীই কারও ক্রীতদাস হতে পারে না।’’ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন থেকে সৃজিত মুখোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, আবীর চট্টোপাধ্যায়, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, বিরসা দাশগুপ্ত, অনুপম রায়দের মতো অনেকের পাশে থাকার বার্তাও এ দিন উঠে এসেছে।

‘‘একটি সেন্সর পাওয়া ছবি আটকানোর পিছনে কোনও অজুহাতই ধোপে টেকে না’’— ইংরেজিতে লেখা অপর্ণা সেনের এই বার্তা পাঠ করা হয়। ছবি সরানোর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তীও। এমনকি শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বেরাও গোটা ঘটনায় ধন্দে। রাজ্যসভার সাংসদ, চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরীরই মত, ‘‘আমি পুরোদস্তুর শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’’ তবে অনীকের ‘ভূতেদের’ ঠিক কী হয়েছে, তাঁর ‘জানা নেই’!

‘‘তবে ফেসবুকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যা হিড়িক, তাতে ছবিটির কণ্ঠরোধ হয়েছে, তা-ই বা কী করে বলি? আমার কাছে তেমন তথ্য নেই!’’— এখনও বলে চলেছেন কবি সুবোধ সরকার। কয়েক দিন আগে রাজ্যে শাসকদের ধরনার পাশে দাঁড়াতে হাজির হয়েছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র। তিনিও নীরব! বললেন, ‘‘গত ১৪ ফেব্রুয়ারির পর থেকে যা যা ঘটছে, তাতে মন ভাল নেই। এই সিনেমার বিষয়টি জানিও না! এটা নিয়ে এখন বলব না!’’ চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন ফোনে, এসএমএসে সাড়া দেননি।

নৈঃশব্দ্যের আর এক রকম ছবি দৃশ্যমান টালিগঞ্জেও। পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ফোনে বিষয়টি শুনে বলেন, ‘‘এখন মিটিংয়ে আছি!’’ সে মিটিং ‘শেষ’-এর খবর শেষ পর্যন্ত মেলেনি। ঘটনাচক্রে, কৌশিকের ছবি রিলিজ়ও সামনেই!

কিন্তু অনীকের রিলিজ় হওয়া ছবির অন্তর্ধান-রহস্য এখনও রহস্যই। সংস্কৃতিজগতের বিদগ্ধমহলে অনেকেই তা নিয়ে ধন্দে। কলকাতা শহরে এমন ঘটনায় ‘লজ্জিত’ নবনীতা দেবসেনের প্রশ্ন, ‘‘এটা কি জরুরি অবস্থা চলছে? রাজনৈতিক স্যাটায়ার দেখানো যাবে না?’’ নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্রের মতে, ‘‘যা হয়েছে, তা ঠিক মনে করছি না।’’ নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বিভাস চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘শিল্পী নয়, শাসকের স্বাধীনতাটাই এ দেশে বড় কথা!’’

তবু শাসকের এই মৌরসিপাট্টার যুগেও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বহু পেশাদারই প্রতিবাদে সরব। তাতে খুশি বাম-ডান সব আমলেই প্রতিবাদী মুখ বলে পরিচিত অভিনেতা-নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেন। তাঁর মৃদু আক্ষেপ, ‘‘আমাদের থিয়েটারের বন্ধু কাম তৃণমূলের নেতা কয়েক জন শুধু মুখ খুললেন না! মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, সাংসদ অর্পিতা ঘোষদের বারবার ফোন এসএমএসে সাড়া মেলেনি।’’

তৃণমূল সাংসদ-অভিনেত্রী মুনমুন সেন কিন্তু অকুতোভয়। অনীকের ছবিতে তিনিও একটি ছোট্ট ভূমিকায়! তাঁর একটাই কথা, ‘‘আমি জানি না। তবে ছবি তোলার মতো চরম (এক্সট্রিম) ব্যবস্থার পিছনে নিশ্চয়ই কোনও চরম কারণ আছে!’’ সেন্সরের ছাড়পত্র থাকলেও অনীকের ‘ভূতেদের’ আর এক বার যাচাই করার দরকার আছে বলেই অভিনেত্রীর বিশ্বাস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement