(বাঁ দিকে) শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
সোমবার, ২০ মে শিবুর ৫০তম জন্মদিন। পঞ্চাশ মানে, তা নানা কারণে স্পেশ্যাল হতে পারে। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আবার ২৫ বছরের। শিবুর জন্মদিনে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে লেখার প্রস্তাব পেয়ে আমার খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু ভাবছিলাম কী নিয়ে লিখব। তার পর ভেবে দেখলাম, আমি আর শিবু যে জুটি বেঁধে ছবি করি— এই অধ্যায়টা এখনকার সকলেই প্রায় জানেন। তাই আজকে এক অন্য গল্প শোনাই। শিবু যখন ‘শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়’ হয়ে ওঠেনি, অনেকটাই অল্পবয়সি, তখনকার গল্প। ওকে আমার আবিষ্কারের গল্প।
শিবুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ টিভির পর্দায়। শিবু ছিল ‘২১শে পা’-এর ভেঙ্কি। আর আমি এক জন দর্শক। ওর অভিনয় আমার এতটাই ভাল লাগে যে, ঠিক করি এই ছেলেটিকে আমায় খুঁজে বার করতেই হবে। ভাবলাম, যদি কোনও দিন আমি ছবি তৈরি করি, তা হলে সেখানে এই ছেলেটি অভিনয় করবেই। পরবর্তী কালে আমার স্বামী নীতীশ রায় ঠিক করলেন, ‘জামাই নম্বর ওয়ান’ নামে একটা ছবি পরিচালনা করবেন। তখন ওই ছবিতে আমরা নায়ক হিসেবে শিবুকে চূড়ান্ত করলাম।
এ বার অন্য সমস্যার সূত্রপাত। কাস্ট করলেই তো হল না। ছেলেটিকে তো খুঁজে বার করতে হবে। আমরা তখন মুম্বইয়ে থাকতাম। কলকাতার কলাকুশলীদের সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ ছিল না। সম্পাদক রবিরঞ্জন মৈত্র আমাদের খুব ভাল বন্ধু। ওর থেকে জানতে পারলাম যে, শিবু থাকে বরাহনগর অঞ্চলে। সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বরাহনগরেই থাকেন। ওঁর সঙ্গে আমাদের খুব ভাল আলাপ ছিল। পরিকল্পনা করে একদিন সঞ্জীবদার বাড়িতে আমরা হাজির হলাম। সেখানেই উনি শিবুকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শিবু তখন মনে হয় পাড়ায় ফুটবল বা ক্রিকেট খেলছিল। দৌড়তে দৌড়তে এসে দেখা করেই চলে গেল। আমরা ওকে বলেছিলাম, একদিন আমাদের বাড়িতে এসে দেখা করতে। ও বাড়িতে এল। আমরা বললাম, আমাদের ছবিতে আমরা ওকে নায়ক হিসাবে চাইছি। রাজি হল শিবপ্রসাদ।
‘বহুরূপী’ ছবির শুটিং ফ্লোরে নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
তত দিনে আমার স্বামী ‘রামোজি ফিল্ম সিটি’ তৈরির উদ্যোগের সঙ্গে ভাল মতোই জড়িয়ে পড়েছেন। ওখানেই ছবির শুটিং হবে। আমাদের ছবির প্রযোজকও রামোজি রাও। নীতীশ এ বার শিবুকে বললেন, আমাদের ছবির বাজেট কম। তাই ২৫ হাজার টাকার বেশি পারিশ্রমিক দিতে পারবেন না।
তখনকার দিনে সেটা শিবুর জন্য অনেক টাকা। ও ভাবতেই পারেনি যে, কেউ ওকে এই টাকাটা পারিশ্রমিক হিসাবে দিতে পারে! কিন্তু ও যে হতবাক, সেটা কিন্তু আমাদের সামনে এক বারও প্রকাশ করেনি। যেন এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। ঠিক আছে, ভেবে দেখা যাবে গোছের একটা ভঙ্গি। কিন্তু পরে জেনেছিলাম, ও সত্যিই অবাক হয়ে যায়। বাচ্চা ছেলে। ওই বয়সে এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ছবির শুটিং তো শুরু হল, কিন্তু সেখানে শিবুর সঙ্গে আমার একাধিক বিষয়ে মনোমালিন্য হতে থাকে। আমি দেখতাম, ও শুধুই শটের সময়ে ফ্লোরে আসে। তার পর হোটেলে গিয়ে শুয়ে থাকে। ছবিতে সন্ধ্যা রায়, রঞ্জিত মল্লিক, দীপঙ্কর দে-র মতো বড় বড় সব অভিনেতা অভিনয় করছেন।
এক দিন খুব বিরক্ত হলাম। ওকে ভীষণ বকলাম। বললাম, ‘‘তুমি কী করতে চাও? দেশের অন্যতম সেরা ফিল্ম সিটিতে থেকে তোমার কি একটু ঘুরে দেখতেও ইচ্ছে করে না! একটু শিখতেও ইচ্ছে করে না! সিনিয়র শিল্পীদের অভিনয় দেখে হাতেকলমে যা শেখা সম্ভব, সেটা যে কোনও ফিল্ম স্কুলে শেখা সম্ভব নয়!’’ বকেঝকে বোঝালাম ওকে। চুপ করে শুনল। তখন হয়তো ও মনে মনে ভেবেছিল, ‘‘দাঁড়া, একদিন ঠিক দেখে নেব!’’
কিন্তু এই ছবি করতে করতেই ওর সঙ্গে আমার একটা গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হল। আমরা দেখলাম যে, আমাদের এক রকম লেখা, বই, সঙ্গীত বা গানে আগ্রহ। এমনকি আমরা একই রকমের গল্প বা আলোচনা করতে বা লিখতে ভালবাসি। ব্যস, এখান থেকেই মনের মিল হয়ে গেল। ছবি মুক্তি পেল। এর পরও শিবুর সঙ্গে হায়দরাবাদে যে সম্পর্ক তৈরি হল, সেটা কিন্তু চলতেই থাকল।
এর বেশ কয়েক বছর পরের কথা। আমি তখন কলকাতার একটি চ্যানেলের বিনোদন বিভাগের দায়িত্বে। আর শিবু কলেজের ছাত্র। পড়াশোনায় বিশেষ একটা মন ছিল না ওর। চ্যানেলে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমার বাড়িতে গুচ্ছের চিত্রনাট্য জমে থাকত। শিবু বাড়িতে এলে আমি ওকে বলতাম চিত্রনাট্যগুলি পড়ে দেখতে। এক দিন ওকে বোঝালাম যে, সিনেমা জগতে যদি কিছু করে খেতে হয়, তা হলে আমার সঙ্গে ওর যোগ দেওয়াটাই উচিত সিদ্ধান্ত হবে। ও রাজি হল। আমরা তার পর একসঙ্গে ২৬টি নন ফিকশন অনুষ্ঠান করলাম। আমাদের ভাবনায় গড়া প্রতিটা শো জনপ্রিয় হল। শৈল্পিক দিক থেকে দু’জনের এই একই পথে চলা দেখে বুঝতে পারি যে, ভবিষ্যতে আমরা নিজেরা কিছু করতে পারি।
ছবি: সংগৃহীত।
এই ভাবেই উইন্ডোজ় (নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের প্রযোজনা সংস্থা) তৈরি হল। আমাদের সংস্থার অধীনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নন ফিকশন করতে শুরু করি। তাতে যেন মন ভরছিল না। কারণ আশ্চর্যের বিষয়, তখনও কোনও চ্যানেল আমাদের ফিকশনের প্রস্তাব দিত না। হয়তো ভাবত যে, আমরা একমাত্র নন ফিকশনটাই ভাল তৈরি করতে পারি।
এক সময় একঘেয়ে লাগতে শুরু করল আমাদের। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে আমরা ছবির চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করলাম। কেননা আমরা ভাল গল্প বলতে চাইছিলাম। এই সিদ্ধান্ত থেকেই ‘ইচ্ছে’ ছবিটা করি। তার পর তো আমরা একসঙ্গে এতগুলি ছবি করে ফেললাম।
লিখতে লিখতেই এখন মনে পড়ছে অনেক কথা। আবাক লাগছে খুব। সত্যিই কী ভাবে যেন সময় কেটে যায়। আজও আমরা একসঙ্গে কাজ করি। আমাদের রসায়নটাও অটুট। আগামী দিনেও আশা করি আমরা এই ভাবেই এগিয়ে যাব।
জন্মদিনে শিবুকে উপহার আগেই দিয়ে দিয়েছি। আমাদের পরবর্তী ‘আমার বস’ ও ‘বহুরূপী’ ছবিতে ওকে দুটো দুর্দান্ত চরিত্র উপহার দিয়েছি। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র। কিন্তু আমার মনে হয়, দুটো ছবিতেই ও যা অভিনয় করেছে, তা দর্শককে চমকে দেবে। কোন চরিত্রে বেশি ভাল অভিনয় করেছে, সেটা বলা মুশকিল!
শিবু আমাকে মজা করে বলে, ‘আমার বস্’। কিন্তু আমি মোটেও শিবুর ‘বস্’ নই। আমরা সমানে সমানে একে অপরের পার্টনার! কিন্তু আমাকে ওর ‘বস্’ বলতে ভাল লাগে। কী করতে পারি! সবটাই ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা থেকে একটা সম্বোধন। তবে, এই প্রসঙ্গেই জানিয়ে রাখি, ‘আমার বস’ ছবিটা কিন্তু আমার সঙ্গে শিবুর সম্পর্ক নিয়ে নয়। ওখানে রয়েছে এক জন মা ও ছেলের গল্প।
এত দিনের সম্পর্ক। কতটুকুই বা লেখার মধ্যে ধরে রাখতে পারা যায়। এটুকু জানি, শিবু আমার জীবনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে। আজকে পঞ্চাশে পা রাখল শিবু। আমার মনে হয়, সেই সঙ্গে ওর কেরিয়ারের সোনালি দিনেরও সূত্রপাত ঘটল। কারণ আমি এখনও ওর সেরা কাজের অপেক্ষায় রয়েছি। আশা করি, আগামী দিনে ও যেন সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছয় এবং ওর সমস্ত স্বপ্ন পূরণ হয়।